খ্রীষ্টধর্মে নারী এবং খ্রীষ্টিয়ান নারীবাদীদের ‘ধর্মকথন’ ।

নন্দিনী হোসেন  

(আমরা জানি যে বর্তমানকালে পাশ্চাত্যে মানুষ ধর্ম নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না । বিশেষ করে ইউরোপে । বরং এখানে ব্যাপক হারে চার্চগুলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে মানুষের ‘ধর্ম’ বিশ্বাস নেই বলে । পরিণতিতে বিশাল বিশাল চার্চগুলো খা খা করে সরব মানুষের উপস্থিতির অভাবে ।    

রোববারেও আজকাল চার্চে খুব কম মানুষই যায় । তারপর ও যারা যায় তাদের মধ্যে নারীর সঙখা বেশী পুরুষের তুলনায় । নারীর মধ্যেও আবার ভাগ আছে – যারা অপেক্ষাকৃত সমাজে পিছিয়ে পরা শ্রেণী বলে ধরা হয়, যেমন শিক্ষায়, অর্থনৈতিক অবস্থানে, অথবা কোন না কোন ভাবে পরিবারে, সমাজে নিগৃহীত, তাদেরই পদচারনা বেশী । যেমন আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বৃটেনের চার্চগুলোতে আফ্রিকান বংশদ্ভোত কালো নারীদের বেশ ভালো রকম উপ্সস্থিতি । যদিও নারী এখানে আর যাই হোক ‘ধর্মের’ নামে অত্যাচারিত হয়না এখন আর । ধর্মের নামে কেউ তাকে এখন আর পুড়িয়ে মারেনা এও সত্যি – কিন্তু, খ্রীষ্ট ধর্মের যে বিশাল প্রাতিষ্টানিক রূপ, তাতে নারী এখনও সিঁড়ির শেষ ধাপেই অবস্থান করে । যাই হোক । প্রারম্ভিক এই কথাগুলো এই জন্য বলা যে, পাশ্চাত্য থেকে ধর্মের প্রভাব অনেক কমে গেলেও এখনও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি । তার জন্য আমাদের আরও কিছুকাল হয়তো অপেক্ষা করতে হবে । নীচের লেখাটি সেই আলোকেই লেখা )      

 


 

আমার আজকের এই লেখায় আলোচনার বিষয়বস্ত হচ্ছে খ্রীষ্টিয় মনোজগতে এবং অবশ্যই ধর্মীয় দৃষ্টিতে নারী অবস্থান ঠীক কোথায় তা দেখা । তাছাড়া খ্রীষ্টিয়ান নারীবাদীরাইবা কিভাবে দেখেন, বিশ্লেষন করেন এই দৃষ্টীভঙ্গি । তার আগে বোঝা দরকার ‘ধর্ম’ ব্যাপারটাতে নারী-পুরূষ ভেদে আকর্ষণের ধরণটা ঠীক কেমন। বলা হয়ে থাকে ‘ধর্মে’ নারী-পুরূষের আকর্ষণ এর কারণগুলো সম্পুর্ণ ভিন্ন । ধর্ম নিয়ে তাই ‘ধার্মিক’ নারী-পুরূষের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ।একথা কম বেশী  সকল  ধর্মের বেলায়-ই প্রযোজ্য ।  পুরূষ যে দৃষ্টিতে ধর্মকে দেখে, তার মধ্যে যে ‘ধর্মবোধ’ কাজ করে, নারীর ‘ধর্মচেতনা’ তা থেকে  সম্পূর্নই আলাদা ।  ধর্মের  প্রকৃতিগত  কারণেই  এটা ভিন্ন হতে বাধ্য ।

খ্রীষ্ট ধর্মের বিষয়ে যেমন Linda Woodhead  খুবই সহজ ভাবে বিষয়টি উপস্থাপণ করেছেন এভাবেঃ   

..the attraction of Christianity to men simply in terms of male self-interest. Christianity benefits men by setting male self-identity on the strongest possible foundation: the image of man is reflected back from God himself. Men also benefit from the way in which the Christian symbolic framework helps the male sex secure a dominant place in society as a whole. It does this not only by legitimating masculine domination, but by de-legitimating female resistance. In addition, Christianity exercises a direct appeal by offering men attractive roles within church life…’

পুরূষের জন্য ধর্ম ব্যাপারটাই দেখা যাচ্ছে পৌরুষত্য ফলানোর ভালোরকম এক উর্বর ক্ষেত্র । যেখানে পেশীবহুল পুরূষের ‘পেশী’কে কাজে লাগানো যায় ধর্মের নামে । ক্রুসেড, জিহাদ বা হলি ওয়্যার ইত্যাদি তো আছেই তা ছাড়াও গীর্জা, মন্দির, মসজিদ সবই পুরূষের নিয়ন্ত্রণে । সবকিছু মিলিয়ে বলাবাহুল্য প্রায় সব ধর্মেই  পুরুষের এক চেটিয়া আধিপত্য চলে আসছে ।

অন্যদিকে আমরা দেখি নারীর আরাধনা অথবা ঈশ্বরভক্তির মধ্যে এক ধরনের ‘রোমান্টিক’ ভাব জড়িয়ে থাকে । ক্ষেত্র বিশেষে তাই নারীর ধর্মে আসক্তি পুরূষের তুলনায় বেশী দেখা যায় । পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর – দক্ষিণ সবখানে একই চিত্র । তারতম্য শুধু মাত্রায় । বিষয়বস্তুতে নয় । আমাদের বিদ্যমান এই সমাজ ব্যবস্থাই আষ্টেপৃষ্টে তা টিকিয়ে রেখেছে এখনও পর্যন্ত ।

 যেমন লিন্ডা নারীর ধর্মে ভক্তি চিত্রিত করেনঃ

Women may be more attracted to the worship of a male God and saviour than men, and the reason is not hard to see. If society encourages women to love, serve, obey, and even worship men, then it is not difficult to transfer such attitudes to a male God…’  

 

সমাজ যখন জন্মের পর থেকে একজন মেয়ে শিশুকে শুধুই কিভাবে প্রশ্নহীন ভালবাসতে হবে তা শেখায়, কিভাবে প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রকাশ করে যেতে হবে শেখায়, আর সেটা যদি আরোপিত হয় ধর্মের নামে তাহলে সমপুর্ণ বিষয়টিই  একটা অন্য মাত্রা পায় ।  তাই দেখি, ‘ধর্মবোধ’ নামক অদ্ভুত এক আফিম নারীর মগজে গেঁথে দেবার কারণে নারীকে বশ্যতা স্বীকারে পুরূষকে তেমন বেগ পেতে হয়নি কোনকালে । নারী যেহেতু মেনেই নিয়েছে, মানতে বাধ্য করা হয়েছে সুকৌশলে, তাই নারীর মাথায় কোন প্রশ্ন জ়াগেনা – কেন ‘গডের’ চোখে তার স্থান শুধুমাত্র পুরূষের আনন্দ দানে, শুধুমাত্র পুরূষের সেবায়, পুরূষের ঘর- গেরস্থালী রক্ষায়?     

 

নারীর মগজে বিঁধে আছে, সে নম্র, সে অনুগত ।পুরূষ নারীর ত্রাতা । তাকে মান্য করেই জীবন যাপন করতে হবে নারীর । তাকে ঘিরেই আবর্তীত হতে হবে ! জীবনে-মরণে পুরূষ আরাধনার ‘ধন’। নারী তাই প্রায় মাতৃক্রোর থেকে পরম্পরায়, পুরূষের আরাধণা করে । জেনে যায় পুরূষ ছাড়া তার নিজের জীবনের কোন মূল্য নেই ! তার জীবনে তাই ‘গডে’র পর ঘরের পুরূষ-ইদিত্ব্বীয় ‘গড’ ! কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকি প্রথম ‘গড’ এর আনুকল্য পেতে হলেও নারীর সরাসরি পাওয়ার ক্ষমতা নেই । দিত্বীয় ‘গড’ তার উপর কৃপা বর্ষালেই কেবল তিনি প্রথম ‘গড’ এর কৃপা পেতে পারেন, নচেৎ নারীর জন্য অনন্তকাল দোজক বাস অবধারিত ! ক’জন নারীর ভিতর ‘গড’ কে  উপেক্ষা করে দৃঢ় পদক্ষেপে পথচলা সম্ভব ? সম্ভব যে নয় এটা পুরূষ ভালোভাবেই জানে । মনস্তাত্বিক ভাবেই নারীকে তাই কাবু করে ফেলা খুবই সহজ হয়েছে ! সেই সহজ পথটিই পুরূষ বেছে নিয়েছে যুগে যুগে । ‘ধর্মের’ বর্ম পরানো হয়েছে পুরূষের কামনা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে ! স্বাভাবিকভাবে হয়ত এতটা সম্ভব হতোনা – নারীর ‘বোধ’কে চিরতরে ‘বোবা’ করে দিতে যে, পুরূষই প্রভু, পুরূষই উত্তম, পুরূষই উৎকৃষ্ট আর নারী চিরকালের অধস্তন, আজ্ঞাবহ, নিকৃষ্ট এক প্রজাতি !    

 

খ্রীষ্টান ধর্মে, বিশেষ করে চার্চগুলোতে বেশীর ভাগ সময়ই আমরা দেখতে পাই, নারীর জন্য বরাদ্দ থাকে সেবার কাজ । আরেকটা মজার ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, আজকাল দেখা যায় চার্চগুলো যত পুরূষশুণ্য হচ্ছে, ততই নারীরা জোরে শোরে ধর্ম প্রচারের এবং প্রসারের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছে ।অর্থাৎ পুরূষতন্ত্র নিজেদের প্রভুত্ব ধর্মের বাতাবরণে টিকিয়ে রাখতে, কৌশলে, সেই নারীকেই আবার কাজে লাগাচ্ছে ! যেহেতু ‘ধর্মরক্ষা’ বলে কথা, তাই তা ধিন ধিন মনের আনন্দে ধর্ম বিমুখ পশ্চিমা মানুষের দরজায় দরজায় ‘বাইবেল’ হাতে নিয়ে কড়া নাড়ছে নারীই ! অথচ চার্চ হায়ারার্কিতে দেখা যায় নারীর প্রায় কোন স্থানই নেই । এত কিছুর পরও, এত সুযোগ সুবিধা দিয়েও পুরূষকে আর চার্চের ভিতর আটকে রাখা যাচ্ছেনা । যে কোন চার্চে অনুসন্ধান চালালেই আজকাল দেখা যাবে নারীদের আধিক্য ।

 

এটা বললে অতুক্তি হবেনা যে, নারীই মূলত আজকের চার্চতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে প্রবলভাবে । তারপরও চার্চ তন্ত্রের ঊচূধাপে তাদের স্থান নেই । নারীকে প্রিষ্ট করার জন্য লড়াই করতে হয় । Sacred text আর Tradition এর দোহাই তুলে নারীর দাবীকে অবজ্ঞা করা হয় । রোমান ক্যাথলিক চার্চে নারীর অবস্থান নির্ধারণের প্রশ্নে John Paul II অনমনীয় থেকে তার সমর্থনে তুলে ধরেন খ্রীষ্ট ধর্মের সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং ঐতিহ্য । তিনি দোহাই পারেন ‘God’s eternal plan’ বলে ! তিনি প্রমান হাজির করেন ‘জেসাস’ এর কর্মকান্ড থেকে । বলেন জেসাস পুরূষ কে বেছে নিয়েছেন, নারীকে নয় । যার সাক্ষী ছড়িয়ে আছে , বিভিন্ন Biblical passages গুলোতে । তিনি আরেকটি বিষয়ের দিকেও নিজের যুক্তিকে শাণিত করার প্রয়াস নেন,যেখানে ‘গডে’র ইচ্ছা বা প্ল্যান পরিস্কাররূপে ধরা পরে । তাঁর ভাষায় মেরী অর্থাৎ জেসাসের মাতাও  যেখানে,  

Received neither the mission proper to the Apostles nor the ministerial priesthood’ (John Paul II, 1994, 129).’

এতএব সাধারণ কোন নারী প্রিষ্ট হতে চাওয়ার কোন যুক্তি নেই, যেখানে স্বয়ং ‘গড’ই তা অনুমোদন করেননি !     

 তাছাড়াও খ্রীষ্টীয় সমাজে নারীর অবস্থান পরিস্কার রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে যে Passage গুলোতে, সেগুলো বর্ণিত হয়েছে Apostle Paul এর চিঠীগুলোতে – যা তিনি প্রাথমিক যুগের খ্রীষ্টীয় সমাজের জন্য লিখেছিলেন , যা নিউ টেষ্টামেন্ট এর অন্তরভুক্ত ।   

তাছাড়া নারীর প্রতি অন্যযে আদেশ নির্দেশ গুলো ধর্মের নামে জারি করা হয়েছিল, তার দু’একটি উদাহরণ নীচে দেখা যাকঃ

Head coverings প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ

‘…. I want you to understand that Christ is the head of every man, and the husband is the head of his wife,……….Indeed man was not made from woman, but woman for man. Neither was man created for the sake of woman, but woman for the sake of man. For this reason a woman should have a symbol of authority on her head’. (1 Corinthians 11:3-10)

নারীর Prayer সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

‘ I permit no woman to teach or to have authority over a man; she is to keep silent . For Adam was formed first, then Eve; and Adam was not deceived, but the woman was deceived and became a transgressor. Yet she will be saved through childbearing, provided they continue in faith and love and holiness with modesty’.   (1 Timothy 2:8-15)

 ধর্মের যাঁতাকলে নারীকে পিষে ফেলার কি চমতকার কলা-কৌশল !

অন্যদিকে Feminist Critic রা যে তিনটি মূল সমস্যাকে দায়ী করেছেন খ্রীষ্টান ট্রেডিশণে নারীর অবস্থান ব্যাখ্যা করে সেগুলো হচ্ছেঃ

First women are excluded from the full practice of the religion because of the male-oriented language of the tradition.

 Secondly, images of the divine…are male.

Thirdly there is a male monopoly of ritual and public roles.’  (Mumm, 2001, 128)

তাছাড়া নারীর ইমেজ সৃষ্টিতে শুধু চার্চই নয় -শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খ্রীষ্টিয়ান পুরূষ লেখক-শিল্পীদের ভূমিকাও ব্যাপক । তারা ক্রমাগতভাবে তাদের কাজে নারীকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করেছেন – যা ধর্মে বর্ণিত নারীর সেকেন্ডারী অবস্থানকেই সমর্থন করেছে । যেমন Drury উল্লেখ করেছেনঃ

 ….ideas about the role of women in Christian communities have been shaped by male writers and artists who ‘chose to emphasise teaching that was negative towards women’ in order to assign them to ‘a secondary position within the Church…’  

পুরূষ লেখক শিল্পীদের সৃষ্টিতে মেরী এবং ইভের প্রতিকৃতি একটু দেখা যাক। বলা হয়ে থাকে,  লেখক শিল্পীরা বহুলাংশে দায়ী খীষ্টীয় সমাজে ‘নারী’র অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে । নারীর চরিত্র চিত্রনে পুরূষের ধারণানুযায়ী জোর করে ‘আরোপিত’ কিছু ব্যাপার লক্ষ্য করার মত । ধর্মের নামে অতি সুকৌশলে নারীর পজেটিভ/নেগেটিভ ইমেজ তুলে ধরতে মেরী এবং ইভকে বেছে নেওয়া হয়েছে । যত ভালো সব মেরী, যা কিছু খারাপ সব ইভ । অতএব পুরূষতান্ত্রিক সমাজ মেরীকে মহিমানবিত করে নানা গুণ আরোপ করে, যে গুণ থাকলে পুরূষতন্ত্র বহাল  তবিয়তে বজায় থাকে , কেউ কোন প্রশ্ন করেনা । পুরূষ যা বলে তাই শুনে । স্বয়ং ‘গড’ এর প্রতিনিধি পুরূষের সেবা করে, সংসার ধর্ম পালন করে, সন্তান লালন পালন করে । এই নারীর রূপকল্প পুরূষের বিশেষ পছন্দ ।এই নারীকে তাই দেবী বানাতেও তার আপত্তি নেই । অন্যদিকে ইভ হচ্ছে নারীর ‘ইভিল’ চরিত্র । যত নষ্টের গোড়া । এই নারীকে বশে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য । তর্ক করার সাহস দেখায় , পুরূষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভয় পায় না । ‘ইভে’র প্ররোচনায় জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেয়ে আদি পিতা এড্যাম স্বর্গচ্যুত হয়েছিলেন – অল্ড টেষ্টামেন্টে বর্ণীত জেনেসিসের এই ‘মিথ’ খ্রীষ্টান ‘জনমানসে’ গভীর ভাবে প্রোথিত হয়ে আছে – তাই আমরা দেখতে পাই ‘ইভ’ এর চরিত্রকে লোভী, চাতুরীপূর্ণ এবং খল হিসেবে উপস্থাপন করা হয় বাব বার । উপস্থাপণ করেন সমাজের সেই সব পুরূষেরা, যাদের আপাত দৃষ্টিতে যে কোণ সমাজ প্রগতির ধারায় অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।

নীচের দু’টো  ছবি পাশাপাশি রেখে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বিষয়টির সত্যতা বোঝা  যাবে ।

 

(Madonna and Child. Jacopo Bellini )

 

 

যে বৈপরীত্যটি এখানে পরিস্কাররূপে ধরা পরে তা হচ্ছে, মেরী আপাদ্ মস্তক অবগুন্ঠীতা, অন্যদিকে ইভ সম্পূর্ণ নগ্ন । (যদিও ইভের নগ্নরূপ নিয়ে একটা যুক্তি দেখানো হয়, আর তা হচ্ছে, জেনেসিস অনুযায়ী প্যারাডাইসে কোন কাপড়ের অস্তিত্ব ছিলনা ) তারপরও ইভের ছবিতে কামাতুর, যৌনতার প্রতিক, লোভী  এক নারীর চিত্র ফুটে উঠেছে – যা মেরীর একেবারেই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে । মেরী নম্রতার প্রতীক, নীরবে, নিশঃব্দে কোলের বাচ্চাকে ধরে আছেন । ইভের প্ররোচনায় এড্যাম জ্ঞান বৃক্ষের ফল ভক্ষন করে প্রথম পাপ করেন । নারী তাই পাপের ও প্রতীক !

‘ Eve is the one who is tempted by the serpent to eat the forbidden fruit of the tree of knowledge; she is the one who   offers the fruit to Adam, which results in their expultion from the garden of Eden. In fact, the figure of Eve has been strongly associated with temptation, sin, evil, death and the dangers of feminine sexuality’(Bullough, 2000, 24).

অন্যদিকে জেসাস এর কুমারী মাতা মেরী ‘হলি স্পিরিট’ এর দ্বারা গর্ভবতী হন –  প্রায়শ-ই দেখা যায় ছবিতে তিনি আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত হয়ে ,শিশু জেসাস কে দুই হাতে ধরে থাকেন। যা মেরীর বহুল ভাবে প্রচারিত, এবং অতি অবশ্যই খুবই জনপ্রিয় ইমেজ । শুধু জনপ্রিয়ই নয়, মেরীর এই নিষ্পাপ, নারীর আর্দশ  ইমেজ খ্রীষ্টান চিন্তাধারায়, আর্ট, লেখা এবং কর্মে ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তারকারী । খ্রাইষ্ট কে যেমন ‘দিত্বীয় এড্যাম’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি  মানবজাতিকে তার পাপ হতে রক্ষা করতে অবতীর্ণ হয়েছেন – ঠিক তেমনি, মেরীকে দেখা হয় ‘সেকেন্ড ইভ’ হিসেবে, যেমন Murray and Murray এর বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই, যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এভাবেঃ 

 ‘ ….Mary has been regarded as the ‘Second Eve’. Through Mary’s chastity and motherhood the sins of female sexuality represented by the figure of Eve are redeemed’ (Murray and Murray, 1998,3).   

যাই হোক । নারীর আদর্শ হিসেবে ভার্জিন মেরীর যে শক্তিশালী ‘আইকন’ দাঁড় করানো হয়েছে, এবং তার যে প্রভাব তা আজ আর সবই পজেটিভ হিসেবে দেখছেন না বর্তমান কালের সমালোচকেরা । তারা বলছেন মেরীর সাথে নারীর যে ‘ভালো’ ইমেজ জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তার সবটুকুই গ্রহণ্যযোগ্য নয়, তাতে অবশ্যই সীমাবদ্ধতা আছে, আর তাছারা নারীকে এমন ভালো হিসেবে দেখানোর মানে হচ্ছে ‘অবাস্তব দাবী’ ! যেমন Drury ভাষায়ঃ

‘The ideal she presents of perfect mother as well as of spotless virgin has always had its negative aspects for women as well. It is an impossible ideal for a human mother to live up to. Feminists argue that that is partly why celibate male priests have encouraged it for so long: women can never attain the ideal of redeemed womanhood as presented by the virgin mother and feel confident in their femininity. The ideal is unattainable. (Drury, 1994, 52)

এবার আমরা চোখ ফেরাতে পারি নারীবাদীরা খ্রীষ্টিয়ান ‘ধর্মে’ নারীর অবস্থানকে কি ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং এ সম্পর্কীত তাদের ধারণাটাই বা কী? কোন কোন রেডিক্যাল ফেমিনিষ্ট যেমন Mary Daly (1985), Daphne Hampson (1990) এবং Carol P. Christ (1988) এর মত কেউ কেউ মনে করেন ‘নারীবাদী’ ধারণার সাথে খ্রীষ্টিয়ান ধর্মের অবস্থান পুরোপুরি সাংঘর্ষীক । তাদের বক্তব্য এবং বিশ্বাস এরকমঃ

‘ even the core teachings of the [Christian tradition] are so contaminated by sexism and patriarchy that they cannot be cleansed; to eradicate patriarchy from [Christianity] would be to dismantle the [religion itself’ (Mumm, 2001, 135).’

অন্যদিকে কেউ কেউ আবার বিশ্বাস করেন যে নিউ টেষ্টামেন্টের অন্তভুর্ক্ত কিছু কিছু ‘বিষয়’ আসলে নারীর জন্য অনেক বেশী ‘রেডিক্যাল’ । বিশেষ করে যখন সমসাময়িক পটভুমিকায় সেটা বিচার করা হয় । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চার্চ পুরূষতন্ত্রের কব্জায় থাকায় নারী তার প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি বলে তাদের ধারণা । যাদের এমন ধারণা, তাদের মধ্য Rosemary Radford Ruether, Elisabeth Schussler Fiorenza প্রমূখ অন্যতম । Rosemary তার Sexism  and God-Talk (1983) গ্রন্থে gospels এ বর্ণিত নারীর অবস্থান নিয়ে প্রচলিত ধারা থেকে ভিন্নভাবে ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন । তিনি বলতে চেয়েছেন, তৎকালীন সমাজে, এবং ধর্মে নারীর প্রতি প্রচলিত বৈষম্য জেসাস ‘সাপোর্ট’ করেননি – বরং তিনি তা বদলাতে চেয়েছিলেন । Redford যুক্তি দেখিয়েছেন এই বলে যে, জেসাস সমাজে তার অবস্থানকে ( Son of God and Messiah) ব্যবহার করে বাড়তি সুযোগ গ্রহণ তো করেনইনি বরং, প্রচলিত ইহুদী ইমেজ বদলাতে চেয়েছিলেন । যেমন সেখানে Messiah কে king হিসেবে গণ্য করার প্রথা প্রচলিত ছিল ।

Radford Ruether এর মতে, নারী প্রথাগত ভাবেই সমাজে পুরূষ দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছিল – সমাজে তাদের স্থান ছিল পুরূষের চেয়ে অনেক নীচু স্তরে । ‘জেসাস’ তা থেকে বরং নারীকে ‘মুক্ত’ করেছেন  এই বলে যে, ‘ Last shall be first and the first be last’ যা একান্তভাবেই নারীর জন্য প্রযোজ্য । নারীই সমাজের একেবারে নীচু স্তরে অবস্থান করে – সর্বক্ষেত্রেই । যেমন তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেছেন এভাবেঃ

‘ Among the poor it is the widows who are the most destitute. Among the ritually unclean, it is the women with the flow of blood who extorts healing for herself contrary to the law. Among the morally outcast, it is the prostitutes who are the furthest from righteousness. The role played by women of marginalized groups is an intrinsic part of the iconoclastic, messianic vision. It means that the women are the oppressed of the oppressed. They are the bottom of the present social hierarchy and hence are seen, in a special way, as the last who will be the first in the kingdom of God.’

 

তাছাড়া, নারীবাদী স্কলার Elisabeth গুরুত্ত্বারোপ করেছেন খ্রীষ্টিয়  সমাজের প্রাথমিক যুগে নারীর যে ভূমিকা ছিল, তার উপর । তিনি তার বই Discipleship of Equals  এ যুক্তি দেখিয়েছেন যে Early Christian movement  এ নারীর ভূমিকা ছিল পুরূষের-ই পাশাপাশি । শুধু তাই নয়, তিনি এমনকি অস্বীকার করেছেন যে কোন ধরণের বৈষম্য এর অস্তিত্বও – যেমন, লিংঙ্গভেদ , ধর্ম, জাত, অথবা শ্রেণীর মধ্যে কোন বিভাজন রেখা ছিল । তখনকার সমাজে নারীর ভূমিকা উল্লেখ করতে গিয়ে বিশেষ করে Mary Magdalene এর ভূমিকা তুলে ধরেছেন এভাবেঃ

     ‘ ……  That these women were not left anonymous but identified by name suggests that they played an important role in the Christian movement in Palestine. Their leader appears to have been Mary Magdalene since all four gospels transmit her name, whereas the names of the other women vary.  

তাছাড়া, তিনি এও দেখিয়েছেন যে Paul  এর মতানুযায়ী যেহেতু মাত্র বারোজনের মধ্যেই Apostleship সীমাবদ্দ্ব নেই – বরং,

All those Christians are apostles who were eyewitnesses to the resurrection and who were commissioned by the Resurrected one to missionary work.  এরই সূত্র ধরে Elisabeth বলতে চেয়েছেন যে,

        ‘ Women accompanied Jesus from Galilee to Jerusalem and witnessed his death (Mark 14:40). Moreover, women were according to all criteria of historical authenticity the first witnesses of the resurrection…’

Elisabeth এর মতে খ্রীষ্টিয় ধর্মে নারীর স্থানচ্যুতি ঘটে আরও পরে, যখন থেকে তখনকার সমাজে প্রচলিত সংস্কৃতি ধর্মের মধ্যে একাকার হয়ে যায় । এই ব্যাপারটি অবশ্য সব কালে সব ধর্মেই ঘটেছে । ‘ধর্ম’ যখন যে ভৌগলিক সীমানায় আবির্ভুত হয়েছে, তখন অবধারিত ভাবেই সেই সমাজ, সংস্কৃতির নির্যাস টুকু সেই ধর্মে আত্বস্ত করে নিয়েছে । তিনি  নারীর পতনের জন্য আরও দায়ী করেছেন চার্চ হায়ারার্কী সিষ্টেম চালু হওয়া এবং এর পুরূষতান্ত্রিক প্রথাকে । তার মতে, যার ফলে নারী অনেকটা বাধ্য হয়েছে ঘরের কোণে আশ্রয় নিতে ।  তিনি বলেনঃ  

‘This process was bound to eliminate more and more women from ecclesial leadership roles and had to relegate them to subordinate ‘feminine’ tasks. The more Christianity adapted to the societal and religious institutions of the time and, thus, became a genuine segment of its patriarchal Greco-Roman culture and religion, the more it had to relegate women’s leadership to fringe groups or to  limit it to roles defined by gender.  ‘

পরিশেষে আরেকটি বেশ ইণ্টারেষ্টিং বিষয় উল্লেখ করে এ লেখা এখানেই ইতি টানবো । এদের উপস্থাপনাটা আমার কাছে বেশ বৈশিষ্টপূর্ণ বলেই মনে হয়েছে ।  Asian Christian Women  নামক সংগঠনটির এক Conference  অনুষ্টিত হয় ১৯৮৭ সালে সিংগাপুরে । সেখানে যে পেপার উপস্থাপিত হয়েছিল,  তার বিষয়বস্তু কিছুটা তুলে ধরবো এখানে । মূলত  সেখানে মেরীর ইমেজ পুনরোদ্ধারের ব্যাপারটিতে আলোকপাত করা হয় । যে ইমেজ তাদের ভাষায় ‘hijacked by patriarchal churches’. যাই হোক  পেপারটিতে বলা হয়ঃ

Each of us, within our own culture, has found different strengths in the process of reclaiming and redefining  Mary. We can look at Mary the mother and see her womb as the place of the action of the Holy Spirit – a place of struggle and suffering which brings new life…….if we understand the virgin birth as the beginning of a new order, in which patriarchy can no longer be the basis of human life,……..We too must participate in changing oppressive relationships and cultural symbols- overcoming patterns of domination and subordination between north and south, rich and poor, male and female, black and white.’

তারা আবার সাবধানও করে দেন এই বলে যে,  

If feminist theology is concerned only with sexism, and not with the liberation of the whole human race, it too is oppressive.

 

পরিশেষে যেটা বলতে চাই তা হচ্ছে, ‘ধার্মিক’ নারীবাদীরা যে ধর্ম থেকেই আসুন না কেনো  – পুরূষের সাথে ঈশ্বর ভক্তিতে তাদের সহাবস্থান বেশ পোক্ত-ই বলা চলে  । অন্তত আমি নিজে যখন বিষয়টা নিয়ে ভাবি, তখন এক ধরণের কৌতুক বোধ করি । শুধু আমি কেন, সচেতন যে কেউ কৌতুক বোধ করবে । দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মের নারীবাদীরা নিজেদের  অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সেই ‘ধর্মে’র দরজায়-ই মাথা কুটে মরেন ! যেখানে ধর্মে নারীর অধিকার পুরূষের সমান তো দূরে থাক – প্রায় উপেক্ষা করা হয়েছে, সেখানে নারীবাদীরা প্রায় গায়ের জোরে ‘ধর্মের’ ভিতরে থেকেই সমান অধিকার আদায় করতে চান ! যা আসলে কোন ধর্মই স্বীকার করেনা, করার কারণও নেই । আপাদমস্তক পুরূষতান্ত্রিকতার মধ্যে জন্ম, বেড়ে উঠা এবং এখনও পর্যন্ত প্রবলভাবে পুরূষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন ধর্মে নারীর জন্য সুখবর না থাকাটাই স্বাভাবিক । আসলে সমস্যাটা কি নারীর নিজের-ই মনোজগতে ? যে সমস্যার মূলে আবার সেই পুরূষেরই অতি যত্নে লালিত চিন্তাধারা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে । নারীকেই এবার বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে । তার নিজের  সার্বিক মুক্তি আদৌ কোন পুরূষের ধর্ম দিতে পারে কি না ।

 

 

নারী যেনো পণ করেছে, যত প্রগতিশীলই হোক, নিজে কিছুতেই ধর্মের ‘শেকল’ ছিড়ে বেরুবেনা । তাহলে নারীর মুক্তি কোথায়? ছিটেফোটা অধিকার কোন ধর্মে কতটুকু আছে তা নিয়ে বিতর্কে যাওয়ার কোন আগ্রহ আমার নেই, এ এক বিস্বাদিত চর্বিত চর্বণ ! অসহায়ের মত শুধু দেখছি – আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে, মধ্যযুগের ধর্ম আকড়ে থাকা নারী বেশীদূর এগুতে পারছেনা । কারণটা হচ্ছে, কোথাও না কোথাও গিয়ে, ধর্মের রক্ত-চক্ষুর কাছে নারীকে নতিস্বীকার করতেই হচ্ছে ।  বিভিন্ন ধর্মের নারীবাদীরা, ধর্মের খোলস গায়ে চাপিয়ে রেখে ‘অধিকার’ আদায় করতে চান, সেই পুরূষতন্ত্রের কাছেই ! এ একধরণের ভাবালুতা ছাড়া আর কিছুই নয়।  নারীর ঈশ্বর ভক্তির ‘রোমান্টিক’ এ শেকল ভাঙ্গা ছাড়া মেরুদন্ড সোজ়া করে দাঁড়ানো এক অসম্ভব ব্যাপার । তাও ভাংতে হবে, সমাজের মূল স্রোতে ভেসে চলা, নানাভাবে পিছিয়ে পরা নারীদের-ই ।

  

 

সুত্রঃ

Linda Woodhead, Christianity, Oxford University Press (2004)

Drury, C. (1994) Women in Religion, London, Printer Publishers

Murray, P. and L. Murray (1998) The Oxford Companion to Christian Art and Architecture, Oxford and New York, Oxford University Press.

Redford Ruether, R (1983) Sexism and God-Talk, London, SCM

Schussler Fiorenza, E. (1993) Discipleship of Equals: A Critical Feminist Ekklesia-logy of Liberation, London, SCM

Ursula King (ed.) Feminist Theology from the Third World (London:SPCK/Orbic, 1994)

Mumm, S. (2001) ‘What it meant and what it means: feminism, religion and interpretation’, in D. Herbert (ed.)

  


 নন্দিনী হোসেন,  সাতরং আন্তর্জালের প্রতিষ্ঠাতা, এবং লেখক।  বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক এবং সাপ্তাহিকে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ইমেইল – [email protected]