তখন ও এখন
গীতা দাস
পর্ব – ২৯
গরমের দিনে তিব্বত কোম্পানীর ট্যালকম পাউডারের বিজ্ঞাপন শুনলে মনে হতো গায়ে মাখলেই ঠান্ডা লাগবে। শীতল হবে শরীর। ট্যালকা জলের নিবিড়তম আমেজে গরমে গা ভেজানোর মতো আরাম। ট্যালকম পাউডার মানে talc নামের এক ধরনের খনিজ পদার্থের গুড়া। অথচ ট্যালকম অর্থ আমার কাছে ছিল ট্যালকা। অর্থাৎ ঠান্ডা। ট্যালকম মানে অবচেতনে ট্যালকা অর্থ কাজ করতো। ঠান্ডাকে নরসিংদীর লোকজন ট্যালকা বলে। যেমন— ট্যালকা জল, ট্যালকা খাবার। কী শব্দের কী অর্থ করতাম! অনুভবেও ছিল এ অর্থ।
গরমে পাউডার ব্যবহার করতাম। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে রাতে শুতে যাবার সময় তো ঘাড় – গলা সাদা বানিয়ে ফেলতাম। অনেককে বিশেষ করে ছেলেদের দেখতাম দিনের বেলায়ও ঘাড় – গলা সাদা বানিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ যেন ফ্যাশনেরই অংশ ছিল। এ নিয়ে টিটকারিও চলতো – কিরে আটার বস্তা পেলি কোথায়?
আর শীতকালে মুখে স্নো মাখতাম —- ক্রীম নয়। গায়ে সরিষার তেল। ঠাকুমা ও বোনের ধারণা ছিল সরিষার তেল মেখে স্নান করলে ঠান্ডা লাগবে না। সুতরাং সরিষার তেলের বিকল্প অন্য কোন চিন্তা করার অবকাশ আর কারো ছিল না। এখন লোশন, ভ্যানিশিং ক্রীম, ওলিভ অয়েলসহ আরও কতো কী কিনতে হয়!
বহুদিন পাঊডার ব্যবহার করি না। গরমের দিনেও না। মুখে ভেসে ওঠে। অথচ পাঊডার ছিল গরমের দিনের অত্যাবশ্যকীয় প্রসাধনী। হায়রে দিন বদলের পালা!
ভাত মেখে ভাগ ভাগ করে এটা ছোট মামার, এটা বড় মাসীর, এটা দিদার, এটা তোমার বাবুর — এভাবে আমার ছেলেমেয়েকে খাওয়াতাম। একটার পর একটা ভাতের দলা (দলা মানে একবারে মুখে ধরে এমন পরিমাণ ভাত) তখনকার সময়ের তাদের বিভিন্ন প্রিয়জনদের নাম করে খাওয়াতাম। আবার আমার সাথে খেতে আসলে এক নলা বা গড়াস নিলে দ্বিতীয়বার খাওয়ানোর জন্য বলতাম —- একবার নিলে সাঁতারে পরে। সাঁতারে পরা মানে অথৈ জলে পরা। কাজেই কৌশলে দ্বিতীয় গড়াস খাওয়াতাম। এখন অথৈ জলকে সাঁতারে পরা বললে প্রতিকী মনে হলেও তখন কিন্তু তা মোটেই মনে হয়নি। আবার অরা একটু বড় হলে থালায় আলাদা খাওয়া শেখার পর প্রথমবার দেয়া ভাত খেয়ে ঊঠতে দিতাম না। দ্বিতীয়বার এক চামচ হলেও দিতাম। না হলে সাঁতারে পরবে বা অমঙ্গল হবে। না – এটি কুসংস্কারের বশে বলতাম না। আসলে মায়ের মন সন্তানদের বেশি করে খাওয়ানোর কৌশল। যা-– কালে কুসংস্কারে পরিণত হয়েছে। এখন আরও অনেক জরুরী প্রয়োজনেও কৌশল খাটে না। টিকটিকির টুকটুক বা দাঁড়কাকের কা কা আমার ছেলেমেয়ের কাছে কোন দ্বৈত অর্থ বহন করে না।
আমরা এমন অনেক শব্দ প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করি যা ভাবতে গেলে মনে হয় সাধারণভাবে বোধগম্য হবার কথা নয়। অথবা শব্দের অর্থ কতোভাবেই না আমরা পাল্টে দেই।
ছোটবেলায় দাদুর কাছে রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প কাহিনী শুনেছি —– যেখানে যাগ-যজ্ঞের কথা আছে। যেমন — অশ্বমেধ যজ্ঞ, রাজসূয় যজ্ঞ। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এখনো কোন মহান বা বিরাট কোন কর্মসূচিকে বিশেষায়িত করি কর্মযজ্ঞ বলে অভিহিত করে। আবার এবার ২৫ফেব্রুয়ারি, ’০৯ পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকে হত্যার সাথে যজ্ঞ যোগ করে হত্যাযজ্ঞ বলায় মৌলবাদী চেতনায় (ধর্মীয় মৌলবাদী নয় শব্দবোধে মৌলবাদী) মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। অন্য অনেকবার হত্যাযজ্ঞ শব্দটি শুনেছি, কিন্তু এবার কানে বিঁধেছে।
আবার অনেক শব্দ বোধগম্য হয় না। মনে থাকে না।
‘আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ। যখন যা খুশি
মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।
আর আমি তা পারি না।‘
শামসুর রাহমানের বন্দী শিবিরি কবিতায় তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দ ব্যবহারের কথা বলেছেন। আর আমি ভিন্ন পটভূমিতে তাঁর কাছ থেকে বাক্য ধার নিয়ে আরেক রকম শব্দ ব্যবহারের কথা বলছি ।
যেমন —- গত মাসে একদিন আমার স্বামী একজনকে ফোনে জিজ্ঞেস করছেন তাদের এক সভার সময় সম্পর্কে — মিটিং কখন হবে?
উত্তর — আগামীকাল বাদ আসর।
আমি পাশেই বসা ছিলাম বলে অন্য প্রান্তের বাক্য শুনতে পাচ্ছিলাম।
আমার স্বামীর প্রশ্ন —- কয়টায়?
উত্তর — বাদ আসর।
জিজ্ঞেস করছি কয়টায়?
বাদ আসর।
বাদ আসর মানে কী।
আসরের পরে।
আসরের নামাজ কোন সময়টাতে পরে? আমার তো জোহর আছর প্যাঁচ লেগে যায়।
আরে সাড়ে চারটায় মিটিং।
আচ্ছা, আচ্ছা। একবারে বললেইতো হতো যে বিকেল সাড়ে চারটায় মিটিং।
কেমন করে বুঝবো যে আপনি বাংলাদেশে বাস করে বাদ আসর কি তা জানেন না!
আমি নিজেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এর আগে বহুবার আসর জোহর আর এশার সময় মনে রাখার চেষ্টা করেও তা পারছি না।
বাদ আসর জানা কি অবশ্যই উচিত বা কর্তব্য? না কি না জানা অন্যায়? সংখ্যাগরিষ্ঠের ব্যবহৃত শব্দ বাদ আসর না জানা অজ্ঞতা সন্দেহ নেই। কিন্তু সর্বজনবোধ্য শব্দ ব্যবহার কি বাঞ্ছনীয় নয়? কথাটায় সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পেলে বা কারও ধর্মীয় মৌলবাদিত্বে আঘাত করে থাকলে ক্ষমা করবেন।
এমন ঘটনা জন্ম আগে হয়নি বলেই বাদ আসরের সময় মনে থাকেনি। তবে এখন থাকবে। থাকতেই যে হবে।
গীতা দাস
১৮ চৈত্র ১৪১৫/ ১ এপ্রিল, ২০০৯
গীতা দাস,
আমার ছোটবেলাটা ঘোড়াশালে কেটেছে বাবার চাকুরী সূত্রে। ঘোড়াশাল সারকারখানা কম্পাউন্ডে। আপনার নরসিংদীর কথা শুনেই খনিকের জন্যে হাড়িয়ে গিয়েছিলাম আমার শৈশবে। ছোটবোন পলি, এইরকম লিকলিকে ছিলো ওর গড়ন! মনে পড়ে গেলো খাওয়ার গল্প শুনে। খাওয়ার সময় ভাত মুখে নিয়ে চুশতে চুশতে পিঁড়িতে বসেই ঘুমিয়ে পরতো। তখন মা ওকে ঠিক ঐরকম কাব্য-কায়দা করেই খাওয়াতেন! বাবার হাত ধরে ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ ষ্টেশন থেকে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম জিনার্দি, আনারস কিনতে! সেই আনারস কেটে মা রেখে দিতেন ফ্রিজে! বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে সেই সুমিষ্ট ট্যলকা আনারস যে কি লাগতো!
সত্যি আপনার লেখার লাইন গুলো পড়ি আর এক লহমায় পৌঁছে যাই আমার শৈশবের আমিতে! মাথার ভেতরে, বুকের পাঁজরে হাফপ্যন্ট-শার্টের কম্বিনেশনে দুরন্ত এক বালকের দাপাদাপি আমার রক্তচাপ নিদারুন ভাবে বাড়িয়ে দেয়! উপভোগ করি! কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো জানিনে! আমার সমস্ত আবেগ-উচ্ছাস দিয়েই তা পাঠালাম!
ধন্যবাদ রানা, ফরিদ, লুনা ও কেশবকে মন্তব্যের জন্য। কেশব , হ্যাঁ জিনার্দির, বিশেষ করে রাবান গ্রামের ছোট ছোট মিষ্টি আনারস এখনো সবার মন কাড়ে। আপনার মন্তব্য আমার আরেকটি লেখার প্লটের যোগান দেবে হয়তো।
গীতা দি,
অনেকদিন মুক্তমনাতে লেখা পড়ি না, ইদানিং মুক্তমনায় বেশি আসা হয় না, নানান কারণে, তবে ইচ্ছাটা কেন যেন হারিয়ে গেছে। কিন্তু আজকে ছুটির দিন, অফুরন্ত অবসর, বার বারই ভাবছি লেখালেখি কেন করতে পারছি না? তাই তোমার লেখাটা পড়লাম, তুমি জানো, স্মৃতি আমার প্রিয় বিষয়। তোমার লেখাটায় ফিরে গিয়েছিলাম অতীতে, ভাল আছো তুমি নিশ্চয়ই? লিখতে পারছি না বলে ভাল থাকাটা কঠিন হচ্ছে, নিশ্চয়ই একদিন আমার এই বন্ধ্যাত্ব ঘুঁচবে।
তোমাকে শুভেচ্ছা, লেখাটা খুবই টাচি হয়েছে।
লুনা
হত্যাযজ্ঞের মতো শব্দ যাদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে নিস্কৃত হয়েছে তাদেরকে সৃষ্টিশীলতার জন্য বিশেষ ধরনের কোন পুরষ্কার দেওয়া যেতে পারে। :pissedoff:
আপনার লেখা সিম্পলি অসাধারণ । সবসময় অপেক্ষা করি নতুন পর্বের জন্য ।