চীনের মরুদ্যান, বেঙ্গল ডেজার্ট!

কেশব অধিকারী

 

দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আবার বসলাম লিখতে! সকালে অনলাইন পত্রিকা দেখতে গিয়ে জনকন্ঠের(১১ জুন, ২০০৯) একটা রিপোর্টে চোখ আটকে গেলো। তা হলো আমাদের যমুনার উজানে চীন এবার তাদের ইয়ারলুং সাংপো নদীতে বাঁধ নির্মান করে ৪০,০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে! এটি সফল হলে এটিই হবে বিশ্বের সর্ব্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প!তারা আনবিক শক্তি ব্যবহার করে নদীর গতিপথ বদলে দিয়ে মরুকে করবে মরুদ্যান! বিশ্বকে দেখাবে সার্কাস! এসব আগ্রাসী অহংবোধের সীমা থাকা দরকার! আসলে দরীদ্র হওয়ার অনেক জ্বালা! হয়তো মনের দারীদ্রতা আমাদের নেই, কিন্তু বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলো কি আমাদের ভালোমানুষী মনোভাবকে দুর্বলতা হিসেবে দেখছে? এও সত্যি যে, আমাদের হা হুতাশ ছাড়া বুঝি গত্যন্তর নেই! কৈলাসের জিমা ইয়াংজাং হিমবাহ থেকে সৃষ্টি হয়েছে সাংপো, সরাসরি কৈলাস থেকে মানস সরোবর হয়ে ভারতের অরুণাচলের উত্তরে চীনের মাউন্ট নামচাগ বরোয়ার ঢালে এসে হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে অশ্বক্ষুরের মতো বেঁকে প্রবেশ করেছে ভারতের অরুণাচলে। সেখান হতে অসাম হয়ে ময়মনসিংহের উত্তর প্রান্তসীমা দিয়ে ঢুকেছে বাংলাদেশে। ভারতীয় অংশে এর নাম ব্রক্ষ্মপুত্র আর বাংলাদেশে যমুনা। কৈলাস হতে যাত্রা করে হিমালয়ের উত্তর প্রান্তসীমা ঘেঁসে চীনের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেছে প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার তার পরে ভারতের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গপোসাগরে মিলেছে। পাড়ি জমিয়েছে আরোও ১৪০০ কিলোমিটার পথ। চীনের মতো একটি দেশের নেতৃবৃন্দের নিশ্চই জানা আছে যে, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রবাহমান নদ-নদীর যেকোন প্রবাহ প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে কিছু আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন আছে। ভারতের সাথে তাদের যেকোন প্রতিযোগীতাই থাকুকনা কেনো, আমরা সে প্রতিক্রিয়ার অশুভ প্রভাবের শিকার হতে চাই না। চীন সাংপো নদীর প্রবাহ পরিবর্তন করে তাদের গোবি মরুভূমিকে মরুদ্যানে পরিনত করবে আর আমার শ্যামল বাংলা হবে বেঙ্গল ডেজার্ট, ভাবা যায়?

 

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ঐতিহাসিক ভাষন দিয়েছেন সম্প্রতি। বর্তমান বিশ্বপরিস্থতিতে এই ভাষনটি বিশ্বমানবতার ঐক্যতানে এক কালজয়ী অভিপ্রায় হিসেবে স্বীকৃত হবে কোন সন্দেহ নেই। সেখানে যে তিনি বিশ্বমানবতার ঐক্য, শান্তি এবং অগ্রগতির প্রকৃয়ার কথা বলেছেন, বলেছেন নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসার কথা, বলেছেন সব ধরনের বিভেদ-বৈষম্য, বিতর্কিত ইস্যু গুলোকে পরিহার করে সমঝেতা এবং ঐক্য প্রচেষ্টায় সামিল হতে, বলেছেন বিশ্বব্যপী জীববৈচিত্র্যের ক্ষুন্নতা রোধে তরুন সমাজের ব্যপক সচেতনতার কথা, বলেছেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ব্যপক গবেষনা এবং গোটা বিশ্বকে এপ্রকৃয়ার সঙ্গে যুগপৎ সমপৃক্ত হয়ে এর অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার কথা। বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র সমুহের নেতৃবৃন্দের এহেনো দায়িত্ত্বজ্ঞানহীন তৎপরতায় কি করে তা সম্ভব বুঝে পাইনে।  

 

আমরাও বিশ্বাস করি আজকের এই ইউনিপোলার বিশ্বে বিশ্বায়নের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবের ফলে পারষ্পরিক সহযোগীতা এবং সহাবস্থানের বিকল্প নেই। ব্যপক শিল্পায়ন এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রকৃয়ার উপর অযাচিত কৃত্রিম নিয়ন্ত্রন আরোপ প্রকৃত পক্ষে আর্থসামাজিক ও পরিবেশ গত ভারসাম্যের উপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আমাদের অর্থনৈতিক জোড় কম থাকায় শিল্পায়ন সহ নানাবিধ ক্ষেত্রে প্রকৃতির প্রতি বৈরী আচড়নের সুযোগ যথেষ্ট পরিমানে কম। তথাপি এই পলিথিনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, চামড়া শিল্প, ডাইং,  বড় শিল্প-কারখানার রাসায়নিক বর্জের নিয়ন্ত্রনহীন প্রভাবএবং শহরের আবাসিক বর্জ আমাদের আভ্যন্তরীন নদী গুলোকে যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে নিয়ে গেছে তা বলাই বাহুল্য। ব্যপক জনসচেতনতা হয়ত অদূর ভবিষ্যতে এইসব অশুভ প্রভাব থেকে নদী গুলোকে মুক্তি দেবে। তবে বাংলাদেশকে তার প্রকৃতি, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র সহ মানুষ গুলোকে টিকে থাকতে হলে, এসব আধিপত্যবাদী উদ্যোগ, যেকরেই হোক প্রতিহত করতে হবেই। চীন এখনো চিন্তা ভাবনার পর্যায়ে রয়েছে, উদ্যোগ গ্রহনের আগেই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। একদিকে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে আমাদের টুটি চিপে ধরতে চাইছে, আর অন্যদিকে গলা লক্ষ্যকরে হাত বাড়াবার উপক্রম করেছে চীন! দেশে বিদেশে এখনি এব্যপারে জনমত গঠন জরুরী। প্রাগ্য-জনেরা, দেশে-বিদেশে যে যেখানেই থাকুন না কেন, একবার ভাবুন। আপনার ভবিষ্যত, দেশের এবং গোটা বিশ্বের জীব-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুন্ন হতে দেয়া কোন মতেই সমীচিন হবে না। আমি যতদূর জানি আমাদের ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র‌ হুমকির মুখে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের বনাঞ্চল বাস্তবিকই ধ্বংসের মুখে। লক্ষীপেঁচা, উদ্‌বিড়াল, বাঘডাসা, গুঁইসাপ, ঘড়িয়াল সহ কয়েক ধরনের চীল ইতোমধ্যেই প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। নদীর অজস্র প্রজাতির মাছের অধিকাংশই আজ আর সহজলভ্য নয়। আমাদের উত্তরাঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ জলের স্তর আশঙ্কা জনক হারে নেমেছে। শুকনো মৌসুমে উত্তর বঙ্গের বিস্তীর্ন এলাকায় গভীর নলকুপও সেচের জল সরবরাহে ইদানিং ব্যর্থ। এমতাবস্থায় এবাঁধটি নির্মিত হলে আমাদের উত্তরের সিলেট এবং ময়মনসিংহ সহ দেশের মধ্যাঞ্চলও আক্রান্ত হবে। ফসলী জমি গুলো পরিনত হবে উসর মরুতে। যার লক্ষন ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি আমাদের গাঙ্গেয় উপত্যকার সর্ব্বদক্ষিনের নিম্ন প্রান্তে তথা এককালের প্রাচুর্য্যের লীলাভূমি বরেন্দ্র অঞ্চলে। বহু যুগের সাধ্য-সাধনার পরে, রক্ত-গঙ্গায় ভেসে যখন বাঙ্গালী স্বাধিকারের আন্দোলনে বিজয়মাল্যে বিভূষিত হয়ে নিজস্ব আবাস ভূমি, এই বাংলাকে পেল। তখন আবারও আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত করে তোলা হয়েছে তাকে বার বার। তারপরেও বাঙ্গালী সামলিয়েছে নিজেকে, সৌম্যময়তায়, উদারতায়, স্বমহীমায় আজ যখন উঠে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে ব্যকুল তখন অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিশ্বের তাবৎ আধিপত্যবাদী শক্তি সমূহ একযোগে চরম নির্মমতায় তাকে বাস্তুচ্যুত করতে উঠেপরে লেগেছে! মনে হচ্ছে আজ আবার সময় এসেছে, এজাতির নতুন করে জেগে উঠবার। সমস্ত জড়তাকে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াবার! নতজানু পররাষ্ট্রনীতি নয়! শক্ত ভাবে এসব অশুভ অভিপ্রায়ের প্রতিকারের প্রস্তুতি নিন। গড়ে তুলুন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সহমত। এআমাদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ! জাগো বাহে, কোনঠে সবাই!