মানব প্রকৃতির ভ্রান্ত ধারনার ইতিহাস এবং এর প্রকৃত সরূপ
ইমরান হাবিব রুমন

মুক্তান্বেষায় মানব প্রকৃতি নিয়ে অপার্থিবের ‘মানব প্রকৃতি কি জন্মগত, না পরিবেশগত?’ এবং মুক্তমনায় অভিজিৎ এর ‘মানব প্রকৃতির জৈব বিজ্ঞানীয় ভাবনা’ লেখা দুটি পড়ে এ বিষয়ে কিছু আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করছি। মানব প্রকৃতির সম্পর্কে ধারণার জন্য লেখাটিকে- মানব প্রকৃতির ভ্রান্ত ধারণার ইতিহাস, প্রাণীর সাথে মানব মস্তিষ্কে পার্থক্য, মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে  ইত্যাদি কয়েকটি ভাগে আলোচনা করা হলো।


বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে আমরা জানি প্রাচীন ব্যাবিলন ও মিশর পর্যবেক্ষণ মূলক জ্যোতিষ, ভেজকবিদ্যা, জ্যামিতি, গনিত এবং ব্যবহারিক শিক্ষায় বেশ উন্নত ছিল। পরবর্তী সময়ে আয়োনীয় গ্রীকরা (খ্রী:পূর্ব ৬০০-৪০০) এই পর্যবেক্ষণমূলক বিদ্যার সাথে যুক্তিমূলক চিন্তার সংযোজনার ফলে এক নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিল। পৃথিবী, বিশ্বব্রাহ্মান্ড ও তার অন্তর্ভূক্ত দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান যাবতীয় বস্তু প্রাকৃতিক কারণে উদ্ভূত হয়েছে এবং প্রত্যেক ঘটনার পশ্চাতে একটি সহজ সরল কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে, এটাই আয়োনীয় বিজ্ঞান ও দর্শনের মূলতত্ত্ব। যার প্রতিনিধিত্ব করেছেন থালেস্, লিউসিপ্পাস, ডিমোক্রিটাস, হিপোক্রেটিস্ প্রমুখ বিজ্ঞানীরা।
পরবর্তী সময়ে আয়োনীয় বিজ্ঞানের গৌরবময় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটার পর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ভারকেন্দ্র এথেন্সে স্থানান্তরিত হলে বিজ্ঞান দর্শনের আবার দিক পরিবর্তন ঘটে। প্লেটো, অ্যারিষ্টটল বস্তুবাদী দর্শন পরিত্যাগ করে আধ্যাতœবাদী প্রজ্ঞার দর্শন সৃষ্টি করেন। বস্তুবাদী দর্শন এর পরিসমাপ্তি পর আধ্যাতœবাদী দর্শনের সৃষ্টির কারণ ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন। আয়োনীয় উপনিবেশগুলোর প্রাধান্যের মূলে ছিল ব্যবসা ও বাণিজ্য। ফলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীক জীবনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল বণিক সম্প্রদায়ের। পূর্বে ধনী ভূমিদারের সাথে ভূমিচ্যুত দরিদ্র কৃষকদের একটানা সংঘর্ষ লেগেই ছিল। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বহু লোকের জীবিকার সংস্থান হলে সংঘর্ষের তীব্রতা হ্রাস পায় এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। দাসপ্রথা তখনও সমাজজীবনে উগ্র আকারে আতœপ্রকাশ করেনি। সমাজে দাসশ্রেণী ছিল কিন্তু দাসশ্রেণীর সাথে অভিজাত ও বণিক শ্রেণীর সহানুভূতির সম্পর্ক ছিল। ফলে দাসশ্রেণী হতে উল্লেখযোগ্য কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়নি। সুতরাং ব্যবসা বাণিজ্যের উপর গুরুত্বদান, সাধারণভাবে বণিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, দাসশ্রেণীর আনুগত্য প্রভৃতির ফলে সহজ সরল ও প্রগতিশীল সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তা স্বভাবতই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির অনুকূল। কিন্তু এই সামাজিক পরিবেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পারসিক আক্রমনের ফলে এশিয়া মাইনর উপকূলবর্তী আয়োনীয় গ্রীকদের উপনিবেশগুলোতে নানারূপ রাজনৈতিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পরবর্তীতে পেলোপোনেশীয় গৃহযুদ্ধের কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অবসন্নতা এসে পড়ে। ষড়যন্ত্র, চাতুরী, বিশ্বাসঘাতকতা, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি ঘৃণ্য উপায়ে ক্ষমতা হস্তগত করার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে রাজনৈতিক ও সামাজিক আবহাওয়া দূষিত ও কলুষিত হয়ে পড়ে এবং সমাজের ক্লেদ-গ্লানি একে একে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে ন্যায়পরায়নতা, নীতিবোধ, সত্যানুরাগ প্রভৃতি সদ্গুনে মানুষের সংশয় উপস্থিত হয়। এই অবস্থায় নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নতি সাধনের মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সমস্যা সক্রেটিসের কাছে সবচেয়ে জরুরী বলে প্রতিভাত হবে, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নাই।
রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা ছাড়া এসময় আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দাস প্রথার ব্যাপক প্রসার। প্রথম যুগে ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল অল্প। রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে এ সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। তারপর কর্ম ও জীবিকার সন্ধানে বহু বিদেশীর আমদানি ঘটে। কিন্তু সবার কাজ মিলল না। বহু সংখ্যক বেকার বিদেশী ও ক্রীতদাস বাধ্য হয়ে ভবঘুরেবৃত্তি অবলম্বন করে। এই ক্রমবর্ধমান ভবঘুরেদের সংখ্যা চিন্তাশীল ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিদের রীতিমত শিরঃপীড়া ও শঙ্কার কারণ হয়ে দাড়াল। তারা এই ভবঘুরে ভিক্ষুকদের সমস্যা সম্বন্ধে বিশেষভাবে চিন্তা করেন এবং ষ্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেন যে ভবঘুরে ভিক্ষুকদের কাজে নিয়োজিত করে জীবনধারনের ব্যবস্থা এবং চিন্তার ক্ষেত্রে অবদমিত করতে না পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রীক জীবন বিপন্ন হবার সম্ভাবনা আছে।
প্লেটো ক্রীতদাস প্রথার শুধু সমর্থকই ছিলেন না, তিনি বিশ্বাস করতেন যে স্বাভাবিক নিয়মে এই প্রথার উদ্ভব হয়েছে। অ্যারিষ্টোটল ক্রীতদাস প্রথাকে আরও সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি এই প্রথার সমর্থনে প্রাণিজগৎ হতে নজির টানিয়া এক প্রকার বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রদর্শন করেন, “

……..the antithesis of superior and inferior is found every where in nature- between soul and body, between intellect and appetite, between man and the animals, between male and female and that where such a difference between two things exists it is to the advantage of both that one should rule the other. Nature tends to produce such a distinction between men-to make some strong to work and others fit for political life. Thus some men are by nature free, and others slaves.”

W.D. Ross, Aristotle; Methuen & Co, London, 1923; P. 241 ,


এ সময় অপরিবর্তনীয় সমাজ ও সামাজিক বিন্যাসের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরী করা হয়েছিল। যার পিছনে কাজ করেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে জন্মগত পার্থক্যের অবশ্যম্ভাবীতার ধারণা। যেমন প্লোটো প্রচার করতেন যে, সৃষ্টিকর্তা সমাজের অধিপতিদের মূল্যবান ধাতু সোনা দিয়ে তৈরী করেছেন, মধ্যস্তরের মানুষেরা নির্মিত রূপা দিয়ে এবং নিচের স্তরের মানুষ লোহা দিয়ে।
“মানুষ জন্মগত ভাবেই কিছু সংখ্যক স্বাধীন, কিছু সংখ্যক পরাধীন- ফলে শেষোক্ত মানুষদের জন্য দাসত্ব ও অধীনতা সহজাত” – অ্যারিষ্টোটলের মত পান্ডিত্য ও জ্ঞানের জগতে প্রভাবশালী ব্যক্তির এই ভ্রান্ত ধারণা বস্তুগতভাবে নয়, মনস্তাত্ত্বিক ভাবেও বন্দীদশা ও আতœগ্লানির মধ্যে মধ্যে মানুষকে আটকে রেখেছে দীর্ঘদিন।


বর্তমান সময়েও অনেকে এ ধরনের চিন্তা থেকে মুক্ত নয়। বিভিন্ন লেখায় মানুষের স্বভাব গঠনে বংশানু উপাদানের অবদানই মুখ্য প্রমান করতে গিয়ে প্লেটো বা অ্যারিষ্টোটলের দাস ব্যবস্থার সময়কার এবং তার পরিপূরক কিছু যুক্তি(!) হাজির করা হয়, প্রাণীদের স্বভাব চরিত্র বা আচরণ-ক্রিয়াকলাপের সাথে মানুষের তুলনা করে বিভিন্ন উদাহরণও হাজির করা হয়। তাই প্রাণী জগতের সাথে মানুষের পার্থক্য বোঝার জন্য এ অংশটি বাড়তি মনোযোগ প্রত্যাশা করে।
এ কথা আমরা জানি, অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে মানব মস্তিষ্কই একমাত্র চিন্তা শক্তির অধিকারী। মানুষের মস্তিষ্কের উপরিভাগ বা সেরিব্রাল করটেক্স উন্নত ও বড় না হলে মানুষের চিন্তা ভাবনা গড়েই উঠতে পারতনা। মস্তিষ্কের গঠন যে রকম হলে প্রকৃতির সঙ্গে ঘাত প্রতিঘাতে বিকাশ ঘটতে পারে অন্যান্য প্রাণীর সেই বস্তুগত উপাদানই
(material condition)  গড়ে ওঠেনি। মানুষের মস্তিষ্কে একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে যার দ্বারা মানুষ চিন্তা করতে পারে, যাকে ইংরাজিতে বলা হয় ‘পাওয়ার অভ্ ট্র্যান্সলেশন অভ্ দ্য হিউম্যান ব্রেন’। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক- এই পঞ্চেন্দ্রিয়র মারফৎ মস্তিষ্কের বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাথে বহির্জগতের প্রতিনিয়ত সংযোগ হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াতেই ইন্টারঅ্যাকশন ঘটছে। ফলে সেনসেশন বা সংবেদন হচ্ছে, প্রথম সংতেকতন্ত্র (first signal system)  কাজ করছে, সঙ্গে সঙ্গে পেশীর সঞ্চালন (motor action) হচ্ছে- অথ্যাৎ ফ্রম নেসেশন টু মোটর অ্যাকশন ঘটছে। সুতরাং সংবেদন থেকে পেশী সঞ্চালন প্রক্রিয়া প্রথম সংকেততন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রথম সংকেততন্ত্রের সাহায্যেই ঠিক হয় কোন উত্তেজকের কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে- অথ্যাৎ কোন ধরনের উত্তেজক বা সেনসেশনের জন্য কোন ধরনের মোটর অ্যাকশন বা প্রতিক্রিয়া ঘটবে। আলাদা আলাদা সংবেদন আলাদা আলাদা ভাবে ক্রিয়া করে এবং তার ফলে তার প্রকাশ বা প্রতিক্রিয়াওআলাদা ধরনের হয়। পাভলভ reflex action বা পরাবর্ত ক্রিয়ার সাহায্যে এসব বিষয় বুঝিয়েছেন। মানুষ বা বহু জীবজন্তুর মস্তিষ্কে যে জীবকোষ (nerve cell) রয়েছে, তার যে ক্রিয়াকলাপ বা কার্যক্ষমতা তার ফলে পঞ্চেন্দ্রিয়ের মারফৎ যখন কোন কিছু এসে মস্তিষ্কে বা সুষুস্মাকা-(spinal cord)  ধাক্কা দেয়সঙ্গে সঙ্গে একটা সেনসেশন, একটা প্রতিক্রিয়া, একটা ক্রিয়া ঘটে। এটাকেই বলা হয় ৎবভষবী ধপঃরড়হ বা পরাবর্ত ক্রিয়া। একথা ঠিক, মানুষের মস্তিষ্কই একমাত্র চিন্তা করতে পারে। কিন্তু সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই পরাবর্ত ক্রিয়া কাজ করে। রিফ্লেক্্স বা পরাবর্ত দু ধরনের। একটা শর্তহীন পরাবর্ত©(unconditioned reflex), , অন্যটি শর্তাধীন পরাবর্ত (conditioned reflex)| । এ দুই ধরনের পরাবর্তই জীবজগতে কাজ করে। যেমন, কুকুরকে লাঠি দিয়ে আঘাত করলে শব্দ করে, ঘুমন্ত মানুষের পায়ের তলায় সুরসুরি দিলে ঘুমন্ত অবস্থাতেই পা সরিয়ে নেয়- এগুলো শর্তহীন পরাবর্তের উদাহরণ। একটা উত্তেজনা কাজ করছে, সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটছে। কোন জন্তু যখন একটা পরিস্থিতির মধ্যে বিশেষভাবে অভ্যস্থ হয়ে যায়, তখনই তার মধ্যে শর্তাধীন পরাবর্তের ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন, বেশ কিছুদিন পর মালিককে দেখার পর কুকুর লেজ নাড়ে বা পায়ের কাছে শুয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে প্রথম সংকেততন্ত্র ছাড়াও যে দ্বিতীয় সংকেততন্ত্র আছে তার ক্রিয়ায় সেনসেশন টু পারসেপ্শন- এবং তারপর চলে যায় আরেকটি প্রক্রিয়ায়, তার নাম ট্রান্স্লেশন। মস্তিষ্কের মধ্যেই সে ট্রানস্লেট করছে; অথ্যাৎ ভাবছে, বিচার করছে, বিশ্লেষণ করছে। এসবই পরিচালিত হচ্ছে দ্বিতীয় সংকেততন্ত্রের সাহায্যে। অথ্যাৎ মানুষের মস্তিষ্কের পাওয়ার অভ্ ট্রানস্লেশন আছে বলে, চিন্তা করার ক্ষমতা আছে বলে সেনসেশন টু মোটর অ্যাকশনেই প্রক্রিয়াটি শেষ হয় না। মূলত যা ঘটে তা হলো, সেনসেশন টু পারসেপশন টু কনসেপশন, যার প্রতিটি স্তরেই আবার মোটর অ্যাকশন ঘটতে পারে। পারসেপশনই আরও উন্নত হয়ে উন্নততর ভাব বা কনসেপশন-এর জন্ম দিয়েছে। এই পারসেপশনটা, কনসেপশনটা মস্তিষ্ক কোষ ধরে রাখতে পারে, স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে এবং আবার উল্টো দিকে, অথ্যাৎ রেসিপ্রোকাল অ্যাকশন বা পারস্পরিক ক্রিয়ার সাহায্যে সেনসেশন ও মোটর অ্যাকশনের উপরও ক্রিয়া করতে পারে। বাস্তব পরিবেশের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এই দ্বিতীয় সংকেততন্ত্র মানুষের মস্তিষ্কে চিন্তা এবং ভাব কিরকম হবে তার দিকনির্দেশ করছে। অথ্যাৎ মস্তিষ্কের বিশেষ গঠনের ফলে যে ভাবগত প্রক্রিয়াটি মানুষের মধ্যে শুরু হয়ে গেল সেই চিন্তাশক্তিটা কিভাবে, কোন দিকে কাজ করবে সেটাই নির্ধারিত হয় এই দ্বিতীয় সংকেততন্ত্রের সিগন্যালিং এর বৈশিষ্ট্যের দ্বারা।


এক্ষেত্রে মানব শিশুর গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি জানা খুবই প্রয়োজন। শিশুর জন্মের সময় সে থাকে অসহায়, নমনীয় কিন্তু বিপুল সম্ভাবনাময়। বাবা মার কাছ থেকে বংশানুক্রমিক কিছু অভিব্যক্তি জীনের ভিতর দিয়ে সে লাভ করে, যা প্রাথমিক ভাবে পরিবেশের সাথে প্রতিক্রিয়ায় ও আতœরক্ষায় শিশুর জন্য সহায়ক। যেমন- পড়ে যেতে নিলে শিশুটি হাত বাড়িয়ে কোন অবলম্বনকে ধরতে চায়, ক্ষুধা পেলে সে মায়ের স্তনের দিকে আপনা থেকেই আকৃষ্ট হয়। এগুলোকে প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলা হয়।


আতœরক্ষার এই প্রাথমিক প্রতিবর্তী ক্রিয়া গুলো তিন মাস বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। এরপর শিশু লাভ করে উপপ্রতিবর্তী ক্রিয়া। যেমন- এই সময় শিশু হামাগুড়ি দিতে পারে, ভারসাম্য রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। প্রথম এক বছরের মধ্যে শিশুর এই উপপ্রতিবর্তী ক্রিয়া সুক্ষ্মতর ও নিপুনতর হড়ে পড়ে। তার মস্তিষ্কে বিশেষ বিশেষ অংশে এ জন্য রূপান্তর ঘটে। এই উপপ্রতিবর্তী ক্রিয়া অবশ্য শিশুর সচেতন শিক্ষার ফসল নয়, শিশুর মস্তিষ্কের মধ্যেই জন্মগতভাবে এই সম্ভাব্য বিকাশ, জীনের নকসায় স্থাপন করা থাকে। ক্রমবর্ধমান মানব শিশুর আচরনে এই প্রতিবর্তী ক্রিয়ার দৃষ্টান্তগুলো ব্যতিক্রম মাত্র। তবে অনেকের মধ্যে তা থেকে যেতে পারে। তার অধিকাংশ আচরণ মূলত প্রায় সব আচরণ , তার শিক্ষা লাভের ফল এবং তা সহজভাবে অনুশীলন ও পরিবেশের প্রভাবে ঘটে। পঞ্চইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে আমরা আলো, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ইত্যাদি অনুভব করি। নবজাত শিশুর দেহে বিশেষ স্মায়ু থাকে যা আলা, শব্দ, স্পর্শ, চাপ, তাপ, শীতলতা, ক্ষুধা, পিপাসা, বেদনা, ক্লান্তি এবং অন্যান্য উপলব্ধির দ্বারা উদ্দীপিত হয়। অসংখ্য এসব তথ্য থেকে বাছাই করে নির্বাচিত তথ্যগুলো তার মস্তিষ্কে প্রেরিত হয়। শিশুর মস্তিষ্কে তথ্য পৌছে প্রধানত তিন ধরনের স্মায়ু প্রান্ত থেকে। এর একটি হলো বাহ্যপরিবাহী। দেহের বাহিরের জগৎ থেকে আসা নানা তথ্য যেমন শীতলতা, উষ্ণতা, আলো, শব্দ, মায়ের গায়ের গন্ধ, বাবার হাতের স্পর্শ- এসবই লাভ করে বাহ্য গ্রাহকের সাহায্যে। অন্তর গ্রাহক স্মায়ু প্রান্ত ভিতরের পরিবাহী স্মায়ু শিশুকে তার দেহের ভিতরের তাড়া যেমন ক্ষুধা বা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সাহায্য করে। তৃতীয় ধরনের স্মায়ু প্রান্ত  শিশুর অবস্থান বোধ যেমন হাত, পা, পরবর্তীতে আঙ্গুলের সুক্ষ্ম চালনা নিয়ন্ত্রন করে। শিশু তার বাহ্যপরিবাহী, অন্তরপরিবাহী এবং অবস্থানিক পরিবাহী ইত্যাদি সমস্ত ইন্দ্রিয় গ্রাহকের সাহায্যে বিপুল পরিমান তথ্যের বর্ষণ লাভ করে নানা সংকেতের মাধ্যমে। শিশুর মস্তিষ্ক এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল এ সমম্ত সংকেতের জঞ্জালকে বিন্যস্ত করে, সেখান থেকে বোধগম্য তথ্য সে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। মস্তিষ্কে সমস্ত তথ্যই বাছাই, নির্বাচন ও বর্জন প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে পার হয়। তথ্যের গুরুত্বের ভিত্তিতে শিশু তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে এবং প্রয়োজন বোধে নির্বাচিত তথ্য জমা করে রাখে স্মৃতি ধরে, পরবর্তীতে তা ব্যবহারের জন্য।এর সবটা মিলে শিশুর অভিজ্ঞতা অর্জন ও শিক্ষা লাভের ব্যপারটি সংগঠিত হয়। শিশুর মস্তিষ্ক কেমন করে তার ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যরাজী থেকে অর্থ উদ্ধার করে ও প্রতিক্রিয়া দেখায় তা বোঝার জন্য মস্তিষ্কের কর্মধারা সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন।


শিশু যখন তার মা বা বাবাকে স্পর্শ করে, তখন তার হাতের আঙ্গুলের প্রান্ত উদ্দিপ্ত হয়। স্পর্শের যে অনুভূতি তা গ্রাহক থেকে স্নায়ুসন্ধি অতিক্রম করে রাসায়নিক সংকেত রূপে স্মায়ুসন্ধি গ্রাহক ও পরবর্তী স্মায়ুকোষকে পৃথক করে রাখে। রাসায়নিক সংকেত একবার স্মায়ুসন্ধি অতিক্রম করার পর বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয় এবং কেন্দ্রাভিগ স্মায়ুসূত্রের জালের ভিতর দিয়ে নিউরোনে সঞ্চারিত হয়। নিউরোন হচ্ছে মস্তিষ্কের স্মায়ুতন্ত্রের কেন্দ্র, যা এক একটি সুইচ বোর্ডের মত কাজ করে। কেন্দ্রাভিগ স্মায়ুসূত্র ওনসাইড থেকে সংকেত লাভের পর এবং নিজস্ব তড়িৎ সংকেতকেন্দ্রাভিগ স্মায়ুসূত্রের মাধ্যমে পরবর্তী স্নায়ুসন্ধিতে প্রেরণ করে। সেখানে সমস্ত প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি ঘটে। কোনো তথ্য মস্তিষ্কে পৌঁছার জন্য এই জটিল প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক থেকে বৈদ্যুতিক এবং পুনরায় বৈদ্যুতিক থেকে রাসায়নিক সংকেতে রূপান্তরিত হবার ও লাফিয়ে লাফিয়ে স্মায়ুসন্ধি পার পৌনঃপুনিক ধারা অনুসরণ করতে হয়। লক্ষ লক্ষ বার এই ধাপ পালিত হয় সেকেন্ডের ভগ্নাংশে। নবজাত শিশুর মস্তিষ্কে পাঁচ সহস্র কোটি থেকে দশ সহস্র কোটি নিউরোন রয়েছে যা সমগ্র দেহ থেকে তথ্য সংগ্রহে উদগ্রীব হয়ে আছে।


মস্তিষ্কে তথ্য প্রেরণও সেখান থেকে তথ্য উদ্ধারের প্রক্রিয়া চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর হলেও প্রাথমিক স্তরে এতেও কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। বৈদ্যুতিক বর্তনীর মত সংযোগকারী তারগুলো অন্তরিত না থাকলে ভুল সংযোগ ঘটে এবং যথাস্থান সংকেত না পৌঁছে বৈদ্যুতিকপ্রবাহে গোলযোগ ঘটে। শিশুর জন্মের পর তার স্নায়ুতন্ত্রে কেন্দ্রাভিগ যে সব স্নায়ুসূত্র নিউরোন থেকে তথ্য বহন করে নিয়ে যায় তা যথার্থভাবে অন্তরিত থাকে না এবং যথেষ্ট পুরুভাবে তা গঠিত হবার মত সময় পায় না। এর ফলে মস্তিষ্কে যে তথ্য প্রেরিত হয় তা পথেই হারিয়ে যায় অথবা গোলযোগ ঘটার ফলে ত্রুটিপূর্ণ ভাবে পৌঁছে। যেমন, শিশু তার মায়ের মুখ স্পর্শ করবে এমন তথ্য মস্তিষ্ক থেকে যাবার কথা। কিন্তু কেন্দ্রাভিগ স্নায়ুসূত্র অন্তরিত না হওয়ায় শিশুর হাত হয়তো ভুল নির্দেশ লাভ করে মায়ের চোখে হাত লাগিয়ে দিল।
চলবে………..
 

 


ইমরান হাবিব রুমন, ইমেইল – [email protected]