প্রথম পর্ব; দ্বিতীয় পর্ব; তৃতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্বে বলেছিলাম, একটা সময় বাংলা কোরআন পড়া আরম্ভ করি। বেশীদূর যেতে হয়নি- ২য় সুরাতেই মানে সুরা বাকারা পড়তে গিয়েই হোচট খাওয়া আরম্ভ করি। কোরআনের অনেক কিছুই আছে যা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মেলে না- কিন্তু ঐ সময়ে সবচেয়ে বেশী ধাক্কা খাই- অলৌকিক ঘটনাগুলোতে, বিভিন্ন নবী-রাসুলের অলৌকিক ক্ষমতা বা মু’জিজা ছিল এটা বিশ্বাস করতেই হবে। কিন্তু পারছিলাম না। নবীজীর হাতের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল? মুসা আ এর লাঠি সাপ হয়ে যেত, লাঠির আঘাতে নীল দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল? আবাবিল পাখির পাথর নিক্ষেপ দিয়ে বড় বাহিনী পরাস্ত হয়েছিল? নবীজী এক গ্লাস দুধ দিয়ে অনেক সাহাবী পেট পুরে খাওয়া হয়েছিল? ঈসা আ এর হাতের ছোয়ায় কুষ্ঠ রোগ, অন্ধত্ব ভালো হয়ে যেত? মরা বেচে উঠতো? পুরো অবিশ্বাস করতে না পারলেও দিনে দিনে এসবে বিশ্বাস করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।

 

ক্লাস এইট পর্যন্ত ক্লাসে আরবী আবশ্যিক ছিল- পাশে ছিল অনেক বড় এক মাদ্রাসা- সেই মাদ্রাসার এক হুজুর বাসায় এসে আরবী পড়াতো- বয়সে বছর ৩/৪ বড়, বন্ধুর মতই সম্পর্ক হয়েছিল। তার সাথেও অনেক কথা হতো- মুজিজা নিয়ে কথা বলায় তিনি নিশ্চিত করেন যে- এটাতে বিশ্বাস রাখতেই হবে। তিনি একে একে অনেকগুলো মু’জিজার কথা জানান- একটা বই দেন, যেখানে কোরআনে উল্লেখিত বিভিন্ন মু’জিজার কথা উল্লেখ ছিল। এছাড়া শুক্রবারে জুমার নামাজে মসজিদের ঈমামও প্রায়ই বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার কথা বলতেন। নবী-রাসুলের মু’জিজার ব্যাপারে সন্দেহ থাকতো- কিন্তু পুরো অবিশ্বাস হয়তো তখনো করে উঠতে পারিনি- কিন্তু ঈমাম সাহেব বর্তমানেরও বিভিন্ন জায়গার নানা অলৌকিক ঘটনার বয়ান দিতেন- সেগুলোকে সে সময়েই ভুয়া মনে হয়েছিল। 

 

 

যাহোক, দিনে দিনে সন্দেহ বাড়তেই থাকে। এককালের প্রাণের ধর্ম- গর্বের ধর্ম ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তৈরী হতে থাকে। একটি তো বললাম- বিজ্ঞানের সাথে দ্বন্দ্ব। দ্বিতীয়টি হলো- অন্য ধর্মের প্রতি এর দৃষ্টিভঙ্গি। আগেই বলেছি- আমার বাংলা নাম (হিন্দু! নাম) এর কারণে হিন্দু(!) গালিটা অনেকবারই শুনতে হয়েছে। এমনকি একবার এলার্জীর কারণে বেশকিছুদিন গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ ছিল- সেটার জন্য শুনতে হয়েছে- হিন্দু না-কি? আর এই গালি শুনতে শুনতে এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীদের সাথে মেশা- হিন্দু বন্ধু- খেলার সাথী থাকার কারণে, ওদের প্রতি একটি সফট কর্ণার জন্মে গিয়েছিল- মানে “হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানেরা ভালো” এমন চিন্তাকে খুব খারাপ চোখে দেখতাম। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই আমার মুসলমান বন্ধু/পাড়ার বড় ভাইদের সাথে দারুন তর্ক হতো। যত তর্ক করেছি, দেখেছি আগের চেয়ে আরেকটু ভালো ভাবতে পারছি- অনেক সময় দেখা গেছে, তর্ক করতে করতে এমন একটি যুক্তি করে ফেলেছি- আগে তেমনটি সচেতন ভাবে নিজেও ভাবিনি। এভাবেই শুরু….। বিশেষ করে স্কুলে কয়েকজন বন্ধুর সাথে নিয়মিত তর্ক হতো- সেটা আমার চিন্তাগুলোকে অনেক গুছিয়ে আনতে সাহায্য করে।

তো যেটা বলছিলাম…
ক্লাসের বই এ শিরক সম্পর্কে পড়লাম। টিচার-ছাত্ররা হিন্দুদের মুর্তি নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করলো। প্রাণ নেই- কিছু করার ক্ষমতা নেই- সে আবার দেবতা!!! বিষয়টি ভালো লাগে না। পড়লাম, সবচেয়ে ভয়াবহ পাপ শিরক!! এটার কোন ক্ষমা নেই!! প্রচণ্ড খারাপ লাগলো- কুফরি বা আল্লাহকে অস্বীকার/অবিশ্বাস করলেও মাফ আছে, অন্য ঈশ্বরকে মানলেও হয়তো মাফ আছে- কিন্তু শিরক এর কোন মাফ নেই!!!! এমনটা কেন হবে? এই প্রশ্ন মাথায় আসতে থাকলো। হিন্দু কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম- এরকম মাটির মুর্তিকে পুজা করেন কেন? তিনি বললেন- মাটির মুর্তি হিসাবে তো পুজা করিনা- আসলে তো পুজা করি দেবতাকে। মুর্তি তো মাধ্যম মাত্র। অনেক ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতে দেখি একসময় মনে হলো- আসলে ইসলাম, হিন্দু, খৃস্টানেরা যা পালন করে তা অনুশাসন মাত্র। সেখান থেকেই মনে হলো- এসবে তো কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহকে ডাকতে গেলেও মুসলামনদের কিছু কাজ করতে হয়- নামাজ পড়তে হয়, মসজিদে যেতে হয়, পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়…., তাহলে হিন্দুরা মুর্তি বানিয়ে দেবতাকে ডাকলে দোষ কি? ছোটবেলা থেকে মসজিদকে আল্লাহর ঘর বলে এসেছি- আল্লাহর যদি ঘর থাকতে পারে- তবে মুর্তিতে দোষ কি? ক্লাসে হজ্জের নিয়ম পড়তে গিয়ে দেখি- এখনও কাল্পনিক শয়তানের দিকে পাথর ছুড়তে হয়। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে যদি শয়তানের দিকে পাথর ছুড়া যায়- তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? ক্লাসের ধর্ম স্যার হজরে আসওয়াদের কাহিনী শুনালেন। সেই পাথরে এখনো মুসলমানেরা চুমু খায়, মনে হলো তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? আল্লাহর যদি গণ্ডায় গণ্ডায় ফেরেশতা থাকে তবে ভগবানের দেবতা-দেবী থাকতে দোষ কি? ফেরেশতারা যদি মানুষের রূপ নিয়ে আসতে পারে, তবে এক ভগবান-ই বা বিভিন্ন রূপ নিতে পারবে না কেন?

এমন চিন্তা করা শুরু করেছি, বন্ধুদের সাথে যুক্তি-তর্ক করি; কেউ কেউ ভয়ে আমার সাথে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে আসে না- ধর্ম বিষয়ক কথা শুরু হলেই দেখা যায়- কেউ কেউ কথা বন্ধ করে দেয়- জানায়, এ বিষয়ে নাকি আমার সাথে কথা বলা যাবে না। তারপরেও অনেকের সাথে যুক্তি-তর্ক হতো। এবং এই তর্ক করতে গিয়ে হঠাৎ করেই একজনকে বলে ফেলি- “তুই আজ ইসলামের নামে এত বড় বড় কথা বলছিস- এই তোর জন্ম একটা হিন্দুর ঘরে হলে- মা কালীর নামে তোর মুখ দিয়ে ফেনা ছুটতো!” এটা বলার দেখি আমি চুপ- সেই বন্ধুও চুপ। সে-ও প্রচণ্ড ধাক্কা খায়, আর আমার ভাবনার আরেকটি দিক উন্মোচিত হয়ে যায়….

এই চিন্তাটিই আমাকে আমার ধর্মীয় বিশ্বাসকে দূরে ঠেলে দিতে দারুন সাহায্য করে। আমি মুসলমান কারণ আমার বাবা-মা মুসলমান, পারিবারিক পরিবেশ মুসলমান, জন্ম পরবর্তী সমস্ত কিছুই আমাকে মুসলমান হিসাবে গড়ে তুলেছে। একজন হিন্দু বা একজন খৃস্টানের ক্ষেত্রেও তা-ই। তাহলে আমার আল্লাহ বা অন্যদের ভগবান বা গড এর ভূমিকা কি?

এবারে চিন্তার ক্ষেত্রটিতে ঝড় আসে আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে। সন্দেহ তৈরী হয়- কিন্তু পুরো নিসন্দেহ হতে পারি না….

 

 

চলবে…