আমার চোখে একাত্তর

 

ইরতিশাদ আহমদ 

 

(ষষ্ঠ পর্ব)

 

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার পর মার্চের এক তারিখ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন প্রায় অচল হয়ে পড়ে। শেখ মুজিবের নির্দেশে এবং তাজঊদ্দীনের ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনের নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং ন্যুন্যতম কাজকর্ম ছাড়া সবকিছুই বন্ধ হয়ে যায়। শেখ মুজিব গান্ধীর মতো করে অহিংসঅসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।  মার্চের তিন তারিখে পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল।

 

শাসক গোষ্ঠীর মধ্যেও সংকট ঘনীভুত হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। ইয়াহিয়া খানের সাথে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা নিয়ে মতদ্বৈততার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল আহসানকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।  তিন তারিখেই অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়, মার্চের পঁচিশ তারিখে।  এক তারিখে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে আবার তিন তারিখেই নতুন তারিখের ঘোষণা থেকেই বোঝা যায় ইয়াহিয়া সরকারের সিদ্ধান্তগুলি সুবিবেচনাপ্রসুত ছিল না।  একই সাথে ঢাকায় সর্বদলীয় বৈঠক আহবান করেন ইয়াহিয়া খান মার্চের দশ তারিখে।  ভুট্টোর পিপলস পার্টি ছাড়া আর কোন দল এই বৈঠকের ডাকে সাড়া দেয় নি।  

 

অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে, শাসকগোষ্ঠী তা ধারণা করে নি।  তাই ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য তড়িঘড়ি কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়, যেমন উপরে উল্লেখিত ঘোষণাগুলি অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর একাংশের মধ্যে হার্ডলাইনে যাওয়ার প্রবনতাও দেখা যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম জয়দেবপুরে বিক্ষোভরত সাধারণ মানুষের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালায়, মারা যায় অনেকেই। শেখ মুজিব নবঘোষিত তারিখে পরিষদের অধিবেশনে বসতে অসম্মতি জানান। সর্বদলীয় বৈঠকও বর্জনের ঘোষণা দেন।  যা বলবার রেসকোর্সে সাত তারিখের জনসভায় বলবেন, জানিয়ে দেন।      

 

কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান কি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে প্রস্তুত?  সাত তারিখের ভাষনে শেখ মুজিব কি বলবেন শোনার জন্য শুধু দেশবাসী নয়, সরকারও অধীর উকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। 

 

স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে শেখ মুজিবের পক্ষে আর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে থাকা সম্ভব হয় না। সেই অবস্থায় তাকে আত্নগোপন করে গেরিলা যুদ্ধের নেতা সেজে সম্পুর্ণ ভিন্ন ধরণের এক রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করতে হয়।  এই ধরণের রাজনৈতিক জীবনের জন্য শেখ মুজিব নিজেকে কখনো প্রস্তুত করেন নি, বা করার প্রয়োজনীয়তা আছে মনে করেন নি।  আমার মনে হয় তিনি আসলে এই ধরনের রাজনীতির (বিপ্লবী, অনিয়মতান্ত্রিক), যা বামপন্থীদের ট্রেডমার্ক ছিল, বিরোধী ছিলেন নীতিগতভাবে।  আর আত্নগোপনে যাওয়া মানেই ভারতে আশ্রয় নেয়া, এই বাস্তবতাকেও মেনে নিতে হয়।  শেখ মুজিব কি জানতেন এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তিনি কি করবেন?  খুব সম্ভবত জানতেন না, সময় আসলে অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন হয়তো এরকমই ভেবেছিলেন।  

 

তাই সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলে কি করা হবে, যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কি হবে, এসব প্রশ্ন নিয়ে আওয়ামী লীগের কোন চিন্তাভাবনা ছিল কিনা, কোন প্রস্তুতি বা কোন কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ছিল কিনা জানা যায় না। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মনে হয় ছিল না।  এই ব্যাপারটা আমাকে একটু অবাক করে।  কেন যেন মনে হয় এই সময়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল একটু বেশি রিএক্টিভ, পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার বা রাখার কোন পরিকল্পনার নিদর্শন পাওয়া যায় না তখনকার আওয়ামী লীগের কর্মকান্ডে।  

 

তাই পঁচিশে মার্চের রাতে শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিব যা করেছিলেন – গ্রেফতার বরণ, তা সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের ফল ছিল, না কি সিদ্ধান্তহীনতার পরিণতি ছিল, সন্দেহাতীত ভাবে জানা যায় না।  খুব সম্ভবত তিনি হিসাব করে ঝুঁকি নিয়েছিলেন।  পরবর্তীতে শোনা যায়, শেখ মুজিব যে গ্রেফতার হওয়ার অপেক্ষায় বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং পরবর্তীতে গ্রেফতার হয়েছেন এটা নাকি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও জানতেন না।  এ নিয়ে আজো নানাজনে নানা কথা বলেন, যখন বলেন তখন নিজ নিজ অবস্থান থেকে মনের মাধুরী মেশান, রং চড়ান, যে সব ঘটনা ঘটে নি সেগুলো ঘটেছে বলে প্রচার করেন, যে গুলো ঘটেছে তার কিছু কিছু ঘটে নি এমন দাবী করেন।  কিন্তু আসলে কি ঘটেছিল তা জানা যায় না।  শেখ মুজিব নিজেও এ নিয়ে কিছু বলেন নি, হয়তো সঙ্গত কারণেই।

 

শেখ মুজিব যে আগেপরে গ্রেফতার হবেন তা তিনি জানতেন।  হয়তো চাইতেনও।  এভাবেই আন্তর্জাতিকভাবে এই সঙ্কটের সমাধান হবে তাই তিনি ধারণা করেছিলেন, এবং আশাও।  শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ আলী মিয়ার স্মৃতিচারণমূলক লেখা থেকে জানা যায়, সাতই মার্চ রাতে, সেই ঐতিহাসিক ভাষনের পরে, খেতে বসে তিনি পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন, তিনি যে কোনদিন গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন তাই তাঁরা যেন তাঁর সাথে খেতে বসেন রোজ এই কটা দিন।  নিজের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে শেখ মুজিবের ধারণা ছিল বাস্তবোচিত।

 

বাংলার মানুষের স্বাধিকার আদায়ের প্রশ্নে শেখ মুজিবের মনে কোন দ্বিধা ছিল না। কিন্তু তিনি তা আদায় করতে চেয়েছিলেন বিনা রক্তপাতে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে।  মার্চের একতারিখের আগে তাঁর মনে ক্ষীণ হলেও হয়তো এই আশা ছিল যে, তিনি সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।  পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ছয়দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আদায় সম্ভব এটাই তখন তিনি ভেবেছিলেন।  এই ভাবনার মধ্যে দোষের কিছু আমি দেখি না।  তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে আইনসম্মতভাবে আওয়ামী লীগ যদি পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়, তাহলে পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্ন হওয়ার বা স্বাধীন হওয়ার প্রয়োজন তো ছিলই না।  পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বাংলার মানুষের অধিকার কায়েম করতে পারবেন এই বোধ এবং বিশ্বাস থেকে শেখ মুজিব যদি তাঁর কর্মপদ্ধতি এবং পদক্ষেপগুলি ঠিক করে নেন তাতে দোষের কি আছে?  এই বিশ্বাসের জন্য শেখ মুজিবের বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু তাঁর সততা বা সাহস নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই।    

 

কিন্তু মানুষ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তা হতে দেবে না – বাঙ্গালীদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে দেবে না।  একাত্তরের পূর্ব বাংলায় জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মান ছিল অনেক উন্নত।  তারা তখন মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে প্রস্তুত। শেখ মুজিবের রাশ-টানা নেতৃত্বের চেয়ে ছাত্রদের স্বতস্ফুর্ত জঙ্গী কর্মসূচীতে মানুষ সায় দিয়েছিল বেশি।  স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে শেখ মুজিব জনগণের আস্থাই শুধু হারাবেন না, তাঁর নিজের দলেও শৃংখলা বজায় রাখতে পারবেন না, এমন সম্ভাবনা দেখা দিল।  শেখ মুজিবও বুঝতে পারছিলেন মানুষের মনোভাব।  কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষনা দিতে তিনি তখনো প্রস্তুত নন, সাহসী হলেও মুজিব ছিলেন হিসেবী রাজনীতিক। 

 

মার্চের ছয় তারিখ রাতে শেখ মুজিব নাকি তাঁকে গ্রেফতার করার অনুরোধ নিয়ে দুইজন বিশ্বস্ত অনুসারীকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকার জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার কাছে  হাসান জহীরের ভাষ্যমতে মুজিব বলে পাঠিয়েছিলেন, দলের চরমপন্থীদের চাপের মুখে পরদিনের জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষনা দেয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।  মেজর জেনারেল রাজার ধারণা হয়েছিল শেখ মুজিব সামরিক সরকারের মুড বোঝার উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে এই ধরণের বক্তব্য নিয়ে দূত পাঠিয়েছিলেন।  রাজা মুজিবের অনুরোধ রাখেন নি, তাঁকে গ্রেফতার করেন নি। বলেছিলেন, তিনি মনে করেন না মুজিব অসহায়।  আর নাকি সাবধান করে দিয়েছিলেন, স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতার ঘোষনা দিলে তিনি কামান-ট্যাঙ্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এবং মুজিবের আর তাঁর অনুসারীদের পূর্ব পাকিস্তান শাসন করার শখ চিরতরে মিটিয়ে দেবেন।  ঘটনাটা আসলেই ঘটেছিল নাকি এটি একজন পাকিস্তানী জেনারেলের বানিয়ে বলা মিথ্যেকথা অথবা একজন পাকিস্তানী লেখকের চাতুর্যপূর্ণ প্রচারণামূলক লেখার নিদর্শন বলা মুস্কিল।  তবুও তখনকার পরিস্থিতিকে বুঝতে সহায়তা করবে ভেবে ঘটনাটার উল্লেখ করলাম।      

 

সাতই মার্চের বক্তৃতা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।  রাজনীতিতে পরস্পরবিরোধী শক্তির মধ্যে সময়োপযোগী ভারসাম্য রক্ষার একটা সফল দৃষ্টান্ত।  যদিও এই ভারসাম্য শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা সম্ভব হয় নি।  তবুও পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত এই ভারসাম্য টিকে ছিল বলা যায়।  শেখ মুজিবের এই ভাষণ উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য দলিল।  কোন স্ক্রিপ্ট বা টেলিপ্রম্পটার না দেখে এই ধরনের বক্তৃতা দেয়া জনমানুষের সাথে সম্পর্কহীন কোন নেতার পক্ষে সম্ভব নয়।  আমরা সেদিন চট্টগ্রামে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি রেডিওর সামনে বক্তৃতাটা শোনার জন্য।  আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল শেখ মুজিবের ভাষণ রেসকোর্স থেকে সরাসরি রেডিওতে সম্প্রচার করা হবে।  কিন্তু নির্ধারিত সময়ে রেডিও পুরোপূরি নিশ্চুপ, কোন ঘোষনা ছাড়াই রেডিওর অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।  পরে জানা গেল সরকারের নিষেধাজ্ঞার ফলে ভাষণ প্রচার করা যায় নি।  প্রতিবাদে রেডিওর বাঙ্গালী কর্মচারীরা স্টেশন বন্ধ করে দিয়ে চলে যান।  পরদিন সকালে ভাষনটা রেডিওতে প্রচার করা হয়।

   

সাতই মার্চের বক্তৃতায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারতেন না।  তাই দেন নি।  কিন্তু তাক্ষণিক  রক্তপাত এড়াতে যা বলার প্রয়োজন ছিল তা বলেছিলেন।  অন্যদিকে ছাত্রজনতার ক্ষোভও প্রশমিত করতে পেরেছিলেন।  মানুষের মনে আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা জাগাতে পেরেছিলেন।  পেরেছিলেন মুক্তির আকাংখায় মানুষকে উজ্জীবিত করতে।  সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য জনগণকে মানসিক প্রস্তুতি নিতে উদ্ধুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। এই বক্তৃতায় শেখ মুজিবের ভুমিকা অভিযোগকারীর, শুরু করেছেন এই বলে, “ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন”। 

অনুযোগ করেন, “কি অন্যায় করেছিলাম?”  তারপরে বর্নণা করেন ইতিহাস। দুঃখের ইতিহাস, “তেইশ বসরের করুণ ইতিহাস, মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস”।

 

আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই,” এই কথাটা।  এই কথার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে এই উপলদ্ধি যে, প্রধানমন্ত্রীত্ব আর স্বাধিকার একসাথে পাওয়া যাবে না।    

 

প্রথমে তাঁর হাতদুটি ছিল পেছনে, যখন তিনি অভিযোগকারীর মতো করে অন্যায়-অবিচারের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। মাঝামাঝি জায়গায় এসে তাঁর কন্ঠে প্রতিবাদের স্বর, প্রতিরোধের প্রত্যয়। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে বললেন।  বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে এসে তিনি উত্তেজিত, যদিও সংযত।  অত্যন্ত আবেগময় উচ্চারণে তর্জনী উঁচিয়ে ঘোষনা দিলেন, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের ওপর হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।  আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো বাংলার মাটিতে শত্রুর সাথে যুদ্ধ হতে পারে, শেখ মুজিব তা বুঝতে পেরেছিলেন।  তবে মনে হয়, যুদ্ধের প্রকৃতিটা কেমন হবে তা বোধহয় আঁচ করতে পারেন নি।  তখন কেউ কি পেরেছিল?

 

কিন্তু তবুও বলতে হয়, যুদ্ধ যেন না হয় এটাই তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন।  আশা করেছিলেন, শান্তিপূর্ণ ভাবে সঙ্কটের সমাধান হবে।  তাই পরক্ষণেই বলেন, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না

 

ঘোষিত পঁচিশ তারিখের অধিবেশনে যাবেন না বললেন, কিন্তু আলোচনায় বসার পথ খোলা রাখলেন। চারটি শর্ত দিলেন এবং বললেন, এগুলো মেনে নিলে অধিবেশনে যাবেন কিনা ভেবে দেখবেন।  শর্ত চারটি হলো, সামরিক আইন তুলে নিতে হবে, সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।  রাজনীতির নুন্যতম জ্ঞান যারা রাখেন তারা বুঝবেন এই শর্তগুলো সামরিক সরকারের পক্ষে মানা সম্ভব ছিল না।  বস্তুত শেষ শর্তটা মেনে নিলে প্রথম তিনটা শর্তের আর কোন দরকারই থাকে না।  তবে শর্তগুলো যৌক্তিক ছিল কি না এই প্রশ্ন সেদিন বাঙ্গালীদের মধ্যে কেউই তোলেন নি।  যৌক্তিকতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল শর্তগুলোর প্রভাব তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর।  এগুলো ছিল সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল আর জনগণের অসন্তোষ অবদমনের প্রচেষ্টা।  এই কৌশল ও প্রচেষ্টা সাতই মার্চের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সফল হয়েছিল বলা যায়।      

 

সাতই মার্চের ভাষনের শেষ বাক্য ছিল, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ঘোষণা দিলেন না, কিন্তু শ্লোগান দিলেন।  অনেকের কাছে এটাই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।  তবে বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।  ছাত্র-জনতার জঙ্গী মনোভাব প্রশমনে এই শ্লোগানের বিরাট ভুমিকা ছিল।  মুক্তি আর স্বাধীনতা শব্দদুটি রূপকার্থে ব্যাবহার করা হয়েছে, বিচ্ছিন্নতা অর্থে নয়, এই ব্যাখ্যা পরে আলোচনার সময় সামরিক সরকারকে দেয়া হয়েছিল।  রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সামাল দিতে এমন শ্লোগান না দিয়ে উপায় ছিল না, এও নাকি শেখ মুজিব ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন।      

 

একেই বোধহয় বলে বুর্জোয়া রাজনীতির সঙ্কট।  শেখ মুজিব ব্যাক্তিগতভাবে সেদিন এই সঙ্কটের মোকাবিলা করেছিলেন একজন বুর্জোয়া রাজনীতিক হিসেবে সার্থকতার সাথে।  পরিচয় দিয়েছলেন অসম সাহসিকতার আর প্রজ্ঞার।  মানুষের আস্থা তিনি অর্জন করতে পেরেছিলেন, মানুষ বিশ্বাস করেছিল শেখ মুজিব জীবন দিবেন তবুও বাংলার মানুষের স্বাধিকারের প্রশ্নে আপোষ করবেন না।

 

কিন্তু অবশেষে দেশবাসী কি সঙ্কটের হাত থেকে নিস্তার পেয়েছিল?  পঁচিশে মার্চের রাতে নিরস্ত্র, অপ্রস্তুত ঢাকাবাসীদের, রিক্সাচালনারত অবস্থায় চালক আর ঘরমুখী যাত্রীদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলিতে অবস্থানরত ছাত্রদের, ক্যাম্পাসে বসবাসকারী অধ্যাপকদের, বস্তির মানুষদের এমন কুকুর-বিড়ালের মতো কেন মরতে হলো সেই রাতে?  কেউ কি জানতেন না কি ঘটতে যাচ্ছে?  কেন জানতেন না?

 

এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো কোনদিনও জানা যাবে না।  আজ আটত্রিশ বছর পরেও অজানা রয়ে গেছে অনেক কিছুই।  তবুও হয়তো কিছুটা হলেও বোঝা যাবে যদি সাতই মার্চ থেকে পঁচিশে মার্চ, এই আঠার দিনে দেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, ঘটা ঘটনাগুলো আমরা অনুধাবনের চেষ্টা করি। 

____________________________

Hasan Zaheer, The Separation of East Pakistan: The Rise and Realization of Bengali Muslim Nationalism, Oxford University Press, 1994, p. 488.

 

এপ্রিল ২৫, ২০০

(চলবে)

ড. ইরতিশাদ আহমদ ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ইমেইল : [email protected]