বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান ও এপিজেনেটিক্স
মানব প্রকৃতির জৈববিজ্ঞানীয় ভাবনা –২
প্রথম পর্বের পর …
মানুষ কি সত্যই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট‘ হয়ে পৃথিবীতে জন্মায়?
আমরা গত পর্বে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নামের নতুন শাখাটি সম্বন্ধে কিছুটা পরিচিত হয়েছিলাম। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নামের সাম্প্রতিক এই শাখাটি আমাদের কি বলতে চাচ্ছে? সাদা মাঠাভাবে বলতে চাচ্ছে এই যে, আমাদের মানসপটের বিনির্মাণে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার একটি ছাপ থাকবে, তা আমরা যে দেশের, যে সমাজের বা যে সংস্কৃতিরই অন্তর্ভূক্ত হই না কেন। ছাপ যে থাকে, তার প্রমাণ আমরা দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুতেই কিন্তু পাই। মিস্টিযুক্ত কিংবা চর্বিযুক্ত খাবার আমাদের শরীরের জন্য খারাপ, কিন্তু এটা জানার পরও আমরা এ ধরনের খাবারের প্রতি লালায়িত হই। সমাজ- সংস্কৃতি নির্বিষেশেই এটা ঘটতে দেখা যায়। কেন? বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, একটা সময় মানুষ জঙ্গলে থাকত, খুব কষ্ট করে খাবার দাবার সংগ্রহ করতে হত। শর্করা এবং স্নেহজাতীয় খাবার এখনকার মত এত সহজলভ্য ছিলো না। শরীরকে কর্মক্ষম রাখার প্রয়োজনেই এ ধরণের খাবারের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। তখন তো আর কারো জানার উপায় ছিলো না যে, হাজার খানেক বছর পর মানুষ নামের অদ্ভুত এই ‘আইলস্যা’ প্রজাতিটি ম্যাকডোনাল্ডসের বিগ-ম্যাক আর হার্শিজ হাতে নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে বসে ব্লগ আর চ্যাট করে অফুরন্ত অলস সময় পার করবে আর গায়ে গতরে হোদল কুৎকুতে হয়ে উঠবে। কাজেই খাবারের যে উপাদানগুলো একসময় ছিলো আদিম মানুষের জন্য শক্তি আহরণের নিয়ামক কিংবা ঠান্ডা থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ, আজকের যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে সেগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে উঠেছে তাদের জন্য মরণ-বিষ। কিন্তু এগুলো জেনেও আমরা আমাদের লোভকে সম্বরণ করতে প্রায়শঃই পারি না; পোলাও বিরিয়ানি কিংবা চকলেট বা আইসক্রিম দেখলেই হামলে পড়ি। আমাদের শরীরে আর মনে বিবর্তনের ছাপ থেকে যাবার কারণেই এটি ঘটে। এধরণের আরো উদাহরণ হাজির করা যায়। আমরা (কিংবা আমাদের পরিচিত অনেকেই) মাকড়শা, তেলাপোকা কিংবা টিকটিকি দেখলে আৎকে উঠি। কিন্তু বাস ট্রাক দেখে সেরকম ভয় পাই না। অথচ কে না জানে, প্রতি বছর তেলাপোকার আক্রমণে যত মানুষ না মারা যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মরে ট্রাকের তলায় পড়ে। অথচ ট্রাককে ভয় না পেয়ে আমরা ভয় পাই নিরীহ তেলাপোকাকে। এটাও কিন্তু বিবর্তনের কারণেই ঘটে। বনে –জঙ্গলে দীর্ঘদিন কাটানোর কারণে বিষধর কীটপতংগকে ভয় পাবার স্মৃতি আমরা নিজেদের অজান্তেই আমাদের জিনে বহন করি। সে হিসেবে, বাস ট্রাকের ব্যাপারগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত নতুন, তাই এগুলোকে ভয় পাবার কোন স্মৃতি আমরা এখনো আমাদের জিনে (এখনো) তৈরি করতে পারিনি। সেজন্যই বোধ হয় বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লিডা কসমিডস এবং জন টুবি আধুনিক মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন – ‘Our modern skull house a stone age of mind’।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান অনেক কিছু খুব পরিস্কার এবং বোধগম্যভাবে ব্যাখ্যা করলেও, এর অনেক উপসংহার এবং অনুসিদ্ধান্ত এতই বিপ্লবাত্মক (Radical) যে এটি অবগাহন করা সবার জন্য খুব সহজ হয়নি, এখনো হচ্ছে না। এর অনেক কারণ আছে। একটা বড় কারণ হতে পারে – আমাদের মধ্যকার জমে থাকা দীর্ঘদিনের সংস্কার। অধিকাংশ মানুষ মনে করে, শিশুরা জন্ম নেয় একটা স্বচ্ছ্ব স্লেটের মত, মানুষ যত বড় হতে থাকে – তার চারপাশের পরিবেশ ও পারিপার্শিকতার মাধ্যমে ঐ স্বচ্ছ্ব স্লেটে মানুষের স্বভাব ক্রমশঃ লিখিত হতে থাকে। অর্থাৎ, ভাল-মন্দ সবকিছুর জন্য দায়ী হচ্ছে একমাত্র পরিবেশ। খারাপ পরিবেশে থাকলে স্লেটে লেখা হবে হিংস্রতা কিংবা পাশবিকতার বীজ, আর ভাল পরিবেশ পেলে স্লেটও হয়ে উঠবে আলোকিত। ব্রিটিশ দার্শনিক লক (১৬৩২ -১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দ) এই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন। এখনো অনেকেই (বিশেষতঃ যাদের আধুনিক জেনেটিক্স কিংবা বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান পড়া হয়ে উঠেনি) এই মতবাদে বিশ্বাস করেন। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই ধারণাটি বোধগম্য কারণেই খুবই জনপ্রিয়। এই কিছুদিন আগেও ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার তার এক বক্তৃতায় বললেন –
‘একটি শিশু যখন ৬ বছর বয়সে প্রথম স্কুলে যেতে শুরু করে তার মন থাকে যেন শুন্য এক বাস্কেট। তারপর ধীরে ধীরে তাদের বাস্কেট ভর্তি হতে শুরু করে। ১৮ বছর বয়স হতে হতে তাদের শূন্য বাস্কেট প্রায় পুরোটাই ভর্তি হয়ে উঠে। এখন কথা হচ্ছে কাকে দিয়ে শিশুটির এই বাস্কেট পূর্ণ হবে? এটা কি ভাল একজন শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধু নাকি অসৎ মানুষজনদের দিয়ে?’
এই ব্ল্যাঙ্ক স্লেট তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানে খুবই জনপ্রিয় এবং বোধ্য কারনেই। সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা এমিল ডার্খেইম ১৮৯৫ সালেই বলেছিলেন যে, ‘সমাজবিজ্ঞানের প্রধান অনুকল্পই হল প্রতিটি মানুষকে ব্ল্যাঙ্ক স্লেট হিসেবে চিন্তা করতে হবে। মানুষ হচ্ছে ব্ল্যাঙ্ক স্লেট – অন হুইচ কালচার রাইটস’। এর পর থেকে ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ দর্শনটি সমাজবিজ্ঞানের জগতে স্বততঃসিদ্ধ হিসেবেই পরিগন্য হয় – ‘সব মানুষ আসলে জন্মগতভাবে সমান, খারাপ পরিবেশের কারণেই মানুষ মূলতঃ খারাপ হয়ে উঠে’।
কিন্তু এই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’-এর ধারণা কি আসলে মানবমনের প্রকৃত স্বরূপকে তুলে ধরে? এম.আই.টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের (বর্তমানে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের) অধ্যাপক অধ্যাপক স্টিভেন পিঙ্কার ২০০৩ সালে একটি বই লেখেন ‘The Blank Slate: The Modern Denial of Human Nature’ শিরোনামে। তিনি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে সমাজে গেঁথে যাওয়া এবং জনপ্রিয় এই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একে একধরণের ‘ডগমা’ হিসবে আখ্যায়িত করেন। যারা ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বইটি পড়েননি, তারা ইউটিউব থেকে অধ্যাপক পিঙ্কারের নীচের লেকচারটি শুনে দেখতে পারেন, বইটির সারমর্ম পেয়ে যাবেন –
পিঙ্কার দাবী করেন, আমাদের কানে যতই অস্বস্তিকর শোনাক না কেন, কোন শিশুই আসলে ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ হয়ে জন্ম নেয় না। বরং একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে,প্রতিটি শিশু জন্ম নেয় কিছু না কিছু জন্মগত বৈশিষ্ট্যকে পুঁজি করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ছাপ পরিণত অবস্থাতেও রাজত্ব করে অনেক ক্ষেত্রেই। শুধু মানুষ কেন – প্রানী জগতের দিকে দৃষ্টি দিলেও ব্যাপারটা খুব ভালমতই বোঝা যাবে। গুবরে পোকাকে ধরবার জন্য ইঁদুর যত তাড়াতাড়ি ছুটতে পারে, কবুতর তত তাড়াতাড়ি পারে না। বিড়াল যত ভালভাবে রাতে দেখতে পায়, মানুষ তা পায় না। এই বিষয়গুলো কোনভাবেই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্যাখ্যা করা যায় না একই প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যগুলোও। কেউবা শ্লথ, কেউবা ক্ষিপ্র, কেউবা বাঁচাল, কেউবা শান্ত, কেউবা অস্থির, কেউ বা রয়ে যায় খুব চুপচাপ। জিনগত পার্থক্যকে গোনায় না ধরলে করলে প্রকৃতির এত ধরণের প্রকরণকে কোন ভাবেই সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
১৯৮০র দশকে টম ইনসেল নামে এক বিজ্ঞানী প্রেইরি ভোলস এবং মোন্টেন ভোলস নামে দু’ প্রজাতির ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন প্রেইরি ভোলস নামের ইঁদুরগুলো নিজের মধ্যে একগামী সম্পর্ক গড়ে তুলে, যৌনসঙ্গির প্রতি আজীবন বিশ্বস্ত থাকে, বাচ্চা হবার পর তাদের পরিচর্যা করে বড় করে তুলতে অনেকটা সময় এবং শক্তি ব্যয় করে। আর মোন্টেন ভোলসগুলো স্বভাবে ঠিক উলটো। তারা স্বভাবত বহুগামী, এমনকি বাচ্চা জন্মানোর পর সামান্য সময়ের জন্য বাচ্চাদের পরিচর্যা করার পর আর এদের দিকে নজর দেয় না। টম ইনসেল প্রেইরি ভোলস এবং মোন্টেন ভোলস এর ব্রেন বিশ্লেষণ করে কোন পার্থক্যই পেলেন না, কেবল প্রেইরি ভোলস নামের ইঁদুরগুলোর ব্রেনে অক্সিটোসিন নামে এক ধরণের হরমোনের আধিক্য লক্ষ্য করলেন। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন মোন্টেন ভোলস ইঁদুরগুলোর ব্রেনে একেবারেই নগন্য। কেবল, বাচ্চা জন্মানোর পর সামান্য স্ত্রী মোন্টেন ভোলসের মস্তিস্কে এই হরমোনের আধিক্য সামান্য সময়ের জন্য বেড়ে যায়। টম ইনসেল দেখলেন সেই সামান্য সময়টাতেই স্ত্রী ইঁদুর আর তার বাচ্চার মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধনের উপস্থিতি থাকে। টম ইনসেল কৃত্রিমভাবে ইঁদুরদের ব্রেনে অক্সিটোসিন প্রবেশ করিয়ে তাদের স্বভাব এবং প্রকৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। এমনকি এই হরমোনের প্রভাবে মোন্টেন ভোলস ইঁদুরগুলো তাদের পছন্দের বহুগামী স্বভাব পরিবর্তন করে তার যৌনসঙ্গির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা শুরু করে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এ ধরণের আরো গবেষণা করে দেখেছেন, জিন ম্যানিপুলেশন করে নিম্ন স্তরের প্রাণীদের মধ্যে আগ্রাসন, নমনীয়তা, হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা বা শ্লথতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলির তারতম্য তারা ঘটাতে পারেন। অর্থাৎ, বংশানুর বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের কারণে প্রাণীদের স্বভাবেও পরিবর্তন আসে। এখন কথা হচ্ছে, মানুষও কিন্তু প্রকৃতিজগত এবং প্রাণীজগতের বাইরের কিছু নয়। অথচ, বংশাণুজনিত পার্থক্যের কারণে মানুষে মানুষে স্বভাবগত পার্থক্য হতে পারে – মানুষের ক্ষেত্রে এই রূঢ় সত্যটি মানতে অনেকেই আপত্তি করবেন।
বংশানুর বৈশিষ্ট্যের তারতম্য যদি মানুষের স্বভাবের পরিবর্তনের বলিষ্ট ব্যখ্যা হয়, তবে কাছাকাছি বা প্রায় একই বংশানুযুক্ত লোকজনের ক্ষেত্রে একই স্বভাবজনিত বৈশিষ্ট পাওয়া উচিত। স্টিভেন পিঙ্কাররা বলেন তাই পাওয়া যাচ্ছে। পিঙ্কার তার ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ বইয়ে অভিন্ন যমজদের (আইডেন্টিকাল টুইন) নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার বেশ কিছু মজার উদাহরণ হাজির করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অভিন্ন যমজদের একে অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ভিন্ন পরিবেশে বড় করা হলেও তাদের মধ্যে এক আশ্চর্য্জনক সাদৃশ্য থেকেই যায়, শুধু চেহারায় নয় – আচার, আচরণ, অভিরুচি, খাওয়া দাওয়া এমন কি ধর্ম কর্মের প্রতি আসক্তিতেও। ইউনিভার্সিটি অব মিনিসোটার গবেষকেরা একসময় পঞ্চাশ জোড়া অভিন্ন যমজদের নিয়ে গবেষণা করেন, যে যমজেরা জন্মের পর পরই কোন না কোন কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে ভিন্ন ধরণের পরিবেশে বড় হয়েছিলো। তাদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষকেরা লক্ষ্য করলেন, তারা আলাদা পরিবেশে বড় হলেও তার বিচ্ছিন্ন হওয়া সহোদরের সাথে আচার-আচরণে অদ্ভুত মিল থাকে। সবচেয়ে মজার হচ্ছে অভিন্ন যমজ সহোদর অস্কার এবং জ্যাকের উদাহরণটি। জন্মের পর পরই বিচ্ছিন্ন হয়ে অস্কার বড় হয়েছিলো চেকোশ্লাভাকিয়ার এক নাৎসী পরিবারে, আর জ্যাক বড় হয়েছিলো ত্রিনিদাদের ইহুদী পরিবারে। তারপরও তারা যখন চল্লিশ বছর পরে প্রথমবারের মত মিনিসোটায় একে অপরের সাথে দেখা করতে আসলেন, তখন দেখা গেলো তারা দুজনেই গাঢ় নীল রঙের শার্ট পড়ে উপস্থিত হয়েছেন, তাদের দু’জনের হাতের কব্জিতেই রাবারব্যান্ড লাগানো। দু’জনেই কফিতে বাটার টোস্ট ডুবিয়ে খেতে পছন্দ করতেন; তাদের দু’জনেই বাথরুম ব্যবহার করতে গিয়ে টয়লেট ব্যবহারের আগেই একবার করে ফ্ল্যাশ করে নিতেন, এমনকি দু’জনেরই একটি সহজাত মুদ্রাদোষ ছিলো – দু’জনেই এলিভেটরে উঠে হাঁচি দেয়ার ভঙ্গি করতেন, যাতে লিফটের অন্য সহযাত্রীরা আঁতকে উঠে দু’পাশ থেকে সরে যায়। থমাস বুচার্ড নামের আরেক গবেষকের গবেষনায় জিম স্প্রিঙ্গার এবং জিম লুইস নামের আরেকটি অভিন্ন যমজের চাঞ্চল্যকর মিল পাওয়া গিয়েছিলো যা মিডিয়ায় রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দেয়। জন্মের পর ভিন্ন পরিবেশে বড় হবার পরও জিম-যমজদ্বয় যখন একত্রিত হল, দেখা গেল – তাদের চেহারা এবং গলার স্বরে কোন পার্থক্যই করা যাচ্ছে না। একই রকম বাচনভঙ্গি, একই রকম চাহনি, একই রকম অবসাদগ্রস্থ চোখ। তাদের মেডিকেল-হিস্ট্রি থেকে জানা গেল, তারা দুজনেই উচ্চ রক্তচাপ, হেমোরইডস এবং মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন। তারা দু’জনেই সালীম সিগারেটের ভক্ত, দুজনেরই টেনশনে নখ কামড়ানোর অভ্যাস আছে এবং দুজনের জীবনের একই সময় ওজন বাড়া শুরু হয়েছিল। শুধু তাই নয় – তাদের দুজনের কুকুরের নাম ‘টয়’। তাদের দুজনের স্ত্রীদের নাম ‘বেটি’, এবং তাদের দুজনেরই আগে একবার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এবং এদের প্রাক্তন স্ত্রীদের নামও কাকতালীয় ভাবে এক – ‘লিন্ডা’। এখানেই শেষ নয় – দুজনের প্রথম সন্তানের নামও ছিলো একই – ‘জেমস এলেন’; যদিও নামের বানান ছিলো একটু ভিন্ন। আরেকটি ক্ষেত্রে দেখা গেল দুই যমজ মহিলা হাতে একই সংখ্যার আংটি পড়ে এসেছিলেন। তাদের একজন প্রথম ছেলের নাম রেখেছিলেন রিচার্ড এন্ড্রু, আর অপরজন রেখেছিলেন এন্ড্রু রিচার্ড। সংশয়বাদী দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে এসমস্ত মিলগুলোকে নিতান্তই ‘কাকতালীয়’ কিংবা ‘অতিরঞ্জন’ ভাবার যথেষ্ট অবকাশ থাকলেও মূল উপসংহার কিন্তু ফেলে দেয়ার মত নয় – আমরা আমাদের স্বভাব-চরিত্রের অনেক কিছুই হয়ত আসলে বংশানুর মাধ্যমে বহন করি এবং দেখা গেছে অভিন্ন যমজদের ক্ষেত্রে এই উপরের ‘কাকতালীয়’ মিলগুলো অসদ যমজদের থেকে সবসময়ই বেশি থাকে। শুধু মিনিসোটার যমজ গবেষণা নয়; ভার্জিনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, হল্যান্ড, সুইডেন এবং ব্রিটেনের গবেষকেরাও তাদের গবেষণা থেকে একই ধরণের ফল পেয়েছেন। এ ধরনের বেশকিছু গবেষণার ফলাফল লিপিবদ্ধ আছে উইলিয়াম ক্লার্ক এবং মাইকেল গ্রুন্সটেইনের ‘Are We Hardwired?: The Role of Genes in Human Behavior’ নামের বইটিতে। লেখকদ্বয় বলেছেন –
‘For nearly all measures personality, heritability is high in western society: identical twins raised apart are much more similar than the fraternal twins raised apart.’।
একটা মজার কার্টুন – জন্মের পর পরই পৃথক হয়ে যাওয়া দুই যমজের হঠাৎ দেখা! (কার্টুনিস্ট – চার্লস এডামস)
কার্টুনটি স্টিভেন পিঙ্কারের ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ বইটি থেকে নেওয়া।
সাইকোপ্যাথ এবং সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোও আমাদের জন্য অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে পুরোমাত্রায়। আমি যখন এ লেখাটি লিখতে শুরু করেছি, তখন আমেরিকান মিডিয়া ‘ক্রেগলিস্ট কিলার’ খ্যাত ফিলিপ মার্ডফকে নিয়ে রীতিমত তোলপার। ফিলিপ মার্ডফ বস্টন মেডিকেলেরর ছাত্র। পড়াশোনায় ভাল। চুপচাপ শান্ত বলেই পরিচিতি ছিলো তার। একজন গার্লফ্রেন্ডও ছিলো তার। সামনেই বিয়ে করার কথা ছিলো তাদের। ফিলিপ আর তার ভাবীবধুর ছবি সমন্বিত ওয়েবসাইটও সে বানিয়ে রেখেছিলো। কে জানত যে, এই গোবেচোরা ধরণের নিরীহ রোমান্টিক মানুষটিই রাতের বেলা কম্পিউটারে বসে বসে ক্রেগলিস্ট থেকে মেয়েদের খুঁজে নিয়ে হত্যা করত! পুলিশের হাতে যখন একদিন ফিলিপ ধরা পড়লো, সহপাঠিরা তো অবাক। এমন গোবেচরা ছেলেটির মধ্যে এমন দানব লুকিয়ে ছিল? গার্লফ্রেন্ডটি তখনো ডিনায়ালে – ‘ফিলিপের তো মাছিটা মাওরতেও হাত কাঁপত, সে কি করে এত মানুষকে হত্যা করবে? পুলিশ নিশ্চয় ভুল লোককে ধরেছে’। আমেরিকায় প্রতি ২৫ জনে একজন মনোবিকারগ্রন্থ সাইকোপ্যাথ আছে বলে মনে করা হয়। মনোবিজ্ঞানী মার্থা স্কাউট তার ‘The Sociopath Next Door’ বইয়ে অন্ততঃ তিনটি জার্নাল থেকে রেফারেন্স হাজির করে দেখিয়েছেন যে, আপনার প্রতিবশিদের মধ্যেই হয়ত লুকিয়ে আছে একজন মনোবিকারগ্রন্থ সাইকোপ্যাথ। তারা আমার আপনার মত একই রকম ‘ভাল পরিবেশে’ বাস করছে, দৈনন্দিন জীবন যাপন করছে কিন্তু আপনার আমার মত সচেতনতা জিনিসটাকে মাথায় ধারণ করে না। এই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন রবার্ট হেয়ার তার ‘Without Conscience: The Disturbing World of the Psychopaths Among Us’ বইয়ে। কোন নিয়ম, নীতি, ভালবাসা, দায়িত্ববোধ তাদের মধ্যে তৈরি হয় না। আসলে এসমস্ত ‘মানবিক’ বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে একজন সাইকোপ্যাথের কাজকে ব্যাখ্যার চেষ্টাই হবে বোকামি। অত্যন্ত স্বার্থপর ভাবে মনোবিকারগ্রন্থ সাইকোপ্যাথ তার মাথায় যেটা থাকে, সেটা করেই ছাড়ে। যখন কোন সাইকোপ্যাথের মাথায় ঢোকে কাউকে খুন করবে, সেটা সম্পন্ন করার আগ পর্যন্ত তার স্বস্তি হয় না। পিঙ্কার তার বইয়ে জ্যাক এবট্ নামক এক সাইকোপ্যাথের উদ্ধৃতি দিয়েছেন খুন করার আগের মানসিক অবস্থা তুলে ধরে–
‘তুমি টের পাবে যে তার জীবন-প্রদীপ তোমার হাতে ধরা ছুরির মধ্যে দিয়ে তির তির করে কাঁপছে। তুমি বুঝতে পারবে হত্যার জিঘাংসা তোমাকে ক্রমশঃ গ্রাস করে নিচ্ছে। তোমার শিকারকে নিয়ে একটু নিরালয়ে চলে যাবে যেখানে গিয়ে তুমি তাকে একেবারে শেষ করে দিতে পারো। … মাখনের মধ্যে ছুরি ঢুকানোর মতই সহজ একটা কাজ – কোন ধরনের বাধাই তুমি পাবে না। তাদের চোখে শেষ মুহূর্তে এক ধরণের অন্তিম কাতরতা দেখবে, যা তোমাকে আরো উদ্দীপ্ত করে তুলবে’।
আমার প্রবন্ধ যে শুরু করেছিলাম মন্টু মিয়াকে দিয়ে (প্রথম পর্ব দ্রঃ) – সেই মন্টু মিয়া হয়ত মনোবিকারগ্রন্থতার একটু ছোট স্কেলের উদাহরণ। বড় বড় উদাহরণগুলোর কথা আমরা সবাই কম বেশি জানি। জ্যাক দ্য রিপার, ‘বিটিকে কিলার’ ডেনিস রেডার,’গ্রীন রিভার কিলার’ গ্রে রিজ ওয়ে, ‘সন অব স্যাম’ ডেভিড বার্কোউইজ, ‘বুচার অব রুস্তভ’ আঁদ্রে চিকাতিলো, চার্লস এং, ডেরিক টড লি, জন ওয়েন গেসি প্রমুখ। কিন্তু সবচেয়ে অস্বস্তিকর যে বিষয়টি তুলে এনেছেন তার বইয়ে পিঙ্কার, সেটি হল – ‘‘মনোবিকারগ্রস্তদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাময় করা যায় না’’। তিনি বলেন,
Psychopaths, as far we know, cannot be ‘cured’. Indeed, the psychologists Marine Rice has shown that has shown that certain harebrain ideas for therapy, such as boosting their self esteem and teaching them social skills, can even make more dangerous.
সমাজের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ শেখানোর মাধ্যমে যে মনোবিকারগ্রস্থ মানুষদের স্বভাব অনেক সময়ই পরিবর্তন করা যায়না সেই সত্যটি (?) পিঙ্কার তার বইয়ে তুলে ধরেছেন উপরে উল্লিখিত জ্যাক এবট্-এর একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করে। ঘটনাটি হল, পুলিতজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক নর্মান মেইলার জ্যাক এবট্ -এর কিছু চিঠি পড়ে এতই মুগ্ধ হন যে, যে তিনি নর্মান মেইলারকে জামিনে মুক্তি পেতে সাহায্য করেন। নর্মান মেইলার সে সময় গ্যারি গিলমোর নামের আরেক অপরাধীকে নিয়ে একটি বই লেখার কাজ করছিলেন। জ্যাক এবট্ তার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখককে সহায়তা করার প্রস্তাব দেন। জ্যাক এবট্ -এর রচনা এবং চিন্তা ভাবনা নর্মান মেইলারকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে, তিনি এবট্কে ‘প্রথাবিরুদ্ধ বুদ্ধিজীবী এবং সম্ভাবনাময় লেখক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন; শুধু তাই নয়, তাঁকে লেখা এবটের চিঠিগুলো সংকলিত করে তিনি ১৯৮০ সালে এবটের একটি বই প্রকাশ করতে সহায়তাও করেন, বইটির নাম ছিলো –‘In the belly of the beast’ । বইটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। নর্মান মেইলারের তদ্বিরে ছাড়া পাওয়ার পর এবট্ বেশ নামীদামী মহলে অনেক বিদগ্ধ লোকজনের সাথে নৈশভোজেও আমন্ত্রিত হতেন। অথচ এর মধ্যেই – ছ’ সপ্তাহের মাথায় নিজের সাইকোপ্যাথেটিক চরিত্রের পুনঃপ্রকাশ ঘটালেন এবট এক রেস্তোরার বেয়ারাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। ভাগ্যের কি পরিহাস – এবট যেদিন দ্বিতীয় হত্যাকান্ড সম্পন্ন করে পুলিশের খাতায় নাম লেখাচ্ছিলেন, ঠিক তার পরদিনই তার বই –‘In the belly of the beast’ -এর চমৎকার একটি রিভিউ বেরিয়েছিলো নিউইয়র্ক টাইমস-এ । পত্রিকার সম্পাদক খুব আগ্রহ ভরেই সেটি ছাপিয়েছিলেন এবটের আগের দিনের হত্যাকান্ড সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না থেকে।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। আমরা খুব স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেই মনোবিকারগ্রস্থ কিংবা শিশুনিপীড়নকারীরা নিজেদের শিশুবয়সে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলো, সেজন্যই বোধহয় তারা বড় হয়ে অন্য মানুষদের মেরে কিংবা শিশুদের ধর্ষণ করে নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে। এ ব্যাপারটি অনেকাংশেই ঠিক নয়। আমি যে বিটিকে খুনি ডেনিস রেডার,’গ্রীন রিভার কিলার’ গ্রে রিজ ওইয়ের উদাহরণ দিয়েছি, তারা কেউই শিশু বয়সে নিপীড়নের শিকার হয়নি। ডেনিস রেডার ছোটবেলায় খুব ভাল পরিবেশেই বড় হয়েছিলেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন, স্ত্রী, এবং দু ছেলে নিয়ে আর দশটা সাধারণ পরিবারের মতই জীবন যাপন করতেন। পাঠকেরা বিটিকে সিরিয়াল কিলার ডেনিস রেডারের উপর একটা ডকুমেন্টরী ইউটিউব থেকে দেখে নিতে পারেন –
http://www.youtube.com/watch?v=OZ7BwKOA_7Q
অন্যান্য পর্বগুলো এখানে –
পর্ব -২ | পর্ব-৩ | পর্ব -৪ | পর্ব -৫
জোন রজার্স তাঁর ‘Sex: A Natural History’ বইটিতে লিখেছেন যে বেশীর ভাগ শিশু যৌন নিপীড়নকারীদের নিজেদের জীবনে শিশু নিপীড়নের কোন ইতিহাস নেই বলেই প্রমাণ মেলে। বংশাণুবিজ্ঞানী ফ্রেড বার্লিনের উদ্ধৃতি দিয়ে রজার্স তার বইয়ে বলেছেন যে, ‘ বিকৃত যৌন আচরণ শেখান নয়, এটা জৈবিকভাবেই অঙ্কুরিত’। অবশ্য তিনি এটাও বলতে ভুলেননি যে, সমাজকে রক্ষা করার জন্যই অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি দেয়া হয়, কিন্তু একই সাথে ঐ আচরণকে অর্থাৎ এ ধরণের প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টাও আমাদের চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। স্টিভেন পিঙ্কারও তাঁর বইয়ের ৩১১ পৃষ্ঠায় বলেন যে কানাডীয়রা আমেরিকানদের মত একই টিভি শো দেখে কিন্তু কানাডায় অপরাধজনিত হত্যার হার আমেরিকার ১/৪ ভাগ মাত্র। তার মানে সহিংস টিভি শো দেখে দেখে আমেরিকানরা সহিংস হয়ে উঠেছে – এই সনাতন ধারণা ঠিক নয়। আমাদের দেশে আমরা প্রায়ই বলি ‘হিন্দি ছবি দেখতে দেখতে পোলাটা বখে গেছে’ কিংবা বলি ‘ছোটবেলায় বাবা মা পিস্তল জাতীয় খেলনা কিনে দেয়াতেই আজকে পোলা মাস্তানি করে বেড়াচ্ছে’। কিন্তু এ ধরণের ‘বিশ্লেষণ’ আসলে কতটুকু বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে তুলে ধরে? সত্যি বলতে কি – ‘জেনেটিক ডিটারমিনিজম’ ঠেকাতে আমরা নিজের অজান্তেই ‘কালচারাল ডিটারমিনিজমের’ আশ্রয় নিয়ে নেই। খুন খারাবির পেছনে জেনেটিক কোন প্রভাব থাকতে পারে, এটা অস্বীকার করে আমরা দোষারোপ করি ছোটবেলার খেলনাকে। কিংবা ধর্ষণের পেছনে পর্ণগ্রাফিকে। কিন্তু এই মনোভাবও যে আসলে উন্নত কোন কিছু নয় তা ম্যাট রীডলী তার ‘এজাইল জিন’ বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – ‘Cultural determinism can be as cruel as genetic determinism’। একই কথা বলেছেন নারীবাদী ডারউইনিস্ট হেলেনা ক্রনিন তার ‘Getting Human Nature Right’ প্রবন্ধে একটু অন্যভাবে- ‘কেউ যদি বংশানু নির্ণয়বাদকে ভয় পায়, তবে তার একই কারণে পরিবেশ নির্নয়বাদকেও ভয় পাওয়া উচিত’। পিঙ্কারও তার বইয়ে সহিংসতা নিয়ে আমাদের সনাতন ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেন, এ সমস্ত শিশুরা যুদ্ধ বা সহিংস খেলনার সাথে পরিচিত হবার অনেক আগেই সহিংস প্রবণতার লক্ষণ দেখায়।
পাঠকদের মনে হয়ত চিন্তা আঁকিবুকি করতে শুরু করেছে এই ভেবে যে, এবটের মত উদাহরণগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তো আমাদের কপালে ঘোর খারাবি আছে। সব কিছু যদি ‘জিন’ই নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে তবে তো তা আমাদের ‘জেনেটিক ডিটারমিনেজম’ বা বংশানু নির্ণয়বাদের দিকে ঠেলে দেবে। চিন্তা করে দেখুন – সব কিছু যদি জিনেই লেখা থাকে তাহলে আর আমাদের চেষ্টা করেই বা কি লাভ? ‘জিনেই লেখা আছে ছেলে বড় হয়ে সিরিয়াল কিলার হবে’, আর ‘মনোবিকারগ্রস্থ মানুষদের স্বভাব পরিবর্তন করা যায়না’ – তা তো উপরেই দেখলাম। এই আপ্তবাক্যদ্বয় মেনে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে ধর্মবাদী আর ভাগ্যবাদীদের সাথে পার্থক্য থাকল কোথায়?
না রসিকতা করছি না একেবারেই। আমার এই কথাকে হাল্কা কথা ভেবে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে কিন্তু ভুল হবে। আমি হাল্কাভাবে ভাগ্যের কথা বললেও জেনেটিক্সের এই সমস্ত নতুন দিক বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই একদল ‘বিশেষজ্ঞ’ মানুষের আচার ব্যবহার, আনন্দ, হাসি কান্না, দুঃখ যাবতীয় সবকিছুকেই ‘জিনের’ মধ্যে খুঁজে পাওয়া শুরু করে দিলেন। এক দিকে রইলো ব্ল্যাঙ্ক স্লেট ওয়ালারা – যারা সবকিছু পরিবেশ বদল করেই সমাধান করে ফেলতে চান, আর আর অন্যদিকে তৈরি হল আরেক চরমপন্থি ‘জেনেটিক ডিটারমিনিস্ট’-এর দল – যারা পরিবেশ অস্বীকার করে সব কিছু বংশানু দিয়েই ব্যাখ্যা করে ফেলেন। এই গ্রুপের একদল আবার আরো এক কাঠি সরেস হয়ে ‘জিন কেন্দ্রক ভাগ্যবাদ’ কিংবা ‘বংশানু নির্ণয়বাদ’ প্রীচ করা শুরু করে দিলেন। যেমন, জিনোম প্রজেক্ট শেষ হবার পর পরই যুগল-সর্পিলের আবিষ্কারক অধ্যাপক জেমস ওয়াটসন বলা শুরু করলেন –
‘আগে মানুষ ভাবত আকাশের তারায় বুঝি ভাগ্য লেখা আছে। এখন মানুষ বুঝবে, ভাগ্য তারায় লেখা নেই, তার ভাগ্য লেখা রয়েছে জিনে’!
কিন্তু সত্যই কি তাই? ব্যাপারটা কি এতই সরল? ওয়াটসনের কথা মত মানুষের সমস্ত ভাগ্য কি তাহলে জিনেই লেখা আছে?
এপিজেনেটিক্স এবং নিউরোপ্লাস্টিসিটির শিক্ষা
না এতটা নৈরাশ্যবাদী হবার কোন কারণ নেই। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বংশানুগুলো আমাদের মানসপটের বিনির্মাণ করলেও সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লোহার দরাজের মত অনড় নয়, বরং অনেকক্ষেত্রেই কাদামাটির মতই নরম। পরিবেশের প্রভাবে এদের সক্রিয়করণ (activation) বা নিষ্ক্রিয়করণ (deactivation) ঘটানো যায় – অনেকটা বিদ্যুতের বাতির সুইচ অন অফ-এর মতই। যে বংশানুগুলোকে কয়েক বছর আগেও মনে করা হত একদমই অনমনীয়, মনে করা হত বংশানুর গঠনের সিংহভাগই ভ্রূণে থাকা অবস্থায় তৈরী হয়ে যায়, ভাবা হত পরবর্তীকালের পরিবেশে এদের রদবদল হয় সামান্যই, আধুনিক ‘এপিজেনেটিক্স’এর গবেষণা হতে পাওয়া ফলাফল এর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে বলেই এখন মনে করা হচ্ছে। জীববিজ্ঞানের এই নতুন শাখাটি থেকে আমরা ক্রমশঃ জানতে পারছি পরিবেশ থেকে সংকেত নিয়ে দেহ কিভাবে তার অভ্যন্তরস্থ জিনের প্রকাশভঙ্গিকে (genetic expression) বদলে ফেলে। এজন্যই অনেক বিজ্ঞানী এদের চিহ্নিত করেন ‘নমনীয় জিনোম’ (Malleable Genome) হিসেবে, কেউ বা নাম দিয়েছেন ‘এজাইল জিন’। সায়েন্টিফিক মাইন্ডের ‘Determining Nature vs. Nurture : Molecular evidence is finally emerging to inform the long-standing debate’ (2006) প্রবন্ধে আধুনিক ‘এপিজেনেটিক্স’এর বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ডঃ ডাওসন চার্চ তার সাম্প্রতিক ‘The Genie in Your Genes’ বইয়ে পরিস্কার করেই বলেছেন –
‘Science is discovering that while we may have fixed set of genes in Chromosomes, which of those Genes is active has great deal to do which our subjective experiences, and how we process them’।
পিঙ্কারের উদাহরণে আরেকটিবার ফেরত যাই। সাইকোপ্যাথ জ্যাক এবটের অনমনীয় মনোভাবের যে উদাহরণ পিঙ্কার তার বইয়ে হাজির করেছেন তা হয়ত অত্যধিক ‘চরম মাত্রার’ উদাহরণ। আমাদের চারপাশের উদাহরণগুলো এমনতর চরম সীমায় অবস্থান করে না তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবেশ পরিবর্তন করে করে কিংবা কড়া সামাজিক নিয়ম নীতি প্রয়োগ করে মানুষের ব্যবহার যে পরিবর্তন করা যায়, তা কিন্তু পরীক্ষিত সত্য। আমার জীবন থেকেই একটা উদাহরণ হাজির করি-
প্রথম আমেরিকায় আসার পর নতুন নতুন গাড়ি চালানো শুরু করেছি। প্রায় দু’বছর বড় ধরণের কোন এক্সিডেন্ট ছাড়া সময় পার করে দেবার পর সাহস গেল অতিমাত্রায় বেড়ে। হাইওয়ে ছেড়ে বাসার উপরের ছোট্ট রাস্তায় ঢুকতে হলে যে একটু গতি কমিয়ে ঢুকতে হবে – তা মাথায়ই থাকতো না। যে রাস্তায় চলাচলের গতিসীমা সর্বোচ্চ ৩৫, সে রাস্তায় আমি ঢুকতাম প্রায় ৫০ মাইল বেগে। ফলে যা হবার তাই হল, এক বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পুলিশের গাড়ীর খপ্পরে পড়ে গেলাম। ব্যাস জড়িমানা গুনতে হল। দিন কয়েক খুব সাবধানে গাড়ি চালালাম। তারপর ক’দিন বাদেই আবার যেই কি সেই। একদিন সকালে উঠে দেখলাম ঘড়িতে বাজে সাড়ে আটটা। ঠিক নয়টায় অফিসে একটা জরুরী মিটিং আছে। গাড়ি বের করে দেখলাম তেল নেই। তেল নিতে গিয়ে আরো মিনিট দশেক নষ্ট হল। এবারে বুঝলাম মিটিং আর ধরা যাবে না। পেট্রল পাম্প থেকে গাড়ী বের করে সেই রাস্তাটায় উঠে যেই না এক্সিলেটরে পা রেখে মেরেছি এক ধুন্ধুমার টান – অমনি পাশ থেকে পুলিশ বাবাজীর অভ্যুদয়। আবারো জড়িমানা। এক মাসের ব্যবধানে একই রাস্তার উপরে দু’দুবার টিকেট পাওয়ার পর বোধ হয় চৈতন্য ফিরলো। ফিরবে নাই বা কেন – এমন টিকেট আর বার দুয়েক পেলেই আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটাই চলে যাবে। এখন হাইওয়ে থেকে রাস্তায় উঠলেই দেখি যতই আনমনা থাকি না কেন, স্পীডোমিটারের কাঁটা কখনই ত্রিশ অতিক্রম করে না। শাস্তির ভয়ে কিংবা কঠোর নিয়ম নীতি আরপের ফলে যে মানুষ তার বহুদিনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে এটাই তো একটা ভাল উদাহরণ।
আরেকটা উদাহরণ দেই। আমার পরিচিত এক বাংলাদেশী ভদ্রলোক (সঙ্গত কারণেই নামটি উল্লেখ করছিনা) বাংলাদেশ থেকে বিয়ে করে বউ নিয়ে আমেরিকায় এসেছেন। স্বভাবে একটু বদরাগী। রাগের সময় মাথা ঠিক থাকে না অনেক সময়ই। ঝগড়ার সময় বউকেও চড় থাপ্পর মেরে বসেন। বউও প্রথম প্রথম সহ্য করত, কিংবা হয়ত মানিয়ে নিতে চাইত। কাউকে বলতো না। সবাই ভাবতো সুখের সংসার বুঝি তাদের। আর বউকে নেহাৎ গোবেচারা পেয়ে স্বামীরও সাহস গেল বেড়ে। নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলছিল। একদিন বউ থাকতে না পেরে নাইন-ওয়ান-ওয়ানে সোজা কল করে দিলো। পুলিশ এসে স্বামী বাবাজিকে ধরে নিয়ে গেল। ভদ্রলোক বোধ হয় ভেবেছিলেন বউয়ের গায়ে একটু আধটু হাত তোলা আর এমন কি অপরাধ। দেশে তো সবাই করে! কিন্তু আমেরিকায় এগুলো আইন কানুন খুবই কড়া। তারপরও পুলিশ ভদ্রলকের কান্নাকাটি দেখে হয়ত মায়া করে গারদে না ঢুকিয়ে বকা ঝকা দিয়ে শেষপর্যন্ত ছেড়ে দিলেন। মনে করিয়ে দিলেন এরপর যদি গায়ে হাত তোলার অভিযোগ আসে , তাহলে তার কপালে বিপত্তি আছে। ভদ্রলোকও ছাড়া পেয়ে ভাবলেন ‘যাক! অল্পের উপর দিয়ে ফাঁরা কাটানো গেছে’। কিছু দিন ভাল থাকলেন, সংসার ধর্ম পালন করলেন। কিন্তু কথায় বলে বউ পেটানর স্বভাব নাকি মজ্জাগত, একবার যে বউয়ের গায়ে হাত তুলে, সে নাকি আবারো তুলে। ভদ্রলোকও আরেকদিন ঝগড়ার সময় বউয়ের গালে থাপ্পর মেরে বসলেন। আর বউও কল করলেন পুলিশে। এবারে ফলাফল হল ভ্য়াবহ। স্বামী প্রবরকে ধরে নিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হল সোজা গারদে। কেউ ছাড়াতে এলো না। এমনকি কাছের বন্ধু-বান্ধবেরাও নয়। দু’দিন গারদে থাকার পর শেষ পর্যন্ত স্বামীর কান্নাকাটিতে বোধ হয় বউয়ের দয়া হল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে হোক, আর সামাজিকতার চাপেই হোক শেষ পর্যন্ত তিনি স্বামীর উপর থেকে অভিযোগ তুলে নিয়ে স্বামীকে জেল থেকে বের করে আনলেন। তবে পুলিশের মন এত সহজে গললো না। একেবারে ঠিকুজি কুঠি সমস্ত বৃত্তান্ত ফাইলবন্দী করে রাখলেন। বলে রাখলেন, তাকে নজরবন্দী রাখা হচ্ছে। ভবিষ্যতে কোন ধরণের উল্টো-পাল্টা আচরণ দেখলেই সোজা ডিপোর্ট করে দেয়া হবে। তা বউ-পেটানো স্বভাব মজ্জাগত হোক আর শয্যাগতই হোক, পুলিশের ধাতানির উপর তো আর কারো কথা নাই, কারণ বাঘে ছুলে পনের ঘা, আর পুলিশে ছুলে নাকি আঠারো ঘা। আর তাছাড়া ডিপোর্ট হবার ভয় আসলেই বাঙ্গালীর বড় ভয়। সবকিছু মিলিয়ে ভদ্রলোক এমন চুপসানো চুপসালেন যে, তার সেই পরিচিত আগ্রাসী চরিত্রই গেল বদলে। কারো সামনে আর মুখ তুলে কথা বলেন না। বউয়ের উপর এখন রাগ করা তো দূরের কথা – বউকে তোয়াজ করা ছাড়া এক পা চলেন না। বাংলায় যাকে বলে ‘স্ত্রৈণ পুরুষ’ – সেটাতেই রূপ নিয়ে নিলেন পুরোমাত্রায়। এই ঘটনার পর বহুবছর কেটে গেছে। বউয়ের উপর নির্যাতনের আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। কাজেই জিন-ওয়ালাদের দাবী অনুযায়ী বউ পেটানোর অভ্যাস যদি কারো মজ্জাগত কিংবা বংশানুক্রমিক হয়েও থাকে, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় চাপ অর্থাৎ সর্বোপরি পরিবেশ বাধ্য করে তার প্রকাশভঙ্গিকে বদলে ফেলতে।
আমার গাড়ি চালানোর উদাহরণটা কিংবা উপরের ‘ভদ্রলোকের’ বউ-পেটানোর উদাহরনটি নেহাৎ খুব ছোট স্কেলে, বড় স্কেলে ঘটা উদাহরণগুলোতে একটু চোখ বুলাই। দেশে যখন খুন-খারাবী কিংবা রাহাজানি বেড়ে যায়, তখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইন শৃংখলা বাড়ানোর প্রচেষ্টা নেয়া হয়, কখনো বিশেষ আইন প্রবর্তন করা হয় বা ট্রাইবুনালের ব্যবস্থা নেয়া হয়। আশির দশকে যখন বাংলাদেশে এসিড নিক্ষেপের হার ভয়ানকভাবে বেড়ে গিয়েছিলো, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ আইন প্রবর্তন করে তা বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলো, জনসচেতনতা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিলো – যেন এধরনের অমানুষিকতা বন্ধ হয়। বছর খানেকের মধ্যে দেখা গেল এসিড নিক্ষেপের হার অনেক কমিয়ে আনা গিয়েছে। দেশের বাইরে এ ধরনের উদাহরণ আরো অনেক বেশি। বহু দাগী আসামী যারা তারুন্যে সহিংস কিংবা জনবিরোধী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত ছিলো, কিংবা পরিচিত ছিলো গ্যাংস্টার হিসেবে তাদের অনেককেই পরবর্তীতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে তাদের ব্যাবহার পরিবর্তন করেই। এদের অনেকেই তাদের অতীতের কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ করে বইও লিখেছেন, কেউ বা আজ এক্টিভিস্ট হিসবে কাজ করছেন; মানুষকে তাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিতে অনুপ্রাণিত করেছেন। দাবী-দাওয়া পূরণ করে ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের কারখানায় ফিরিয়ে নেওয়া, সারের দাম কমিয়ে কৃষকদের শান্ত করার উদাহরণ আমরা প্রতিদিনের পত্রিকাতেই পড়ি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কার্ফু জারি করে উন্মত্ত জনতাকে স্বাভাবিক আর শৃঙ্খলিত জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় তা আমরা বহুক্ষেত্রেই দেখেছি।
তাই জিন আমাদের মানসিক কাঠামোর বীজ বপন করলেও কখনোই আমাদের গন্তব্য নির্ধারণ করে না। পরিবেশের একটা প্রভাব থেকেই যায়। চাকরির টেনশন, স্ট্রেসফুল জীবন যাপনের প্রভাব শরীরে যে পড়ে সেটা পরীক্ষিত সত্য। ধূমপান, অত্যধিক মদ্যপান, ড্রাগ সেবনের প্রভাব শরীরে আছে বলেই ডাক্তাররা সেগুলো থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে পরামর্শ দেন। সেজন্যই একই ধরনের জিন শরীরে বহন করার পরও দেখা যায়, অভিন্ন যমজদের একজন দিব্যি সুস্থ সবল রয়েছে, অন্যজন বেহিসেবী জীবন যাপনে শরীরকে একেবারে নষ্ট করে ফেলেছে। ২০০৬ সালের আগাস্ট মাসে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘Live Long? Die Young? Answer Isn’t Just in Genes’ প্রবন্ধে জিনা কোলাটা দুই যমজ বোনের উদাহরণ হাজির করে দেখিয়েছেন এক বোন ৯২ বছর বয়সেও দিব্যি সুস্থ সবল এবং রোগমুক্ত জীবনযাপন করছে, অথচ অন্য যমজ বোনটির অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই ‘কেরোসিন’! সম্প্রতি রোগাক্রান্ত বোনটির ‘হিপ রিপ্লেসমেন্ট’ করতে হয়েছে, ‘ডিজেনেরেটিভ ডিসঅর্ডারে’ দৃষ্টিশক্তি প্রায় পুরোটাই চলে গেছে। দেহের অস্থিক্ষয়ের পরিমাণও উল্লেখ করার মতই। আসলে জীবন-যাপন এবং অভ্যাসের প্রভাব যে দেহের উপর পড়ে তা অস্বীকার করা উপায় নেই। সে জন্যই চিকিৎসক অধ্যাপক মাইকেল রেবিনফ বলেন,
‘অভিন্ন যমজেরা একই ধরনের জিন বিনিময় করলেও সেই জিনগুলো দেহে একই ধরনের রোগের প্রকাশ অনেকসময়ই ঘটায় না, যদিও সাধারণভাবে ব্যাপারটিকে খুবই জেনেটিক বলে মনে করা হয় ।’
জোসেফাইন তেজাউরো এবং তার জমজ বোন – জেনেটিক প্রকৃতি এক হওয়া সত্ত্বেও তাদের দৈহিক অবস্থা একই রকম নয় ( নিউইয়র্ক টাইমস, অগাস্ট ২০০৬)।
আরেকটি চাঞ্চল্যকর ফলাফল পাওয়া গেছে সম্প্রতি অধ্যাপক র্যান্ডি জার্টেল এর ইদুর নিয়ে গবেষনা থেকে। তিনি দেখেছেন, Agouti নামের যে জিনটি মানুষের ওবিসিডি এবং টাইপ২ ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় সেটি এক ধরণের ইঁদুরের মধ্যেও প্রবলভাবে দৃশ্যমান। হলুদ বর্ণের এই এগুটি ইঁদুর জন্মের পরপরই রাক্ষসের মত কেবল খেয়েই চলে। এবং এদের অধিকাংশই মানুষের মত ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় এবং খুব তাড়াতাড়ি মারা যায়। এমনকি তাদের বাচ্চা জন্ম নিলেও তারা এ সমস্ত রোগের ঝুঁকি নিয়েই জন্মায়। অধ্যাপক জার্টেল কিছু ইঁদুরকে আলাদা করে ল্যাবের কাঁচের জারে রেখে তাদের খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ঘটালেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেখলেন ইঁদুরদের জেনেটিক প্রকাশভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে, এবং বাচ্চা যা জন্ম নিচ্ছে তা অধিকাংশই রোগের ঝুঁকিমুক্ত। এমনকি সদ্য জন্মানো বাচ্চার গায়ের রঙেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পেলেন গবেষকেরা। আনবিক স্তরে জেনেটিক কোডের কোন ধরণের পরিবর্তন না করে শুধু খাদ্যাভাস এবং পরিবেশ বদলে দিয়ে দেহজ বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের এক অনন্য নজির পেলেন তারা। তারা বুঝলেন মানুষের ক্ষেত্রে জেনেটিকভাবে হৃদরোগ কিংবা ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি নিয়ে আমাদের অনেকেই জন্মানর পরও ডাক্তারদের কথা শুনে কম শর্করা আর চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস করে, নিয়মিত ব্যায়াম করে, ধূমপানমুক্ত জীবন যাপন করে কিভাবে আমরা এ সমস্ত রোগের ঝুঁকি কমিয়ে নিতে পারি।
কেবল মা ইঁদুরের খাদ্যাভাস পরিবর্তন করে অধ্যাপক জার্টেল দেখলেন ইঁদুরটি যে বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে তার দৈহিক বৈশিষ্ট্য অনেকটাই আলাদা (ডিস্কভার, নভেম্বব, ২০০৬)।
এখন কথা হচ্ছে, পরিবেশ বদলে দিয়ে দেহজ বৈশিষ্ট্য যদি পরিবর্তন করা যায় তা না হয় দেখলাম, কিন্তু পরিবেশ বদলে দিয়ে একইভাবে মানসিক প্রকাশভঙ্গিকেও কি বদলানো সম্ভব? বিজ্ঞানীরা বলেন অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব। মোজে সিজফ এবং মাইকেল মেনি – এ দুজন বিজ্ঞানীও জার্টেলের মতই ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তারা দেখলেন একধরণের ইঁদুর আছে যাদের মা ইঁদুরেরা তাদের বাচ্চাদের জন্য জন্য কোন ধরণের যত্ন-আত্তি করে না। মাদের আরেক দল আছে যারা আবার বাচ্চা জন্মানোর পর থেকেই জিব দিয়ে গা চেটে আর অতিরিক্ত আদর যত্ন করে বাচ্চাদের বড় করে। দেখা গেছে যে বাচ্চাগুলোর আদর যত্ন নেয়া হয় তারা অনেক সাহসী, সামাজিকভাবে বন্ধুভাবাপন্ন আর শান্ত হয়ে বেড়ে উঠে। আর মায়ের অবলায় থাকা বাচ্চারা বেড়ে উঠে অস্থির আর ভীতু স্বভাবের হয়ে। তাদের দু দলের ব্রেনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন বিজ্ঞানীরা। আদর পাওয়া বাচ্চাদের মস্তিস্কের হিপোক্যাম্পাস নামের প্রত্যঙ্গটি থাকে অনেক বিবর্ধিত, আর তাদের স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের (cortisol) উপস্থিতি অনেক কম পাওয়া গেল। আর অবহেলায় বড় হওয়া বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই হরমোন পাওয়া গেল অনেক বেশি। মানুষের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যারা খুব স্ট্রেস্ফুল জীবন যাপন করে থাকে, তাদের দেহে কর্টিসলের উপস্থিতি থাকে মাত্রাতিরিক্ত বেশি। তাদের হৃদরোগের ঝুঁকিও থাকে অনেক প্রবল। ডঃ সজফ এক অদ্ভুত কাজ করলেন। তিনি ওই ভীতু ইঁদুর দলের ব্রেনে এমন এক ধরণের এনজাইম (এসিটাইল গ্রুপ) প্রবেশ করালেন যা কর্টিসলের উৎপাদনকে বাধা দেয়। দেখা গেল ইঁদুরদের স্বভাবে পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন অনেক সাহসী হয়ে উঠেছে। আবার একইভাবে আদরে বড় হওয়া সাহসী ইঁদুরের দল থেকে ইঁদুর নিয়ে তাদের মাথায় মিথাইল গ্রুপ প্রবেশ করিয়ে ভীতু আর অস্থির বানিয়ে দিলেন তারা। এদের গবেষণাকে ফিচার করে সম্প্রতি একটি নিবন্ধ লেখা হয়েছে জনপ্রিয় বিজ্ঞান পত্রিকা ডিস্কভার-এ। প্রবন্ধের শিরোনাম – DNA Is Not Destiny : The new science of epigenetics rewrites the rules of disease, heredity, and identity।
ইঁদুরের ক্ষেত্রে উপরের উদাহরণে আমরা দেখলাম, যে সব বাচ্চাকে আদর যত্ন নেয়া হয়েছে তারা অনেক সাহসী, সামাজিকভাবে বন্ধুভাবাপন্ন আর শান্ত হয়ে বেড়ে উঠেছে। তারা থাকে অন্যদের প্রতি অনেক সংবেদনশীল। আর মা বাবার আদর যত্ন না পেয়ে বড় হওয়া বাচ্চাগুলো হয়ে উঠে অস্থির, ভীতু এবং অসামাজিক। মানুষের ক্ষেত্রেও কি এটা ঘটা সম্ভব নয়? যে বাচ্চারা মা বাবার আদর যত্ন না পেয়ে অবহেলায় বড় হয় তাদের মধ্য থেকেই একটা অংশ হয়ত বড় হয়ে অসামাজিক কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়ে? ব্যাপারটা সরলীকরাণ মনে হলেও এটা ঘটা সম্ভব খুবই সম্ভব। সেজন্যই বোধ হয় প্রতিটি মা বা শিশুকে একটা ভাল পরিবেশ দিয়ে আদর যত্ন করে বড় করতে চান। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এরিক নেস্টলার দীর্ঘদিন ধরে বিষন্নতায় ভোগা রোগীদের মাথার ভিতরে হিপোক্যাম্পাস পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে, তাদের হিপোক্যাম্পাসের আকার এবং আয়তন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক সঙ্কীর্ণ থাকে। শুধু তাই নয়, তাদের হিপোক্যাম্পাসের মধ্যকার একধরণের প্রোটিনে (হিস্টোন) মিথাইল গ্রুপের অস্তিত্ব আবিস্কার করেছেন (অনেকটা ওই ভীতু ইঁদুর দলের মতই)। বিজ্ঞানীরা এখন জানেন কিভাবে মানুষের বিষন্নতা সারাতে হয়। তারা ওষুধের মাধ্যমে এসিটাইল গ্রুপকে হিস্টোনের সাথে সংযুক্ত করে দেন, যা মিথাইল গ্রুপের কাজকর্মকে বাধা দেয়। এজন্যই এন্টি-ডিপ্রেসেন্ট ওষুধগুলো এত সহজে কাজ করে – বিষন্নতা দূর করে মনকে ফুরফুরে করে তোলে। শিকাগোর ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিস গ্রেসন স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্তান্ত রোগীদের উপর এসিটাইল গ্রুপ প্রয়োগ করে অনেক রোগীকেই সারিয়ে তুলতে পেরেছেন। অনেক বিজ্ঞানীই এখন মনে করেন শিশু বয়েসের পরিবেশ, পরিচর্যা আমাদের মানসজগত গঠনে সাহায্য শুধু করে না, পরবর্তীতে জিনের প্রকাশভঙ্গিকে বদলে দেবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখে। যতই এপিজেনেটিক্সের আধুনিক গবেষণার ফলাফল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, ততই মানব প্রকৃতির রহস্যোদ্ঘাটনে জেনেটিক্সের পাশাপাশি পরিবেশ এবং পরিচর্যার গুরুত্ব আরো বেশি করে বোঝা যাচ্ছে, আর এগুলো মানব প্রকৃতি বিষয়ক বিতর্কে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। সায়েন্টিফিক মাইন্ডের ২০০৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বর সংখ্যায় এ জন্যই বলা হয়েছে –
নতুন গবেষণার ফলাফলের আলোকে এখন বোঝা যাচ্ছে মায়ের পরিচর্যার রীতি শিশুর জিনের প্রকাশভঙ্গির উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।
এপিজেনেটিক্স ছাড়াও ব্রেনের নিউরোপ্লাস্টিসিটি নিয়ে পল ব্যাচি রিটা, মাইকেল মার্জেনিচ, ভিলায়ানুর রামাচন্দ্রনের আধুনিক গবেষণাগুলোও খুব পরিস্কারভাবে দেখিয়েছে কিভাবে পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের মস্তিস্কও নিজেকে বদলে ফেলতে পারে।
অভিজিত দা, প্রসঙ্গ বহির্ভুত একটা রিকোয়েস্ট করি। আপনি মিউটেশন নিয়ে একটা আর্টিক্ল লেখেন। এটা নিয়ে জানার অনেক কিছু আছে, কিন্তু এ বিষয়ে আমার জ্ঞান ভাসাভাসা। 🙁 আমি যদ্দুর বুঝেছি, মিউটেশনের ফলে নতুন জিন তৈরি হয়। আবার ছোটবেলায় বইতে প্রকট জিনের কথা পড়েছি যেগুলো আমাদের অভিযোজনিক বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। কিন্তু মিউটেশনের ফলে এমন কোন প্রচ্ছন্ন জিন যদি তৈরি হয় যেটি আমাদের দেহের অভিযোজনিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য দায়ী হবে, সেক্ষেত্রে বিবর্তনে এমন মিউটেশনকে কতটা সার্থক বলা যায়? প্রচ্ছন্ন জিন কি কখনো প্রকট হয়ে যেতে পারে?
@অভিজিৎ দা,
আপনার অনবদ্য লেখাটি থেকে অনেক প্রশ্নের উত্তর পেলাম। অনেক নতুন প্রশ্নও জাগল যেগুলোর উত্তর হয়ত দেবে অনাগত কাল ।
অবাক হয়ে লক্ষ করছি যে মানুষের নিরন্তর অধ্যবসায় থেকে অর্জিত জিনোম সায়েন্স সম্পর্কে জ্ঞানের কৃতিত্ব ও কিছু লোকের কল্যাণে সৃষ্টিকর্তার ভাগে ছলে যাচ্ছে! সৃষ্টিকর্তা এত লোভী কেন?এত নিজের প্রসংশা শুনতে তার বিরক্ত লাগে না?
আমি তো আশা রাখি আমরা যৌবনোত্তীর্ণ হবার আগেই আয়তক্ষেত্রটির দৈর্ঘ্য বের করা যাবে। আচ্ছা, প্রতিভা সম্পর্কে আপনার মত কি?বি্বর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিভার ব্যাখ্যা কি?
[…] পূর্ববর্তী পর্বের পর… […]
A. HALIM…
I have read several articles about boosting self esteem but they didn’t give me the complete picture but finally you article has done when i found it on Wednesday….
Tanvy bhaia apni sotto katha bolechen.Apnake antorik dhannobad o Avijitke afuranto subhechha o bhalobasa.Avijit jeno amaderke aro anek anek llekha diye dhanno kare.Bango santander jai hok.
Amar kono proshno nei Avijiter kache.Karon prosno korte gele gyan (knowledge) thaka chai ja amar nei.Ami jatoi tar lekha pori, tatoi bismito(bewildered) hoi.Jai Ho…..
@sentu tikadar,
ভাইয়া প্রশ্ন করার জন্য জ্ঞান থাকার দরকার নাই বরং জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রশ্ন করা উচিৎ। আপনি যেই প্রশ্নই করুননা কেন,আশা রাখি অভিজিৎ ভাইয়া তার উত্তর দেবেন!! তাই বোকার মত গাদা গাদা প্রশ্ন করুন,আপনার প্রশ্নের পেছনে ফালতু যুক্তি খুঁজে বের করে অভিজিৎ ভাইয়াকে বিরক্ত করুন,আপনারও জ্ঞান বাড়বে সাথে আমরাও উপকৃত হব(!!)
ডঃ অভিজিৎ রায়,
বলাই বাহুল্য যে, অত্যন্ত চমৎকার তথ্যবহুল প্রবন্ধ। গতপর্বে যে অতৃপ্তি ছিলো সেটি য আরোও বাড়লো! আমার প্রশ্ন গুলোর উত্তর এখনো সরাসরি পাইনি যদিও, খানিকটা বুঝতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে আর পরবর্তী ধারাবাহিক গুলোর কোনটাতে আশাকরি পেয়ে যাব। কিন্তু পাশাপাশি আরোও কিছু বিষয় আমাকে প্রলুব্ধ করছে আপনার কাছ থেকে জানতে। আশাকরি আপনার এই ধারাবাহিকেই থাকবে এসবের উত্তর।
তবে কি ব্ল্যন্ক শ্লেট হিসেবে কোন শিশু জন্মায় না যেমন তেমন আরো কত গুলো প্রভাব তার উপরে নিশ্চিন্ত ভাবে পড়ে পরিবেশ গত বিষয় ছাড়াও এবং জেনেটিক্যালি এক্ষেত্রে প্রাণীর জিনগত বৈশিষ্টে পরিবর্তন আসতে বাধ্য। এর মধ্যে একটি হলো খাদ্যভ্যাস বা খাদ্যভ্যাসে পরিবর্তন। যেমন যেসমস্ত প্রানী মাংশাসী এরা সচরাচর স্বভাবে আগ্রাসী এবং হিংস্র হয় অথচ উদ্ভিদ ভোজীরা হয় অপেক্ষাকৃত নিরীহ। গরু, ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া দেখুন একদিকে আর অন্যদিকে দেখুন আপনার গৃহপালিত কুকুরটিকে! মানুষতো সবই খায়! তাই বোধ হয় মানুষের স্বভাব খুব জটিল হয়, বোঝা দায়! আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই যে জেনেটিক্যালী বিভিন্ন ভ্যারাইটির ফল-ফলারি, সব্জিপাতি আনাজ আমরা প্রতি নিয়ত ইদানীং খাচ্ছি, এর সুদূর প্রসারী ফল কি দাঁড়াতে পারে? আরো একটি ব্যাপার ইদানিং ব্যাপক হারে বেড়েছে, তা হলো বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের এক্সপোজড ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বীম এর প্রভাব। তাৎক্ষনিক প্রভাব ছাড়াও এর সুদূর প্রসারী প্রভাব ঠিক কিভাবে পরছে , একটি ব্যপার।
যাই হোক আপনার লেখা থেকে মানব প্রকৃতির বিবর্তন এবং এর জৈব প্রকৃয়াগত বিশ্লেষন খুব প্রাঞ্জল সহজবোধ্য। স্পস্ট ধারনা সৃষ্টিতে দারুন সহায়ক। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
—কেশব অধিকারী
অভিজিৎ দা,
{যে রাস্তায় চলাচলের গতিসীমা সর্বোচ্চ ৩৫, সে রাস্তায় আমি ঢুকতাম প্রায় ৫০ মাইল বেগে। ফলে যা হবার তাই হল, এক বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পুলিশের গাড়ীর খপ্পরে পড়ে গেলাম। ব্যাস জড়িমানা গুনতে হল। দিন কয়েক খুব সাবধানে গাড়ি চালালাম। তারপর ক’দিন বাদেই আবার যেই কি সেই।}
{স্বভাবে একটু বদরাগী। রাগের সময় মাথা ঠিক থাকে না অনেক সময়ই। ঝগড়ার সময় বউকেও চড় থাপ্পর মেরে বসেন। বউও প্রথম প্রথম সহ্য করত, কিংবা হয়ত মানিয়ে নিতে চাইত। কাউকে বলতো না। সবাই ভাবতো সুখের সংসার বুঝি তাদের। আর বউকে নেহাৎ গোবেচারা পেয়ে স্বামীরও সাহস গেল বেড়ে।}
এই ঘটনা তো এমনও হতে পারে, (অভ্যাস জেনিটিকালী) ‘যে বাহির থেকে (পরিবেশ থেকে) কিছু চাপে ঠিক হয়ে যাবে, না হলে হবে না ।
আবার গাড়ি না পেলে, জড়িমানার কোন প্রশ্নই উঠৎনা ।
এমনও হতে পারে “কিছু কিছু জিন নির্দিষ্ঠ সময় অথবা নির্দিষ্ঠ পরিবেশ পেলেই কার্যকরী হয়ে উঠে । কিছু জিন সবসময় কার্যকর থাকে ।”
এমনও তো হতে পারে কিছু জিনটাই এরকম যে সর্বদা পরিবেশ অনুষারে Change হয় ।
তাহলে তো পরিবেশ বাদে ফিরে আসতে হয় ।
{আয়তক্ষেত্র তৈরিতে কার ভূমিকা বেশি – দৈর্ঘ্য নাকি প্রস্থ?}
এটাকে ত আমি এভাবে প্রকাশ করতে পারি,
X(জিন) + Y(পরিবেশ)=XY(মানুষ)
কিন্তু এটা তো এমনও হতে পারে
X+2Y= মানুষ অথবা,
2y+X=মনুষ অথবা different কোন সমীকরন ।
একটি ঘটনা কিছু দিন আগে পরলাম রাশিয়ান মগলি । মা বাবা র অযত্নে, অবহেলায় {ধর্ম বিমুখীতার ফল}কুকুরের সাথে বেড়ে উঠে, কুকুরের মত হঠা, খাওয়া, খেলা ইত্যাদি করছে । ভাষা (Human) জ্ঞান খুবই কম ।
আল্লাহ swt জনানেন, আসলে কি ? জিন না পরিবেশ । তিনি হয়ত ভবিষৎ এ আমাদের জ্ঞান দিবেন ।
আছ্ছা অভিজিৎ দা,
“কিছু কিছু জিন নির্দিষ্ঠ সময় অথবা নির্দিষ্ঠ পরিবেশ পেলেই কার্যকরী হয়ে উঠে । কিছু জিন সবসময় কার্যকর থাকে ।” বিজ্ঞনীক ভাবে এধরনের কি কোন জিন আছে ? {এটা just আমার চিন্তা}
@ফুয়াদ,
হ্যা তা তো আছেই বোধ হয়। েপিজেনিক্সের আধুনিক গবেষণা বলছে বংশগতভাবে যে সমস্ত জিনগত বৈশিষ্ট্য আমরা অর্জন করতে পেরেছি, তার টার্ন অন বা অফের মাধ্যমে জেনেটিক এক্সপ্রেশন বদলাতে পারি পরিবেশ থেকে নানা রকমের সিগন্যাল নিয়ে। যেমন আমাদের শরীরের ওজনের কথাই ধরুন, অনেক ক্ষেত্রেই দেহের কাঠামো মোটা হবে না চিকন হবে – তার অনেক কিছুই জেনেটিক। কিন্তু তা বলে জিনের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে আমরা বসে থাকি না। আপনার যদি একটুতেই ‘মুটিয়ে’ যাবার টেন্ডেন্সি থাকে, আপনি খাবারের উপর আরো যত্নবান হবেন, ব্যায়াম করবেন, চর্বি জাতীয় খাবার কম খাবেন – এইটাই ধর্তব্য। তা না করে আপনি যদি বেহিসেবী জীবন কাটাতে থাকেন, খানা পিনা পানীয় -এর প্রতি লালায়িত থাকেন , সমানে ভুরিভোজ করে যেতে থাকেন- হয়ত আপনার দেহের জিনগুলো আনন্দে আত্মহারা হয়ে আপনার দেহকে নাদুস নুদুস করে তুলবে। এখন জিনের অভ্যন্তরস্থ জেনেটিক এক্সপ্রেশন কিভাবে বদলাবেন – তার অনেক কিছুই কিন্তু আপনার দেয়া পরিবেশের উপরই নির্ভর করবে।
হ্যা অনেক জিনই আছে পরিবেশ অনুষারে Change হয়। কিন্তু আবার উলটো ব্যাপারও আছে। পরিবেশ দিলেও বদল হয় না। যেমন, হান্টিংটন ডিজিজ – এই রোগটিকে ১০০% জেনেটিক বলে মনে করা হয়। এটা পরিবেশ নির্ভর নয়।
এটা গেল শারীরিক ক্ষেত্রে। মানসিক ক্ষেত্রটাও অনেকটা ওরকম। পরিবেশ দিয়ে অনেক সময়ই ব্যবহার বদল করা যায়, কিন্তু তার মানে কিন্তু এটা নয় যে সকলেই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ হয়ে জন্ম লাভ করে। আসলে জন্মগতভাবে সবাই কিছু না কিছু বৈশিষ্ট পুঁজি করে জন্মায়। পরিবেশ কাজ করে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সেই জিনগত বৈশিষ্ট্যের উপর । সেজন্যই ম্যাট রীডলি বলেছেন- The debate no longer is nature versus nurture, but nature via nurture.
avijit da apnar lakha pore sottoka jani. kinto dada apnar rajnoitik likha gulu ke aro clear howa uchit na?
@rony,
আমি তো ভাই রাজনৈতিক লেখা তেমন একটা লিখি না। আমি মূলতঃ বিজ্ঞান আর দর্শনের সাম্প্রতিক বিষয় আশয় নিয়েই লিখতে পছন্দ করি। কোন্ লেখা সম্বন্ধে বলছেন, সেটা না জানা থাকলে বলা মুশকিল – ‘আরো ক্লিয়ার’ করা উচিৎ কিনা!
মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ
অভিজিত দা,
আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। আর লেখাতে দশ তারা। ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।
@suman,
উত্তর পেয়ে গেছেন শুনে ভাল লাগল। তবে এই পর্বেই ‘আখেরি উত্তর’ পাওয়া গেছে ভাব্লে কিন্তু ভুল করবেন…পরের পর্বে আবার রহস্য আসছে :evilgrin:
@অভিজিৎ দা,
উত্তর পাইলেও লেখাটা এখন পর্যন্ত দশবার পড়েছি। পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে সাহিত্য পড়ছি, একবারও মনে হয়নি এর মধ্য দিয়ে আপনি জেনেটিক্স এর মত বিজ্ঞানের কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিজ্ঞানের লেখাওযে এমন রসময় প্রাঞ্জল হতে পারে আপনার লেখা পড়ার আগে বুঝতে পারিনি। তাইতো উত্তরটা পেলেও বসে আছি আপনার সাহিত্যময় সায়েন্টিফিক সিরিজের পরবর্তী পর্বের আশায়…
বিবর্তন মনো বিজ্ঞানকে আমি সাধারনত মার্ক্সবাদ বা সমগোত্রীয় সোশ্যাল সায়েন্সের যেকোন রিডাকশনিজমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকি। মার্ক্সের দৃষ্টিতে মানুষের মনটা পুরোটাই বস্তুবাদি সমাজের ক ন্ডিশন । বিবর্তন মনোবিজ্ঞান এই মৌলিক যায়গাতেই আঘাত করছে-যার রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশী। অর্থাৎ আমার মনটা হচ্ছে মিলিয়ান বছরের সোশ্যাল এবং এনভাইরনমেন্টাল কন্ডিশনিং। যার জন্যেই বোধ হয় আমরা ভারত এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রাধান্য দেখি-মানুষের মনটা ওই ভাবেই কন্ডিশনড হয়ে আছে!
যাইহোক দুটো মানুষের মধ্যে জীনের ফেনোটাইপগত বৈশিষ্ট আলাদা হলেও মাইক্রোস্ট্রাকচার পার্থক্য ত খুব ই কম ৭০ পিপিএম মতন। এবং যদ্দুর জানি, দুটি মানুষের নিউরাল নেটওয়ার্কের মধ্যে পার্থক্যও অই পি পি এম লেভেলে। সুতরাং যেটুকু পার্থক্য হতে পারে, তার অধিকাংশটাই স্যোশাল কন্ডিশনিং হতে বাধ্য।
আমেরিকায় ভারত এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা কিন্ত যতনা বেশী ভারতীয়, তার থেকে অনেক বেশী আমেরিকান। জেনেটিক তত্ত্ব ঠিক হলে, তাদের ভারতীয় অভ্যেস ই বেশী থাকা উচিত-সেরকম ত কিছুই দেখি না।
@বিপ্লব,
হ্যা, মার্ক্সবাদ তার দার্শিনিক ভিত্তির কারনেই বোধ হয় জেনেটিক্স অস্বীকার করে পরিবেশ নির্ণয়বাদকে একামাত্র গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলো। মার্ক্সবাদীদের অনেক উক্তিতেই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ তত্ত্বের পৃষ্ঠপোষকতার ছাপ আছে। পিঙ্কার তার ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বইয়ে এর অনেক কিছু উল্লেখ করেছিলেন। যেমন মাও সেতুং বলতেন,
‘A blank sheet of paper has no blotches, and so the newest and most beautiful words can be written on it, the newest and most beautiful pictures can be painted on it’।
আবার খেমারুজ শ্লোগান ছিল – ‘Only newborn baby is spotless’।
আসলে যারা সাম্যবাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে ‘সব মানুষ কিছু জন্মগত বৈশিষ্ট্যকে পুঁজি করে জন্মায়’ এই ধারণার চেয়ে ‘সব মানুষ জন্মগতভাবে সমান – পরিবেশের জন্যই মানুষ ভাল বা খারাপ হয়’ এই ধারণা অনেক আকর্ষনীয়। স্ট্যালিনের সময় জেনেটিক্সকে হটিয়ে কিভাবে লাইসেঙ্কোইজম প্রমোট করা হয়েছিল তা বোধ হয় আর নতুন করে বলে দিতে হবে না। লাইসেঙ্কোইজমকে সমর্থন না করায় প্রাণ দিতে হয়েছিলো ভাবিলভের মত বিজ্ঞানীকে। স্ট্যালিন তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এটি করেছিলেন, কারণ এটি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক বলে মনে করা হয়েছিলো। জেনেটিক্সের আধুনিক ধারণাগুলো আর বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান অনেকাংশেই তাদের এই সজ্ঞাত ধারনাকে অনেকাংশেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছ, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তবে উলটোদিকও কিন্তু আছে। অতিমাত্রায় জেনেটিক ডিটারমিনিজমকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে এক সময় জন্ম হয়েছিলো সোশাল ডারউইনিজমের, জন্ম হয়েছিলো ইউজিনিক্সের। বিজ্ঞানের রাজনৈতিক ব্যবহারের এক লজ্জাজনক অধ্যায়। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে রেসিজম প্রমোট করার এই উদাহরণগুলো ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না। সেজন্যই আজকের সামাজিক বিবর্তনবাদীদের অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এ সমস্ত বিষয়ে গবেষণা করতে হয়। অনেক সময়ই দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হয় তাদের বক্তব্য ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ হচ্ছে কিনা।
আমি আমার লেখায় দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, সম্পূর্ণ বংশানুনির্ণয়বাদী হওয়া কিংবা সম্পূর্ণ পরিবেশ নির্ণয়বাদী হওয়া – দুই ক্ষেত্রই ভুল। মানব প্রকৃতি গঠনে বংশানুর প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে পরিবেশের। অনেক সময় নেচারকে নারচার থেকে আলাদাও করা যায় না; আলাদা করার চেষ্টাও হয়ত অনেক ক্ষেত্রে ভ্রান্ত। ম্যাট রিডলীর ‘এজাইল জিন’ (The Agile Gene: How Nature Turns on Nurture) বইটা পারলে তমি পড়ে দেখো। আমার পিঙ্কারের ব্ল্যাঙ্ক স্লেটের চেয় রিডলীর বইটা অনেক ব্যালেন্সড মনে হয়েছে। হিউম্যান নেচার সম্বন্ধে রিডলী যে বক্তব্য তার বইয়ে দিয়েছন, সেটা আমারো কথা –
“Let me once put my cards face up. I believe human behavior has to be explained by both nature and nurture. … The discovery of how genes actually influences human behavior, and how human behavior influences genes, is about to recast the debate entirely. No longer is it nature versus nurture, but nature via nurture. …Environmental and genetic influences seem to work together, to require each other, until it is impossible to say which is cause and which is effect. The dichotomy of nature and nurture must first confront the dichotomy of cause and effect.”
সংস্কৃতির বিষয়টা একটু জটিল, এবং ক্ষেত্রবিশেষে ‘বিতর্কিত’ ও বটে। এটা ঠিক সংস্কৃতির বিভাজনের কথা ঢালাও ভাবে সাহিত্যে সংস্কৃতিতে আর এন্থ্রোপলজিতে উল্লিখিত হয়, কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় এই বিভাজন মোটেই বস্তুনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয় না। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, সংস্কৃতির যত বিভাজনই থাকুক না কেন, প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই দেখা যায়, মানুষেরা একইভাবে রাগ অনুরাগ, হিংসা, ক্রোধ প্রকাশ করে থাকে। দেখা যায় – ছেলেরা সংস্কৃতি নির্বিশেষে মেয়েদের চেয়ে চরিত্রে বেশি ‘ভায়োলেন্ট’ হয়ে থাকে, মেয়রা ভার্বাল কমিউনিকেশনে ছেলেদের চেয়ে ভাল হয়ে থাকে। ‘পলিগামি’ বা বহুগামীত্বের ব্যাপারটা মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে অধিকতর দৃশ্যমান। রিলেশনশিপে ‘চিট’ ব্যাপারটাও মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা বেশি করে থাকে। পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে বেশি। মেয়েরা আবার ছেলেদের তুলনায় ‘লাভ স্টোরির’র বেশি ভক্ত। সিরিয়াল কিলারের সংখ্যা ছেলেদের মধ্যে বেশি, মেয়েদের মধ্যে খুবই কম । সংস্কৃতি নির্বিশেষে পুরুষদের টাকা পয়সা, স্ট্যাটাস ইত্যাদর মাপকাঠিতে বিচার করা হয়, আর মেয়েদের সৌন্দর্যের। ব্যাপারগুলো সঠিক নাকি ভুল, কিংবা ‘উচিৎ’ নাকি ‘অনুচিৎ’ সেটি এখানে বিচার্য নয়, বিচার্য হচ্ছে আমাদের সমাজ কেন এইভাবে গড়ে উঠেছে – যে এভারেজ মন মানসিকতা একটি নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ থাকে। এখানেই মানব প্রকৃতি বিশ্লেষণে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান সফল, সমাজবিজ্ঞান ততটা নয়।
কেন ছেলেরা বেশি চিট করে কিংবা কেন পর্ণগ্রাফির বেশি ভক্ত – এটি জিজ্ঞান্সা করলে সমাজবিজ্ঞানী কিংবা নারীবাদীদের কাছ থেকে নির্ঘাত উত্তর পাওয়া যাবে যে, যুগ যুগ ধরে মেয়েদের সম্পত্তি বানিয়ে রাখা হয়েছে, তারা শোষিত – এই মোনবৃত্তি তারই প্রতিফলন। কিন্তু যে সমস্ত সমাজে ছেলে-মেয়ের ডিস্ক্রিমিনেশন কম – সেখানে কি তাহলে এই ট্রেন্ড নেই? না তা মোটেও নয়। ‘প্লে বয়’-এর পাশাপাশি একসময় প্লে গার্ল’ চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। চলেনি। ছেলেরা শুধু কেন বল খেলবে আর মেয়েরা পুতুল – এই শিকল ভাংগত হবে ভেবে – ভিন্ন ধরণের খেলনা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিলো – চলেনি। কারণ কি? কারণ হচ্ছে, আমরা যত আড়াল করার চেষ্টাই করি না কেন, ছেলে মেয়েদের কগনিটিভ স্কিল-এ পার্থক্য আছে – আর সেটা দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় ছাপ থাকার কারণেই। ডকিন্সের ‘সেলফিশ জিন’ তত্ত্ব দিয়ে ছেলে মেয়েদের এই মানসিক পার্থক্যকে খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। সেলফিশ জিন তত্ত্ব সঠিক হলে, আমাদের দেহ জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে চাইবে ‘জিন সঞ্চালনে’। পুরুষদের জন্য যেহেতু নয় মাস ধরে গর্ভধারনের ঝামেলা নেই, নেই অন্য আনুষঙ্গিক ঝামেলা মেয়েদের যেগুলো পোহাতে হয় গর্ভ ধারনের জন্য, সেহেতু তাদের মধ্যে একটা অংশ থাকেই (ডকিন্স আবার সেই সংখ্যা তার বইয়ে ক্যাল্কুলেশন করেও দেখিয়েছেন) যারা মনে করে যত বেশি জিন সঞ্চালন করা যাবে ততই বেশি থাকবে ভবিষ্যত প্রজন্ম বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। তাই ইতিহাসে দেখা যাবে শক্তিশালী পুরুষেরা কিংবা গোত্রাধিপতিরা কিংবা রাজা বাদশাহ রা হেরেম তৈরি করে সুন্দরী স্ত্রী আর উপপত্নি দিয়ে প্রাসাদ ভর্তি করে রাখত। পর্ণগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ কিংবা পতিতাপল্লিতে পুরুষেরাই বেশি যায় – আদিম সেই ছাপ মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই হয়ত, মেয়েরা শোষিত বলে নয়।
পুরুষেরা মেয়েদের চেয়ে কেন বেশি ভায়োলেন্ট? এক সময় ছিলো হান্টার বা শিকারী, আর মেয়েরা গ্যাদারার। বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই পুরুষদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। অন্য গোত্রের সাথে মারামারি হানাহানি করতে হয়েছে। নিজের সাম্রাজ্য বারাতে হয়েছে। অস্ত্র চালাতে হয়েছে। কারিগরী বিষয়ে বেশি জড়িত হতে হয়েছে। আবার গৃহস্থালীর পরিচর্যা মেয়েরা বেশি অংশগ্রগণ করায় তাদের কমিউনিকেশন স্কিল ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বিবর্ধিত হয়েছে। একটি ছেলের আর মেয়েদের মস্তিস্ক এনালাইসিইস করেও বিভিন্ন পার্থক্য পাওয়া গেছে। ছেলেদের ব্রেনের আকার অন এভারেজ মেয়েদের চেয়ে বড় হয়, আর মেয়েদের ব্রেন ছেলেদের চেয়ে ঘন। হিপোক্যাম্পাস সহ ব্রেনের যে এলাকাগুলো ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্টে সহায়তা করে, মেয়েদের ক্ষেত্রে সেগুলো অনেক বিবর্ধিত থাকে। এগুলোর ছাপ এখনো সমাজে আছে। অভিভাবকেরা সবাই লক্ষ্য করেছেন, মেয়ে শিশুরা ছেলে শিশুদের চেয়ে অনেক আগে কথা বলা শিখে যায় – একই রকম পরিবেশ দেয়া সত্ত্বেও। এই রকম সুযোগ দেয়ার পরও অধিকাংশ মেয়েরা বড় হয়ে বুয়েটের চেয়ে মেডিকেলে পড়তেই উদ্গ্রীব থাকে। এটা কি কেবলই মেয়েরা শোষিত কিংবা পিছিয়ে পড়া বলে, নাকি বিবর্তনীয় সিলেকশন প্রেশার তাদের মধ্যে অজান্তেই কাজ করে বলে? আমার প্রবন্ধের পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব বলে ঠিক করেছি। দেখি কি হয়!
@Biplab Pal, বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের ব্যাপারে আমার পড়াশুনা যা তা এই মুক্তমনার মাধ্যমেই। অন্য সব কিছুর মত এটাকে বোঝার ক্ষেত্রেও আমার সহায় সেই সহজাত সাধারন জ্ঞান। মানস কাঠামো নির্মানে আমাদের উপরে পরিবেশের প্রভাব যেমন আছে তেমন আছে জেনেটিক কোডের ভূমিকা। কোনটার ভুমিকা প্রধান তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনো আসেনি।
উপরের এই আলোচনার সাথে মার্ক্স্বাদের বিরোধ কোথায় তা আমি বুঝতে পারলামনা। জেনেটিক কোডতো পুর্ব পুরুষের অভিজ্ঞতা ও আচরনেরই ধারক, যা আবার পারিপার্শিকতার প্রভাবেই পুর্ব পুরুষে সঞ্চিত হয়ে থাকে। এখন ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সাথে বিরোধটা কোথায় ঘটলো আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে সেটা ঠিক ধরতে পারছি না।
অত্যন্ত সুন্দর একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য অভিজিত রায়কে ধন্যবাদ। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়বস্তুকে খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে এবং প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। চিন্তা আর জ্ঞ্যানের বিবর্তন থেকে আমরা এখন বুঝতে পারছি জগত এবং জীবন বহুমাত্রিক। শূধুমাত্র বংশানু কিংবা শূধুমাত্র পরিবেশ একজন মানুষের চরিত্র, কর্মকান্ড এবং চিন্তাপ্রক্রিয়া বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। তেমনি শূধু ব্যক্তিস্বার্থ বা শ্রেনিস্বার্থ মানুষের সামাজিক বিবর্তন কিংবা ইতিহাসের পুর্নাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারেনা যেটা যথাক্রমে পূঁজিবাদি এবং মারক্সবাদি সমাজতত্বে চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের ভবিস্যত চিন্তা এবং জ্ঞানের বিকাশে বহুমাত্রিকতার এবং জটিলতার উপলধ্বি একটা বড় ভূমিকা রাখবে। অভিজিত রায়ের লেখাতে সেই উপলধ্বিরই সুন্দর বলিষ্ঠ প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি।
@M. Harun uz Zaman,
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
ভাইয়া ব্ল্যঙ্ক স্লেট তত্ব নিয়ে একটি প্রশ্ন মাথায় এল। আপনি লিখছেনযে প্রাণীর কার্যক্ষমতার ভিন্নতাকে ব্ল্যঙ্ক স্লেট তত্ব দিইয়ে ব্যখ্যা করা যায় না(যেমন কবুতর ইঁদুর ইত্যাদির পার্থক্য)। আমার প্রশ্ন হল, চোরদের অন্ধকারে বেশি দেখা বা এক এক জন মানুষের এক এক বিষয়ে অধিক কাজ করার ফলে দক্ষতা অর্জন করা এবং পরবর্তীতে উক্ত কাজ বাদে অন্য কাজে অক্ষমতা প্রকাশ পাওয়া ইত্যাদি কি ব্ল্যঙ্ক স্লেট তত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ন নয়?
@tanvy,
আমি জানিনা সত্যই চোরেরা রাতে ‘ভাল দেখতে পায়’ কিনা, তবে অধ্যাবসায় এবং চেষ্টার মাধ্যমে দক্ষতা বাড়িয়ে নেবার বহু উদাহরণ আমাদের মধ্যে আছে। সেজন্যই পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও জেনেটিক দিকটা মাথায় রাখতে হবে এজন্য যে, পরিবেশ কেবল কাজ করে বিদ্যমান বংশানুর পরিস্ফুটনের উপর। আপনার উদাহরণের চোর বাবাজী যদি জন্মান্ধ হত, তাহলে আপনি যতই দক্ষতা বারাতে চান না কেন, খুব বেশি লাভ হত না। আমরা বংশগতভাবে যে সমস্ত জিনগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পেরেছি, তার টার্ন অন বা অফের মাধ্যমে জেনেটিক এক্সপ্রেশন বদলাতে পারি পরিবেশ থেকে বিবিধ সিগন্যাল নিয়ে। কিন্তু কোন কারণে সেই মুল জিনটিই যদি আমার মধ্যে অনুপস্থিত থাকে, আমি যত সিগন্যাল পাঠাই না কেন তা বদলানো সম্ভব হবে না। বংশানু আর পরিবেশ – আয়তক্ষেত্রের দুটি বাহুর মত। একটি দৈর্ঘ , আরেকটি প্রস্থ। মানব প্রকৃতি নির্মাণে কার ভূমিকা বেশি- জিন না পরিবেশ? এ পশ্ন কেউ করলে এর জবাব হবে – আয়তক্ষেত্র তৈরিতে কার ভূমিকা বেশি – দৈর্ঘ্য নাকি প্রস্থ?
@অভিজিৎ,ধন্যবাদ ভাইয়া। এখন সব কিছু পরিস্কার।
ভাইয়া তবে কি বলা যায় যে,পারিপার্শ্বিকতা পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রানীর চরিত্র পরিবর্তন সম্ভব?নাকি নির্দিষ্ট বয়সের পর চরিত্র আর বদলায় না?
আর যদি পারিপার্শ্বিকতাই সব হয় তবে শুধু শুধু জ্বীন ভূতের(জিন) দোষ দেয়া কেন?
আবার খারাপ পরিবেশেওতো ভাল মানুষ তৈরি হয়। তাহলে পরিবেশও সকল ক্ষেত্রে সফল না।
আবার জোর করে ভাগ্যের দোষও দিতে পারি না!!
মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকে একটি সুন্দর উক্তি আছে,
” মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়,বেচে থাকলে বদলায়। কারনে অকারনে বদলায়, সকালে বিকালে বদলায়।”
এক্ষেত্রে কি বলা যায়? মানুষের ব্যক্তিত্ব,স্বকীয়তা,বুদ্ধি এগুলোও কি একটা বড় ব্যপার না?
আসলে পুরো ব্যপারটাই আমি গন্ডোগোল পাকিয়ে ফেলছি। কারন আমার যতটুকু দৌড় তাতে আমি কিছুতেই কিছু মিলাতে পারছিনা। তবে কি মানুষের পরিবর্তনের জন্য এক এক সময় এক এক বিষয় দায়ী?