বিপন্ন সময়ে কয়েকটি মুখ

 

লুনা শীরিন

 

সময়টা ২০০২ থেকে ২০০৪, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি দুঃসময় অতিক্রম করছেচারিদিকে  সাধার মানুষের অসহায়ত্ব লক্ষনীয়, রাজনীতিতে চলছে অবক্ষয়, মৌলবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিয়েছেসাধার  মানুষ বোধহীনভাবে দিন পার করছে, প্রজন্ম থেকে  প্রজন্ম  গড়গড়িয়ে শিখে যাচেছ  বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর ইতিহাসমেধাবী ছেলেমেয়েরা অনায়াসে আপোষ করছে নীতিহীন সময় ও রাজনীতির সাথে

 

সময়টাকে উল্লেখ করা দরকার ছিলো, কারন প্রতিকুল সময়ে যারা সাহসের কথা বলেন, তিহাসের কথা উচ্চার করেন, শক্ত হাতে হাল ধরে থাকবার জন্য সাহস যোগান তারাই স্রোতের বিরুদ্ধে দাড়ানো মানুষ, তারাই সমাজের সত্যিকারের ভিশত সহস্র অভিবাদন সেই যোদ্ধাদের জন্য

 

২০০২ সালের কোন এক মাস, আজ এতদিন পরে দিনক্ষন মন নেই, পস্ট মনে পড়ে অগ্রজ  সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সাথে বাংলা একাডেমিতে যাচ্ছি, তিনি বরাবরই আমাদের মতো তরুদেরকে বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়েছেন আর সেই কারনেই হয়তো আমাকেও ফেরাননিআমি সেলিনা হোসেনের  কাছে প্রস্তাব তুললাম কয়েকজন গুণীর ব্যাক্তিগত সাক্ষাৎকার নিতে চাই, খুব খোলামেলা কথা বলতে চাইপ্রাথমিকভাবে  প্রস্তাবিত নাম ছিলো আমার প্রিয় শিক্ষক দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক খান সারোয়ার মুরশিদ এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রথম নারী মন্ত্রী বেগম নুরজাহান মুরশিদতিনি রাজী হয়েছিলেন এবং  সেই থেকে শুরু  একটা দুটো দিন বা মাস নয়, সেলিনা হোসেনকে এবং আমাকে দিতে হয়েছে দুই বছর, এই দুই বছরে  সাক্ষাৎকারগুলো নেবার জন্য আমরা (সেলিনা হোসেন এবং আমি) কি কি করেছি, কিভাবে সময় বের করেছি, কত কত কথা/প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে,পথে পথে হাটতে আরো কত প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে, রের্কডের বাইরে কি কি ঘটেছে  সবকিছু নিয়ে হয়তো আরো বড় ভলিউমে কোন বই ছাপানো যেতকিন্তু সে প্রসঙ্গ এখানে নয় বরং এই ধারাবাহিক লেখার প্রতিটি পর্বেই সে সম্পর্কে ছোট করে কিছু লিখবো আশা করছিঅন্যদিকে  সাক্ষাৎকারের কাজটা করার ক্ষেত্রে কি কি চ্যালেন্জ ছিলো তা বরং আজ  চার বছর পরে নিমোর্হভাবে বলতে পারি

 

·        আমি ছাড়া অন্য সবাই বাংলাদেশে বিখ্যাত মানুষ সুতরাং তাদের সময় নিয়েই আমাকে সময়  বের করতে হয়েছে যেটা সমন্বয় করা ভীষনভাবেই কঠিন ছিলো

 

·        সেলিনা হোসেন ছাড়া এই কাজ  সম্ভব ছিলো না কারন তার সহযোগিতা ছাড়া কেউ এগিয়ে আসতেন না

 

·        শুরু থেকেই কথা ছিলো কাজটার ব্যাপারে আর্থিক সব দায়িত্ব আমার থাকবে ,আমি শুরু করার পরে বুঝতে পেরেছি জীবনের কোন প্রাপ্তিই কষ্ট ছাড়া আসবে না ,কিন্তু সত্য্ইি আমার ব্যাক্তিগত জীবনেও তখন নানান টানাপোড়েন ছিলো বলেই কাজটার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ও মনোযোগ দিতে হয়েছে।

 

·        নুরজাহান মুরশিদ আমার খুব কাছের মানুষ, আমাদেরকে সাক্ষাৎকার দেবার পরের  সপ্তাহে  উনি মারা যান, অধ্যাপক খান সারোয়ার মুরশিদ এমনভাবে ভেঙে পড়েন যে আমাদের কাজটা বেশ পিছিয়ে যায়, কাজের গতি ধরে রাখাটা খুব কঠিন ছিলো

 

·        সব বৈরীতার ভিতর সেলিনা হোসেনের সহযোগিতা ছিলো বলেই কাজটা শেষ করা সম্ভব হয়েছে 

 

এরকম নানান প্রতিকুল সময়ের ভিতর দিয়েই আমার  কানাডা আসবার ব্যাপারটা চুড়ান্ত হয়ে গেলো, সাক্ষাৎকারগুলো নিয়ে বই প্রকাশের উদ্যোগটা যেন সেদিনই নিভে গিয়েছিলো

 

এরপরের কথা পাঠক কিছুটা জানেন যারা অন্তত আমার বাসুন ধারাবাহিকটা পড়েছেন,আমি গত চারবছরে মন খুলে নিঃশ্বাস নেইনি কারন আমার কাছে তখন ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়নতুন দেশে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আমি আবার জীবনযুদ্ধে অংশগ্রহন করি

 

মানুষই মনে হয় সব রহস্যর একমাত্র আধারপ্রবাস জীবনের এই চারবছরে অনেক  প্রিয় বিযয় বলি দিয়েছি, মোট চারবার বাসা বদল করে অনেক অনেক সাধের এবং  প্রিয় জিনিস টেনে বেড়াবার মতো ইচ্ছের কাছে আত্মসর্মপন করেছি আমি কিন্ত মেট্রিক/ইন্টামিডিয়েট এর সার্টিফিকেট এর মতো এই  সাক্ষাৎকারের কপিগুলোকে আগলে থেকেছি বছরের পর বছর স্বপ্ন দেখেছি একদিন আমি এই  কাজটাকে আলোর মুখ দেখাতে পারবো

 

২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ফ্লোরিডা গিয়েছিলাম, জীবন আমার কাছে খন একটু সহনীয়আমি মন খুলে ভাবতে পারি, ফোনে কথা বললাম সেলিনা হোসেনের সাথে, মুক্তমনা ওয়েবসাইটের মডারেটর ফরিদ আহমেদের সাথেও কথা হলো সেই সময়সেলিনা হোসেন  বার বার বললেন, লুনা লেখাটা তোমার নামেই যাকনা, আমার নামে লেখা কেন যাবে? আমি তো কাজটা একা করিনি, বরং ২০০৪ সালেই ঢাকা থেকে সবগুলো সাক্ষাৎকার সেলিনা হোসেন সহ আমি বই বের করার জন্য চুড়ান্ত  করেছিলামআজকে টরোন্টো শহরে  আমার শুন্য ঘরে  ফেলে আসা কিছু অসাধারন সময়, সময় বয়ে গেছে অনেক, সেলিনা হোসেন সহ অন্য সবার আন্তরিকতা দিয়ে ভরে থাকা কিছু স্মৃতি যে আমাকে কি  ভীষণ আনন্দ  দিচ্ছে তারই  কিছুটা আনন্দ ভাগ করে নিতে চাই মুক্তমনার পাঠকদের সাথে পাঠকের মতামত কাজটার গতি নিয়ন্ত্র করবে  এই পর্বের অতিথি ঢাকা  বিশ্ববিদ্যলিয়ের প্রবীন শিক্ষক  খান সারোয়ার মুরশিদ  

 

খান সারোয়ার মুরশিদ(খাঃসাঃমু)

 

খান সারোয়ার মুরশিদ ঢাকা, নটিংহাম এবং হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, ১৯৪৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যর শিক্ষক হিসেবে কর্মরত তিনি জীবনের কিছুকাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রদূত এবং কমনওয়েলথ এর সহকারী মহাসচিব হিসেবে কাজ করেননিউভ্যালিউজ নামে একটি ইংরেজী সাময়িকীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক (১৯৪৯  – ১৯৬৫)  এবং বাংলা সাহিত্য বিষয়ে ইংরেজীতে দুটি  এবং বাংলায় একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেনতিনি বাংলা একাডেমীর একজন সন্মানসুচক ফেলোউল্লেখ্য অধ্যাপক মুরশিদের পরিচয় দেশের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ  ও পন্ডিত হিসেবে পাকিস্তানী আমলে  রবীন্দ্রবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধসহ এদেশের  সাংস্কৃতিক স্বাধীকার সংগ্রামে তার অগ্রণী ভুমিকার কথাও আমাদের ইতিহাসের অর্ন্তভূক্তপঠন পাঠনের তুলনায়  তার রচনার পরিমান কমঅন্যদিকে মৌলিক কাজ হিসেবে ইংরেজী কবি ইয়েটস ও রবীন্দ্রনাথের তুলনামুলক আলোচনা যেমন করেছেন তেমনি লিখেছেন ইয়েটস এর কবিতায়  নারী ও ইশ্বর নিয়ে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা,আদ্রেঁ মালরো, শেখমুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ, তাজউদ্দিনের স্মৃতিচারন ইত্যাদি নানা বিষয়ে লেখকের রয়েছে মৌলিক রচনা

 

প্রফেসর খান সারোয়ার মুরশিদ নাম উচ্চারণেই রুচি ও সংস্কৃতির যে সংম্রিশ্রিত রূপটি  ভেসে উঠে সাক্ষাৎকারটির মাধ্যমে পাঠক সেই অনুভূতির আস্বাদ পাবেন আশা করছি

 

সেলিনা হোসেন(সেঃহোঃ)—  আজকে আমাদের  সাথে আপনি অনেকটা  সময় দেবেন বলে যে সম্মত হয়েছেন সেজন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদআমরা আপনার কাছ থেকে অনেকগুলো বিযয়ই জানতে চাইকিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো ? আপনার কি কোন মত আছে?

 

খাঃসাঃমুঃ —  তোমরা আমাকে ডেকেছো আমার সাথে কথা বলবে বলে,সেটা জেনেই এসছি (ভীষন আত্বতৃপ্তি নিয়ে) কোথা থেকে শুরু করবে,আদৌ শুরু করবে কিনা,বা শুরু করলেও তা শেষ করবে কিনা এগুলো সবই তোমাদের উপর সোপর্দ বরলাম। (তিনি প্রশ্রয়ের ভংগিতে হেসে উঠেন)

 

সেঃহোঃ  —-   ঠিক আছে স্যার,তাহলে আপনার ছোটবেলা থেকেই শুরু করুন আপনার শৈশব কৈশোর এর কথা বলুন সেই সময়ের দৃষ্টিভংগি,যে শহরে বেড়ে উঠলেন সেখানকার কথা, আপনার পরিবারের কথা ইত্যাদি দিয়ে শুরু করুন

 

খাঃসাঃমুঃ—- ছিলাম একটা ছোট শহরে যেটা অনায়াসে গ্রাম হয়ে যেত অবার ছোট শহরের চরিত্র ফিরে পেতআমি আমার ছোটবেলায় সেই সাবডিভিশনাল শহরের রাজপুরুষকেও দেখেছি আবার শহরের দরিদ্রতম  মানুষটিকেও দেখেছি আমার  শহরের  নাম ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়াপৈত্রিক নিবাস ছিলো নাসিরাবাদ, নবীনগর থানায়বিভিন্ন কারনেই আমাদের আদি বাড়ির সাথে আমাদের সম্পর্কটা একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ফলে বাবা শহরমুখি হয়ে যান কার হিসেবে বলা যায়  আমার দাদা আবার বিয়ে করেছিলেন তাই বাবার টানটা বাড়ির প্রতি একটু কমে গিয়েছিলো তবে আমি দুতিনবার গিয়েছি আমার দাদা বাড়িতে সেখানকার স্মৃতি খুব উজ্জল হয়ে মনে ফুটে আছেশহরটাতে একটা সাবডিভিশনাল হেডকোয়াটার ছিলো, একটা হাইস্কুলও ছিলো, দু-একটা ভালো রাস্তা ছিলোবিত্তশালী পরিবার ছিলো, পাশাপাশি ক্ষয়িষ্ণু  মুসলিম পরিবারও ছিলোতারা দরিদ্র, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলো না, আবার মনের দিক থেকেও দারিদ্র ছিলো বলে আমার বিশ্বাসকারন তাদের অনেক আচরনেই আমি  কষ্ট পেয়েছিসেই একই কারনে আমার পিতার কিছু আচরনও আমার মনে বিরুপ  প্রতিক্রিয়া ফেলেযেমনএরকম একটা সমাজের কথা আমি বলছি, সেখানে আমার প্রতিবেশী কারা ছিলো? নিম্ন বেতনভুক্ত সরকারী কর্মচারী , কিন্তু তাদেরও আকাশ চুম্বি অহমিকা যে তারা অভিজাতকিন্তু অভিজাতের অন্যতম নির্দেশক হচ্ছে ধনসম্পদ ও শিক্ষা, এই দুটোর কোনটাই তাদের ছিলো নাকিন্তু ওই শহরেরই বিশেষ একটি শ্রেনীর অভিজাতের প্রতি একটি আসক্তি ছিলো, যে আসক্তি থেকে তারা দুর্বলদের প্রতি অবহেলা এবং নিষ্ঠুরতা দেখাতো এই বিষয়গুলো আমি কিশোর বয়স থেকেই দেখে এসেছি আমার ছেলেবেলায় কষ্ট পাওয়াটা তখন থেকেই শুরু হয়

 

লুনা শীরিন (লুঃশী) আপনার বয়স তখন কেমন ছিলো?

 

খাঃসাঃমুঃ তখনকার বয়সের কথা আমি এখন ঠিক বলতে পারবো না মনে করো আমি ম্যট্রিক পরীক্ষা দেবার বহু আগে থেকেই আমার এই অভিঞ্জতা শুরু হয়

 

লুঃশীঃ-  আপনি আপনার ছোটবেলার কথা বলুন?

 

খাঃসাঃমুঃ—   আমার এক বোন আর আমিছোটবেলায় আমি খুব অসুস্থ্য থাকতাম এবং আমার বাবা মা আমার ব্যাপারে খুব প্রোটেকটিভ ছিলেনছোটবেলায় একবার ভিষন নিউমোনিয়া হয়েছিলো ,প্রায়  মৃত্যুর কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলাম তারপর থেকে আম্মা খুব ভয় পেতেন , কোন অসুখ হলেই খেলতে যেতে দিতেন না ফলাফল এই দাড়ালো যে, ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের সাথে মিশতে শিখলাম নাএবং অন্য মানুষের সাথে তেমন একটা কথাও বলতাম না

 

লুঃশীঃ   ছোটবেলায় কতটা দুরন্ত  বা শান্ত প্রকৃতির ছিলেন?

 

খাঃসাঃমুঃ  এখন তো মনে হয় ছোটবেলায় লাজুকই ছিলাম এবং কেউ  অন্যায়ভাবে মিথ্যা কথা বললে চোখের সামনে দাড়িয়ে প্রতিবাদও করতে পারতাম নাহ্যা, ছোটবেলার সেই শহরটির কথা মনে পড়ে, আহা সেই শহরের মানুষগুলো এখনো আমার স্বৃতিতে অমলিন হয়ে আছে কি পরিচ্ছন্ন ছিলো শহরটি, আমি দীর্ঘদিন সেই শহরে যাবার স্বপ্ন দেখি

 

সেঃ হোঃ  তখনকার সামাজিক অবস্থা, পরিবেশ, মানুষের জীবন, দুস্থদের কথা বলুন?

 

খাঃসাঃমুঃ   আমি আমার মায়ের স্বৃতিকথার মধ্যে দিয়েই তোমাদেরকে সেই সময়ের সামাজিক এবং অনান্য প্রেক্ষাপটটা বলতে চাইছিলামছোট দুএকটা ঘটনা বললেই তুমি বুঝতে পারবে যেমন, সেই সময়েও আমি যে শহরটির কথা বলছি সেখানকার দরিদ্র অভাবী মানুষকে আমারই মায়ের কাছে আসতে দেখেছিএকজন মহিলা একবার আমার মাকে প্রস্তাব করলেন খালাম্মা আপনি আমাকে টাকা ধার দেন আমি আপনাকে ধান দেবোমা জানতে চাইলেন সেই দুঃস্থ মহিলার কাছে, তাতে তোমার লাভ কি? তখন মহিলা বললেন” ”আপনার পাওনা টাকার ভিত্তিতে যে চাল হবে তা পরিশোধ করার পরও যে চালটা থাকবে তা দিয়ে  আমার একবেলা খাওয়া হবে

 

(চলবে)

 

লুনা শীরিন

৩রা  এপ্রিল ,২০০৯