গল্পের শেষ চায় বাংলাদেশ

 

আবুল হোসেন খোকন

 

বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিলোদিলো এমনভাবেÑ যাতে ক্ষমতার কোনই কমতি না থাকেএকেবারে একতরফা ভূমিধস ক্ষমতা দিলোকারণ, এমন না হলে কাজের কাজ হবে নামানুষের মূল আশা পূরণ হবে নাএই আশা বা প্রত্যাশা হলোÑ বাংলাদেশ সৃষ্টির শত্রদের বিচার করা, সমুচিৎ শাস্তি দেওয়া, তাদের সমস্ত জাল ছিন্ন করাআশা-প্রত্যাশার আরেকটা হলো, বাংলাদেশকে তার মূল চেতনায় দাঁড়িয়ে যাওয়া, ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াঅর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে ঐতিহাসিক সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিলÑ সেই ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ামানুষের প্রত্যাশার এই দুটো বিষয় পূরণ হলে বাংলাদেশ তার অত্মনির্ভরশীল অবস্থানে দাঁড়াতে পারবেআর এই অবস্থানই সমস্ত সংকটগুলোকে সত্যিকারভাবে দূর করার কাজ করবে৩০ লাখ মানুষের হত্যাকারী, লাখ লাখ মা-বোনোর ধর্ষক এবং দেশময় লুটপাট-জ্বালাও-পোড়াও-ধ্বংসযজ্ঞকারীদেরÑ এককথায় মানুষের মহাশত্রযুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দিলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি হবেজাতি মুক্তি পাবে এক দু:সহ পর্বতাকৃতির অভিশাপ থেকেএসব চিন্তা করেই মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ৩৮ বছর পর আবারও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে

এরপর মানুষ আশা করেছে তাদের চাওয়ার জায়গাটা পূরণ করা হবে কালবিলম্ব না করেইকিন্তু সেই কালবিলম্ব না করারচাওয়াটাই কাল হলো কিনা কে জানে! দেখা গেল যে, মানুষ চাইলো প্রথম রাতেই বিড়াল মারা হোককিন্তু মারা হলো না, ভান করা হলোবিড়ালকে বাঁচিয়ে রাখা হলো এবং তাকে বিচরণ করতে দেওয়া হলোজানা কথা, এই বিড়াল কোন অবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারকে চাইবে নাতাদের পেশীশক্তিরাও চাইবে নাতাদের অর্থশক্তিরাও চাইবে নাতাদের বাইরের প্রভুশক্তিরাও চাইবে নানানান সুবিধাবাদীরাও চাইবে নাএজন্য তারা সবাই মিলে আঘাত হানবে, ভয়াবহ আঘাত, চরম আঘাতবিড়ালদের তাবৎ নেটওয়ার্ক ব্যস্ত হয়ে পড়বে এজন্যÑ তা বলারই অপেক্ষা রাখে না

 

সুতরাং দেশবাসী দেখলো ক্ষমতায় বসার পরপরই ক্ষমতাশালীদের তরুণরা আত্মঘাতি সংঘাতে নেমে পড়লোওঁৎ পেতেই ছিল বাকিরাতাই ছড়িয়ে পড়লো দেশময় সন্ত্রাসএরপরই বেরিয়ে এলো বোমাবাজ জঙ্গিরাদেখা মিললো তাদের অ্যাকশনের প্রস্তুতিযুক্ত হলো বিদ্যুতে ধসআর এরকম অবস্থায় যুৎসইভাবে হামলে পড়লো পিলখানা ট্র্যাজেডি বা দেশময় বিডিআর বিদ্রোহপরের ঘটনা এখন জলজ্যান্তএখন বিড়াল মারা হবে, না জান বাঁচানো হবে অবস্থাঅর্থাৎ চাপা পড়ে গেল দুই মূল প্রত্যাশাপরের ডামাডোলে ওগুলোর কি হবেÑ কে জানে!

 

আমরা পিলখানায় (শুধু পিলখানা নয় সারা দেশময়) বিডিআর বিদ্রোহ দেখলাম অপ্রত্যাশিতভাবেকেও আগে থেকে কিছু জানলো নাগোয়েন্দা বিভাগ জানলো না, এনএসআই জানলো না, ডিজিএফআই জানলো না, আর্মি ইনটেলিজেন্স-সরকারী ইনটেলিজেন্স-পুলিশবিডিআর ইনটেলিজেন্স কেও জানলো নাএইসব করিৎকর্মা (!) ইনটেলিজেন্সের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাসের পর মাস ধরে বিডিআরের ভেতরে বিদ্রোহের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠলো, ভয়াবহ নীলনকশা বা ছক তৈরি হলোতারপর যথাযথ দিনে ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া হলোআমরা অবাক হয়ে দেখলাম পিলখানার প্রায় ১০ হাজার বিডিআর সদস্য কামান, মেশিনগান, মর্টার, হ্যান্ডগ্রেনেডসহ অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দাঁড়িয়ে গেলএই একই অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে সারাদেশের বিডিআর জোয়ানরা ব্যারাকে ব্যারাকে, সেক্টরে সেক্টরে, ব্যাটালিয়ন ব্যাটালিয়নে যুদ্ধের জন্য নেমে পড়লোআর দেখলাম, তখন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এই যুদ্ধ থেকে রক্ষা করলো সরকারদেখলাম, তারা রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যেভাবে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ রুখে দিলো, রক্তের গঙ্গা থেকে বাংলাদেশকে বাঁচালো, ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করলোÑ তা মেনে নিতে পারলো না কোন কোন মহলএই মহলের মধ্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও আছে, আরও আছে তাদের সঙ্গে থাকা যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল জামাততারা বললো, বিডিআরের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিযান ঠেকিয়ে নাকি রাষ্ট্রদ্রোহীতাকরা হয়েছেঅবাক ব্যাপারÑ তাদের পক্ষে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভেতরেও যে কিছু সমর্থন আছেÑ তা প্রমাণের জন্য গত ১ মার্চ সেনাকুঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেনা অফিসারদের যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছেÑ তার অডিওটেপ ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে বিশ্বময় প্রচার করে দিলোআহা, আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা! এমনই নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যার ফলে সেনাকুঞ্জের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের গোপন কথাও টেপ হয় এবং তৎক্ষণাৎ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে! একেই বলে বিড়ালের কীর্তিএরা কতোখানি দোর্দণ্ডÑ তা দেখিয়ে দিলোদেখিয়ে দিলো কীভাবে ভূমিধস শক্তির সরকারকেও ঘোল খাইয়ে দেওয়া যায় এবং বিপাকে ফেলা যায়

 

বিড়াল তো থেমে নেইদেশময় তৎপর হয়ে পড়েছেদিন আগেও দেখা গিয়েছিল তারা কোনঠাঁসা হয়ে পড়েছে, ভয় পেয়েছে, পলায়নের চেষ্টায় ব্যস্তএখন তারা যেন ফিরে দাঁড়ানোআদালতে রিট করে বিদেশ যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা রুখে দিচ্ছেবুক চেতিয়ে সভা করে বলছে, ‘যাহা ঘটিয়াছে তাহা ভারত করিয়াছে, এই সরকার ভারতের দালালি করিতেছেইত্যাদিঠিক ৭১-এর ভাষাএতো দু:সাহস আসে কোত্থেকে? এদের আরেকজন এতোদিন নিজের দলের তুণমূল নেতাদের তোপের মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেনবেরুতে পারছিলেন নাতিনিও এখন বেরিয়ে এসেছেনরাস্তায় নেমে মানুষকে নানাভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছেন, উস্কানি দিচ্ছেনবিশেষ করে পিলখানায় নিহত সেনাদের পরিবার-পরিজনদের উত্তেজিত করতে বলে বেড়ানো হচ্ছে, সেনা অভিযান চালালেই নাকি সবাই রক্ষা পেতো, কিন্তু সরকার তা ইচ্ছে করে করেনিÑ ইত্যাদিসেইসঙ্গে ঘরের শত্রও কিন্তু বিভীষণঘরের একজন বিশ্ববেহায়াÑ যিনি দুই-পঁচিশের দিন বললেন, সরকার যা করেছে ঠিক করেছেসাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সমাধানের পথে এগিয়েছেসেনাবহিনীকে অভিযানের নির্দেশ দিলে ভয়াবহ রক্তপাত ঘটতোএগুলো থেকে সরকার দেশকে রক্ষা করেছে, গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচিয়েছেকিন্তু দুদিন না যেতেই তিনি মুখোশ খুলে ফেললেনবিড়ালদের সুরে সুর মিলিয়ে বলেলন, সাধারণ ক্ষমা মারাত্মক ভুল হয়েছে, সেনাবাহিনীকে অভিযানের নির্দেশ না দেওয়ায় পিলখানার ভেতরে এতো বিপূল সেনা অফিসারকে প্রাণ হারাতে হয়েছেতিনি আরও নানান সব কথা বলছেন, বলেই চলেছেনএসব কীসের আলামত? রাষ্ট্রপতি না হতে পারার জ্বালা কিন্তু কম নয়

 

দুই-পঁচিশে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা থেকে এখন সবার কাছে যেটা পরিস্কার সেটা হলোÑ কোন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য ওই বিদ্রোহ ঘটানো হয়নিএর উদ্দেশ্য ছিল মূলত কয়েকটি যেমন ১. জঙ্গি মৌলবাদী দমনের সঙ্গে যুক্ত সেনা নেতৃত্বকে খতম করা, ২. বিডিআরের আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রগুলো ব্যাটালিয়নসমূহ থেকে বের করে বাইরের লোকদেরহাতে নিয়ে যাওয়া, , বিডিআর-সেনাবাহিনী সশস্ত্র সংঘর্ষ বাধিয়ে তা সারাদেশে বিস্তৃত করে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া, ৪. এরকম পরিস্থিতিতে পেছন দিক থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা এবং ৫. দেশে আরেকটি বড় রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ ঘটানোবলা যায় যারা এই নীলনকশা প্রণয়ন করেছিল তাদের প্রথম দুটি উদ্দেশ্য অনেকটাই সাধন হয়েছেকিন্তু বাকিগুলো সফল হয়নিএর একটিই কারণ যে, সরকার বিডিআর-সেনাবাহিনী সশস্ত্র সংঘর্ষ বাধতে দেয়নিসরকার রাজনৈতিকভাবে এ সংঘর্ষ মোকাবেলা করেছে এবং রাজনৈতিকভাবে এগিয়েছেফলে নীলনকশা প্রণয়নকারীরা যে সামরিক পথেরপ্রত্যাশা করেছিলÑ সেটা না হওয়ায় পরের উদ্দেশ্যগুলো সাধন করা যায়নিবলার অপেক্ষা রাখে না, এই নীলনকশা ব্যর্থ হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারীরা দারুণ হতাশ হয়েছেআর এ হতাশার বহি:প্রকাশ যে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আকারে ঘটবেÑ সেটা জানা কথাযা আমরা দেখতেও পাচ্ছি

 

এখন শেষ করা হলো, বর্তমান সরকার সর্বক্ষমতা নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেছেশত্ররা কখনই এটা সহ্য করবে নাতারা আঘাতের পর আঘাত হেনে সরকারকে শেষ করে দিতে চাইবেএ জন্য যতো প্রপাগান্ডা ছড়ানো দরকার, মোটিভেশন তৎপরতা দরকারÑ মানুষের মধ্যে তা করে বেড়াবেতৈরি করবে জটিলতাকরে করে মানুষকে বিভ্রান্ত-উত্তেজিত করতে চাইবেতারা সরকারকে মানুষের প্রত্যাশার জায়গা থেকে সরিয়ে দিকভ্রান্ত করতে চাইবেকেও কেও ভেতর থেকে সরকারকে অষ্টেপিষ্টে বেধে ফেলার চেষ্টা করবেবিভিন্ন রকম ঘটনায় ইন্ধন দিয়ে ইস্যু তৈরি করে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে চাইবেযাতেকরে সরকার কখনই রাষ্ট্রপরিচালনায় সফল না হয় এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সংবিধানে ফিরে যেতে না পারেআর শত্রপক্ষ এতোসব করতে পারছে প্রথম রাতেই বিড়াল না মারার কারণেএই কথাটি ভুলে যাওয়ার নয়ভুলে গেলে আরও চরম খেসারত দিতে হবে

 

সেনাকুঞ্জে সেনারা প্রধানমন্ত্রীকে অনেক বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেনতারা তাঁর পাশের লোকদের সম্পর্কেও সাবধান করেছেনএটা অত্যন্ত সৎ পরামর্শএখানে সত্যিই সাবধান হতে হবে সরকারকেআগেই বলেছি ঘরের শত্রবিভীষণসুতরাং হইতে সাবধানসরকারের প্রতি আরেকটি কথা হলো, পিলখানার ঘটনাকে তদন্তের নামে জিইয়ে রাখবেন না, এফবিআই-স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চমক দেখাবেন নাবরং এসবের চেয়ে প্রয়োজন নিজস্ব অ্যাকশনকঠোর অ্যাকশনসেটা দেখাতে হবেশেষ কথায় গত ৮ মার্চ ঢাকায় উল্লেখ করা প্রখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কথা থেকে বলতে চাইÑ আর কালবিলম্ব না করে বিড়ালদের মারুন, নিজামী-মুজাহিদি-সাকা-সাঈদী গংদের আটক করুন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাত দিন, সঙ্গে সঙ্গে দলের ভেতরে-বাইরের শত্রদের চিহ্নিত করুন, ধরুন, রিমান্ডে নিন, আর ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজনীতি বন্ধের ব্যবস্থা করুননা হলে পরিণতি মঙ্গলজনক হবে নাÑ তা গাফ্ফার চৌধুরী বলেই দিয়েছেনঅতএব আলামত থেকে সতর্ক হোন এবং বাঙালি জাতির শেষ আশা-ভরসাকে তাঁদের ভূমিধস আকারে দেওয়া ভোটের শক্তি দিয়ে বাঁচানএর আর কোন বিকল্প নেই, সুযোগও নেইমনে রাখতে হবে ভোট দেওয়া মানুষ হতাশ হতে চায় না, মুখ ফিরিয়ে নিতে চায় নাতাই তাদের প্রত্যাশা পূরণ করুনগল্পের শেষ টানুন

[১১ মার্চ ২০০৯ ঢাকা, বাংলাদেশ]

 

 

আবুল হোসেন খোকন : সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট