অন্ধ তৈরীর খেলা
এম, এ, মাহমুদ (দীপু)
পৃথিবীর ঠিক কবে থেকে এই খেলা শুরু তা হয়তো বলা শক্ত। তবে সৃষ্টির সবচেয়ে গুণধর প্রজাতিটি যে এই খেলাটির পথিকৃত তাতে সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই। প্রথমে খেলাটি সম্পর্কে একটু জানিয়ে দেই। তাতে হয়তো অনেক অন্ধ তা’র অন্ধতের কারণটি অন্তত জানতে পারবে। খেলার মূল বিষয়টি হচ্ছে যে ভাবেই হোক কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় এমনকি পুরো সমাজকে কোন মতাদর্শ (প্রায় ক্ষেত্রেই লৌকিক নয়) দ্বারা প্রভাবিত করে বশ করে ফেলা, ইচ্ছানুযায়ী পরিচালনা করে স্বার্থ হাসিল করা। নেতিবাচক বা ইতিবাচক যে কোন উদ্দেশ্য কে হাসিল করতে এই বশীভূত করাটাই এই খেলার মূল বিষয়। এ এক ধরনের চিন্তা চেতনা, বিশ্বাসের অন্ধত্ব। আশেপাশে অহরহই এ ধরনের কর্মকান্ড আমাদের চোখে পড়বে। পল্টন ময়দান থেকে শুরু করে ফুটপাতের পাশের ক্যানভাসার পর্যন্ত।
সেই আদিকাল থেকেই চলছে বুদ্ধির জোর, শক্তির জোর দিয়ে একে অন্যকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা এবং তা আজ অবধি সমান তেজে প্রজ্জ্বলিত। খেলাটি হচ্ছে তুলনামূলক বিচারে একটু উন্নততর বুদ্ধিবৃত্তিক জীব তার অধঃতন জীবগুলোকে নিয়ন্ত্রন করার কৌশল খুঁজে বেড়ায় তার নিজ স্বার্থসিদ্ধির স্বার্থেই। তা হতে পারে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা সমাজ, এমনকি একটি গোটা জাতি পর্যন্ত। আমাদের চারপাশে এমন ভুরিভুরি উদাহরন চোখ মেললেই দেখা যায়। একটু লক্ষ্য করলেই তা দেখা যাবে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অথবা জাতি যখন কোনভাবে এই অন্ধত্বের ফাঁদে পড়ে যায় তখন তার পক্ষে আর সেই অন্ধত্ব বুঝে উঠা সম্ভব হয় না। যাদুকর যেমন মোহাবিষ্ট করে রাখে অনেকটা তেমনি। পথে চলতে দেখবেন একটি ছোট জটলা। কাছে গেলে দেখবেন একজন ঝানু বক্তা, কথার মায়ায় ভূলিয়ে কখনও ধনন্তরী ঔষধ, বটিকা বা অন্য কোন পণ্য কৌশলে বিক্রি করছে। আপনি পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও, কিছু লোক তাকে ঠিকই ঘিরে থাকবে এবং সবশেষে প্রলুব্ধ হয়ে ঠিকই তার শিকার হবে এবং হচ্ছেও অহরহ। অন্ধ তৈরির খেলার এটি একটি ছোট উদাহরণ।
এবার এর একটি বড় উদাহরণ লক্ষ্য করি। হয়তো আমরা অনেকে এরই মধ্যে তার শিকার হয়ে রয়েছি। আমরা হরহামেশা অনেক দুনীর্তিবাজ, সন্ত্রাসী, কপট রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গকে সমাজে দেখতে পাই। যারা বেশ স্বাচ্ছন্দে কয়েক হাজার বা লক্ষ লোককে অন্ধকরে রাখতে সক্ষম। যাদের অন্ধ করে ফেলা হয় তাদের পক্ষে তা বুঝা সম্ভব হয় না। মজার ব্যাপার হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা সেই লোকটির দ্বারা নিজেই প্রতারিত হয়ে এবং তা বুঝতে পেরেও আবার তার পিছনেই গিয়ে দাড়ায়। অনেকের ঘোর ভাঙ্গে তবে তাতে সেই মোহাবিষ্টকারী চতুর লোকটির কোন ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকে না। অন্যের কথা বাদই দিলাম আপনি নিজেই ভেবে দেখুন না। আপনাকে অন্ধ করে প্রতিবার আপনার ভোট বা সমর্থনটি কেমন করে করায়ত্ব করে নিচ্ছে বহুবার। আপনি নিজেই সৎ লোকের জন্য আক্ষেপ করেন আবার পরক্ষনেই আপনার চেয়ে চতুর কোন দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় ভুলে তাকেই সমাজের মাথায় তুলে দিয়েছেন। সঠিক করে বলুন তো আপনি এমন কাউকে সমর্থন বা নির্বাচন করেছেন কিনা যিনি সমাজের জন্য ক্ষতিকর বা হুমকি স্বরূপ নয়। যদি আপনার উত্তর ‘না’ হয় তবে আপনাকেই বলছি বাংলাদেশে কতজন সৎ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন? এটাও আপনার জানা যে আপনার এলাকায় এ পর্যন্ত যত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন তাদের মধ্যে হয়ত একজনও খুজে পাওয়া যাবে না, যারা কোন না কোন ভাবে অনৈতিক বা অসামাজিক কাজে লিপ্ত নয়। তারা নির্বাচিত বা সমর্থিত হোন যাদের মাধ্যমে তাদের কি বলবেন ? আমি বা আপনিও কোনভাবে এদের কৌশলের কাছে অন্ধ হয়ে আছি তা সে ভয়, অর্থ, লোভ, নিরাপত্তা বা যে কোন প্রভাব দ্বারাই হোক ।
এতো গেল বর্তমানের শিক্ষিত সচেতনগোষ্ঠীর অন্ধত্বের উদাহরণ। আদি যুগে দেখুন। সেখানেও একই ব্যাপার। দেখা যায় একজন লোক কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে নির্বিঘেœ বশ করে তার ব্যক্তিগত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য আদায় করে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করে গেছেন। এদের মধ্যে যারা অতি উচ্চস্তরের তাদের প্রভাব তাদের মৃত্যুর পর আজ পর্যন্ত সমানভাবে বিদ্যমান। অথচ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে কৌশলে অতি সুখময় অবস্থানে পৌছে এবং সর্বপ্রকার মানবিক , জৈবিক সুখ উপভোগ সহকারে জীবন নির্বাহ করে গেছেন (গৌতম বুদ্ধ, যীশু খৃষ্টের মত দু একটি ব্যতিক্রম অবশ্য আছে যারা অন্তত একান্ত নিজস্ব সুখ পরিত্যাজ্য করে গেছেন, দৈহিক সুখের কোন তোয়াক্কাই করেননি, এমন উদাহরণ আর একটিও আছে কিনা সন্দেহ।) আর অন্যদের বেলায় ত্যাগের যেটুকু তুলে ধরা হয় তাও সেই তার দ্বারা তৈরি অন্ধদের অন্ধবুলি। বর্তমান সমাজের দূর্নীতিবাজদের চেলারা যেমন শতমুখে নেতার গুনকীর্তন গায় অনেকটা তেমন। কোনভাবেই তারা প্রভুর দোষত্র“টি খুঁজে পায়না বরং সকল কাজেই মহৎ একটি কারণ খুজে পায়।
আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে এ খেলায় যিনি ক্রীড়ানক, তিনি তা’র খেলার উপকরণ অর্থাৎ যাদের সে অন্ধ করবে, তাদের প্রথমেই এর মূল শর্তটি বলে দেয় আর তা হচ্ছে চোখ না খোলা (কারণ চোখ খুললেই সব ফাঁকি ধরা পড়বে। তাই যে কোন ছুতোয় সত্যকে আড়াল করতে চোখ,কান বন্ধ রাখার নিয়ম প্রথমেই বেধে দেয়া হয়। ভয়ে আর চোখ কে খোলে ?) সেই সুযোগে কুশলী তার নিপুণ কৌশলে স্বার্থ চরিতার্থ করে। এদের দ্বারা পরোক্ষভাবে কিছু লোক উপকৃতও হয় যেমন অনেক ভন্ড পীর,সাধু,ওঝার আখরায় অনেক দীনহীন লোকের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়ে থাকে যদিও সেটাও একটি মূলধন এবং তা খেলারই অংশ । মূল উদ্দেশ্য তা নয়। এবার আসুন আপনি, আমি বা আমরা কার, কার দ্বারা অন্ধত্ব বরণ করেছি তা একটু খুঁজে দেখি। চোখ মেলে সত্যের দিকে তাকাই। পরিণতি তা সে যাই হোক। সত্যের অনুসন্ধানই যেন আমাদের প্রথম ব্রত হয়। সেই কামনা করি।
এম, এ, মাহমুদ (দীপু)
ঢাকা
২৮-০৬-২০০৮
Leave A Comment