বিডিআর নৈরাজ্য: লাশের মাপকাঠিতে বিদ্রোহের পরিসীমা
দিনমজুর

প্রথম দিকে মিডিয়াতে বিডিআরের সদস্যদের বিভিন্ন বঞ্চনা,লাঞ্চনা আর অপমানের কথা শুনে,অপরেশন ডাল-ভাতে ৪০ টাকার সয়াবিন ১২০/১৩০ টাকায় বাজারে ছাড়া এবং এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অধিক দামে বিক্রি করে সে লাভের টাকায় বিডিআরের উর্দ্ধতন সামরিক কর্তাদের গাড়ি বাড়ি বানানোর অভিযোগ দেখে, বেতন-ভাতা এবং রেশনে বৈষম্যের খবর জেনে পিলখানায় বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে আগত সামিরক বাহিনীর উদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিডিআরের জোয়ানদের সশস্ত্র আন্দোলনের যে ঘটনাটিকে আমাদের বিদ্রোহ বলে মনে হয়েছিল পরবর্তীতে গিয়ে যখন লাশের সংখ্যা বাড়তে লাগল, যখন একটার পর একটা গণকবর আবিষ্কার হতে থাকল কিংবা মিডিয়াতে ক্রমশ নিহতের স্বজনের আহাজারির দৃশ্য বাড়তে লাগল তখনই একটু একটু করে আমাদের মনে হতে লাগল না, ঘটনাটি মনে হয় স্রেফ ক্ষোভের ফসল নয়- এর পেছনে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র রয়েছে। এই পরিবর্তনের পেছনে কান্না-আবেগ-বিভৱষতা-মিডিয়ার দোল খাওয়া-সামরিক ও বেসামরিক প্রচরণা ইত্যাদির ভূমিকা না হয় বোঝা গেল কিন্তু যুক্তির ব্যাপারটি ঠিক কি? ঠিক কোন যুক্তিতে লাশের সংখ্যা কিংবা হত্যাকান্ডের ধরণ কিংবা লাশের সতকারের(কবর দেওয়ার) পদ্ধতির ভয়াবহতা দেখে আমাদের মতামতের এই একেবারে উল্টো ঘুরে যাওয়া? লাশের সংখ্যা কিংবা হত্যাকান্ডের ধরণ কিংবা লাশের সতকারের পদ্ধতির ভয়াবহতার মাধ্যমে কি বঞ্চিত- লাঞ্ছিত-অপমানিতের বিদ্রোহ আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভেদরেখা টানা যায়?

নৈরাজ্য, না বিদ্রোহ, না ষড়যন্ত্র:
বঞ্চিত- লাঞ্ছিত- নির্যাতিত- অপমানিত হতে হতে কিছু মানুষ যখন বিদ্রোহ করে, সেটার মাঝে যদি কোন আদর্শ না থাকে, কোন সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা না থাকে, তখন সেটা স্রেফ নৈরাজ্যই(অ্যানার্কি) হয়- লাশের সংখ্যার মাপকাঠিতে একে পরিকল্পিত বা ষড়যন্ত্র বলার মানে হলো ঘটনার ভিত্তিতে যে সব বঞ্চনা-ক্ষোভ-বৈষম্য রয়েছে সেগুলোকে আড়াল করে ফেলা- যে চেষ্টাই এখন সর্বত্র হচেছ্।
আচ্ছা তর্কের খাতিরে ধরা যাক, কোন একটি দেশীয় বা বিদেশী শক্তি কোন এক বা একাধিক বিশেষ উদ্দেশ্যে একদল বিডিআর কে নিয়ে এই হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা করে। ইন্ধনদাতা গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যও না হয় ধরে নিলাম- বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা কিংবা নবগঠিত সরকারকে অস্থিতিশীল করা কিংবা যুদ্ধপরাধীদের বিচারের বিষযটিকে ভন্ডুল করা ইত্যাদি ইত্যাদি কিন্তু হত্যাকান্ড যারা ঘটিয়েছে অর্থাৱ যারা সারাসরি গোলাগুলি করেছে সেই সব বিডিআররা কিসের আশায় এবং কিসের ভরসায় এই পরিকল্পনামত কাজ করতে রাজি হলো? তাদের তো খুব ভালো করেই জানার কথা অফিসার হত্যাকান্ডের পরিণতি কি! এই পরিণতি জেনেও তারা এই পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছে?

নৈরাজ্যের ভিত্তি:
রাষ্ট্র একদিকে শাসন শোষণের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণীকে ক্রমাগত ক্ষেপিয়ে তোলার মত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ জারি রাখে এবং তার ক্রমাগত পুনরুৎপাদন করে চলে, অন্যদিকে তার প্রতিক্রিয়ায় সেই শোষিত মানুষেরা যখন এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে নানান ধরনের ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়, তখন আবার তার কাছ থেকে মানবিক বিবেচনা প্রত্যাশা করার ভান করে এবং কেন তারা সেই মানবিক বিবেচনা প্রদর্শন করল না তার অযুহাতে তাকে বিচার করে (যদি আদৌ সেগুলোকে বিচার বলা যায়– অচিরেই আমরা দেখব অপারেশন রেবেল হান্ট এবং বিশেষ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে সামরিক বিচার প্রক্রিয়া)।
গার্মেন্টস শ্রমিকরা যখন ক্রমাগত নিষ্পেষিত হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে রাস্তায় নামে, সামনে যা পাই তা-ই ভাঙচুর করতে থাকে তখন তাদের সেই জ্বালাও পোড়াওয়ের খবর যখন পত্রিকার পাতার শিরনাম হয়: “গার্মেন্টস শ্রমিকদের তান্ডব” নামে আর ভেতরে থাকে নিরীহ পথযাত্রিদের হয়রানির কাহিনী কিংবা থাকে কোন প্রাইভেট কার ভাংচুরের সময় অসহায় আরোহিনীর হাত জোড় করে থাকার ছবি, সেই সাথে সরকার-গার্মেন্টস মালিক-বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল- সুশীতল সমাজের মুখে ক্রমাগত দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের জল্পনা-কল্পনা।

অবাক হওয়ার কিছু নেই, এবারে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায়ও আমরা তাই দেখব এবং দেখছি। ক্রমশ বিডিআর জোয়ানদের বঞ্চণা-দাবী দাওয়ার জায়গায় স্থান করে নিয়েছে নিহতের স্বজনদের অশ্রুসজল চোখ, নিখোজ পিতার খোজে আকুল সন্তানের ছবি, গণকবরের দৃশ্য, অফিসারদের কোয়ার্টার ভাঙচুরের ছবি, লুটকরা স্বর্লাংকার নিয়ে পলায়নপর বিডিআর এর গ্রেফতার কাহিনী। সেই সাথে মিডিয়া-রাষ্ট্রপ্রধান-সেনাপ্রধান-সামরিক-বেসামরিক আমলা-বুদ্ধিজীবী সবার মুখেই ষড়যন্ত্রের নানান জল্পনা। কেউ বলছে বিডিআররা মুখ বাধার জন্য এত রঙিন কাপড় কোথায় পেল, কেউ বলছে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্রপাতি কিভাবে লুটকরল, অ্যাশ কালারের পিক-আপ কোত্থেকে এলো- গণকবর কেন হলো- এত বাধ্য জোয়ানরা কোন সাহসে অফিসার দের গায়ে হাত তুলল-অফিসার দের বাড়িঘর কেন লুটপাট হলো? এগুলো সবই ষড়যন্ত্রের প্রমাণ। এদের সবাই কে খুজে খুজে বের করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে, দৃষ্টান্তু স্থাপন করতে হবে যেন ভবিষ্যতে এরকম আর না ঘটে।
এদের কথা বার্তা শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এই প্রথম সামরিক/ আধাসামিরক/ বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীতে বিদ্রোহ হয়েছে। গণ বিচ্ছিন্ন প্রতিটি বুর্জোয়া সরকারই ক্ষমতার মসনদ শক্ত রাখার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে তোয়াজ করে আসছে। প্রতিবছরের বাজেটে সামরিক খাতে সরাসরি ও গোপন বরদ্দ দেখলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে উঠে। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় লালিত পালিত সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে জনগণকে দাবীয়ে রাখার কাজে। এই গণবিচ্ছিন্ন সামরিক বাহিনীতে এই সব সুযোগ-সুবিধার ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি কামড়া কামড়ি চলে আসছে একেবারে শুরু থেকেই। যেকারনে ‘৭৫ এর আগষ্ট-নভেম্বর থেকে শুরু থেকে এ পর্যন্ত ঘটে গেছে বেশ অনেকগুলো অভ্যুত্থান। এ সকল অভ্যুত্থান এবং এসব অভ্যুত্থান ছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিদ্রোহ দমনের সময় অসংখ্য অফিসার ও সৈনিক এর খুন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিমান বাহিনীর অফিসারদের বিদ্রোহ কিংবা বেসামরিক আনসার বাহিনীর বিদ্রোহের হত্যাযজ্ঞের কথা হয়তো অনেকেরই স্মরণে আছে। সামিরক বাহিনীর ভেতরের নানা অনিয়ম, লুটপাট, এলিটিসিজম, সামন্ততান্ত্রিক Rnak প্রথা, তথাকথিত চেইন অব কমান্ডের ধরণ, অফিসার-সৈনিকের বৈষম্য, কথায় কথায় মধ্যযুগীয় পানিশমেন্ট বা শাস্তি, ব্লাডি সিভিলিয়ান বা জনগণের সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের সামরিক তন্ত্র আর দশটা বুর্জোয়া দেশের সামরিক তন্ত্রের মতোই অসুস্থ। এই অসুস্থতার লক্ষণ নানান সময় নানান ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এবারের এই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাও সেই অসুস্থতারই বিকট বহি:প্রকাশ। এসব সমস্যার সমাধান যদি করতে চাই, যদি মনে করি সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে এরকম ঘটনা যেন না ঘটে তার পাকাপাকি ব্যবস্থা আমরা করবো,তাহলে এই সব ফালতু ষড়যন্ত্রের থিওরী বাদ দিয়ে, সামরিক প্রতিহিংসায় উন্মাদ সামরিক এলিটিসিজমকে তুষ্ট করার ভয়ংকর আত্মবিধ্বংসী পরিকল্পনা বাদ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বর্তমান সামরিকতন্ত্রের একেবারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো দরকার।

কার বিচার, কিসের বিচার :
কাজেই বিচার যদি করতেই হয় তাহলে প্রথমেই বিচার করা দরকার বর্তমান রাষ্ট্রতন্ত্রের, এবং বিদ্যমান সামরিকতন্ত্রের। এ কেমন ব্যবস্থা যেখানে বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যের মতই তথাকথিত অফিসার এবং সৈনিক এর মর্যাদার পার্থক্য করা হয়, যেখানে অফিসার সেই দাস যুগের দাস-প্রভুর মতই সৈনিক নামের দাসের সাথে প্রতিনিয়তই অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম-নির্যাতন চালায়? এ সামরিক তন্ত্রে তো অফিসার শ্রেণী প্রতিদিনই সৈনিকের আত্নমর্যাদাকে হত্যা করতে থাকে। তাছাড়া কি শেখানো হয় মিলিটারিতে- সন্ত্রাসবাদ না মানবিকতা? যে শিক্ষাটা তারা পায়-তার সাথে মানবাধিকার বা সভ্যতার কি কোন সম্পর্ক আছে? তার ওপর চেইন অব কম্যান্ডের স্বার্থে শুরু থেকেই স্বাধীন চিন্তা বিকাশের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয় সকলের- সার্কাসের পশুর মতই চাবুকের বাড়িতে নির্দিষ্ট ধরনের নড়াচড়া ছাড়া অন্য কোন কিছু করার কোন সুযোগ নেই এখানে। রাষ্ট্রিয় নিরপত্তা রক্ষার অযুহাতে তো এভাবে স্রেফ একদঙ্গল পশু তৈরীর কারখানা চালু রাখা হচ্ছে। তার ওপর আছে সুযোগ-সুবিধার বঞ্চনা, বৈষম্য। মানবেতর জীবন যাপন। এর ফলাফল স্বরুপ পাশবিকতা বা নৈরাজ্য না ঘটাই তো অস্বাভাবিক। কাজেই বিশেষ ট্রাইবুনালে নৈরাজ্যের বিচার করার চেয়ে যে সিস্টেম/প্রকৃয়া এর জন্য দায়ী সেটার বিচার করা এবং সেটাকে পাল্টানো বেশী জরুরী বলে মনে করি।

তা না হলে এ ধরণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা যত দিন বহাল থাকবে, ততদিনই এধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকে যাবে, আজকে বিডিআর করেছে, কালকে আর্মির ভেতরেই ঘটবে।