এক বিবর্তনবিরোধীর প্রত্যুত্তরে

অভিজি রায়

ডারউইন দিবস নিয়ে  একটি খুব সহজ সরল লেখা লিখব ভাবছিলাম। কারণ বিবর্তনের ব্যাপার-স্যাপারগুলো দেখছি অনেকের কাছেই খুব একটা পরিস্কার নয়।  বিবর্তন নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার চেয়ে  ভুল-ভাল প্রোপাগান্ডাকেই অনেকে সত্য বলে ধরে নেন।  এর  কারণ কি?  মূল এবং প্রধান কারণ বোধ হয় ডারউইনের এই যুগান্তকারী তত্ত্বটি সম্বন্ধে অনেকেরই সঠিক ধারণা না থাকা।  আরেকটি কারণ হচ্ছে যে, ছোটবেলা থেকে আমাদের মগজে সৃষ্টিতত্ত্বের গালগপ্প গুলো আমাদের মগজে জাঁকিয়ে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়, বড় হবার পরে আমরা বুঝি ডারউইনের যুগান্তকারী তত্ত্বটির অবস্থান আসলে সে সমস্ত রূপকথা, উপকথাগুলোর একশ আশি ডিগ্রী বিপরীতে।  পরিণত বয়সে এসে কেউ যখন দেখে বিজ্ঞান  যা বলতে চাচ্ছে  তার সাথে ছোট বেলায়  শোনা গালগপ্পগুলোর সাথে বিস্তর রকমের ফারাক তখন অনেকেই খায় এক বিরাট রকমের  ধাক্কা।  কিন্তু ধাক্কা খেলে কি হবে, নিজেকে ‘আপডেট’ করার কাজটি অনেকেই আর করতে চান না। ছোটবেলায় বাবা মা কিংবা গুরুজনদের কাছ থেকে শোনা আদম হাওয়া গন্ধমম্ফল শয়তানের কেচ্ছাকাহিনী থেকে অনেকেই আর বেরুতে চান না, মুখ তুলে তাকাতে চাননা জগতের বাস্তবতার দিকে। ঝামেলাটা বাজে তখনই। আর কিছু অন্ধবিশ্বাসী মোল্লার দল তো ঘোট পাকাতে বসে থাকে অহর্নিশি। তারা ছড়াতে থাকে ডারউইনের এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে নানা কিসিমের কুসা।   আবার উলটো দিকও আছে।   যারা বিবর্তন বিষয়ে জানেন, তারা আবার এটি জনপ্রিয়করণে কোন আলাদা রকম ভুমিকা রাখেন না বা রাখতে চাননা। তারা ভাবেন, কালের পরিক্রমায় এমনিতেই বুঝি মানুষের কুসংস্কার একসময় দূর হয়ে যাবে।  এত ‘প্রীচিং’ করার কি দরকার!  বিজ্ঞান তো আর ধর্ম নয় যে পগম্বর দিয়ে নসিহত  করতে হবে।

 

কিন্তু কুসংস্কার দূর হয় না আপনা-আপনি।  দীর্ঘদিনের বিশ্বাসের অচলায়ন ভাঙ্গা আসলে  বড্ড কঠিন।  রাহুল সংকৃত্যায়ন একবার বলেছিলেন –

 

‘মানুষ জেলে যাওয়া বা ফাঁসির মঞ্চে ওঠাকে বিরাট হিম্মত মনে করে। সমাজের গোঁড়ামিকে ভেঙে তাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, জেলে যাওয়া বা ফাঁসির মঞ্চে ওঠার চেয়ে ঢের বেশী সাহসের কাজ।’

কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়।  মিথ্যে নয় বলেই সংস্কারমুক্ত মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার।  মিথ্যে নয় বলেই কিন্তু অনেকেই বালির মধ্যে মুখ গুঁজে থাকতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, হাজারো সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা হলেও ছোটবেলায় শেখা রূপকথা থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকানোর সাহস রাখেন খুব কম লোকজনই।

আমরা ডারউইন দিবস উপলক্ষে বহু লেখার পাশাপাশি একটি সমালোচনামূলক লেখাও পেয়েছি। কিশোরের ‘ডারউইনবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ‘ -লেখাটি এই ডারউইন দিবসের একটি অন্যতম ব্যতিক্রমধর্মী লেখা।  ব্যতিক্রমধর্মী এ জন্য যে, এ লেখাটা ডারউইনের তত্ত্বের প্রশস্তিমূলক লেখা নয়, বরং সমালোচনামূলক।  মুক্তমনা যে কোন ধরনের সমালোচনামূলক লেখাকে সবসময়ই স্বাগত জানায়।  আমি ব্যক্তিগতভাবে কিশোরকে তার লেখার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

কিশোরের প্রবন্ধটির মূল নির্যাস হচ্ছে বিবর্তনের বিপরীতে ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বকে দাঁড় করানোর সূক্ষ প্রচেষ্টা। যদিও তিনি কোন ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বকে সমর্থন করে কিছু লিখেননি, পুরোটাই লিখেছেন মূলত ডারউইনের তত্ত্বকে ‘একহাত’ দেখে নেয়ার অভিপ্রায়ে (এবং এটা তিনি কেন করেছেন তা সহজেই বোধগম্য), তবু  ডারউইনের তত্ত্বের বিরুদ্ধে তার মূল আর্তি ফুটে উঠেছে প্রবন্ধের শেষ লাইনটিতেই –  

তারা যখন বিবর্তনবাদের মত চমকপ্রদ ও কল্প কাহিনী পড়ে তাদের মনে এর একটা স্থায়ী ছাপ পড়ে যায়। এর ফলে পরবর্তীতে তারা ইচ্ছে করলেও আর এর প্রভাব থেকে বের হতে পারে না এবং তাদের মনের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে একটা সন্দিগ্ধ ভাব থেকেই যায়, যে কারনে তারা একুল ওকুল দুকুলই হারায়। অর্থাৎ তারা না পারে পুরোপুরি নাস্তিক্য বাদ থেকে বেরিয়ে আসতে, না পারে পুরোপুরি আস্তিক হয়ে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি সাধনে কোন সাধন কার্যে লিপ্ত হতে। অন্য কথায় অমূল্য মানব জন্মটাই তার বৃথা যায়।

এখানে লক্ষ্যনীয় যে, লেখক বিবর্তনবাদকে নামাঙ্কিত করেছেন ‘চমকপ্রদ ও কল্প কাহিনী’ হিসেবে।  এবং এই কল্পকাহিনী পড়ার ফলে নাকি সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে একটা ‘সন্দিগ্ধ ভাব’ থেকেই যায়, ফলে তারা ‘একুল ওকুল’ দুকুলই হারায়! আর তারফলে ‘অমুল্য মানব জনমটাই’ বৃথা যায়!  

কিশোরের অভযোগ গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।  তবে সেখানে যাওয়ার আগে বিবর্তন সম্বন্ধে ছোট্ট করে একটু জেনে নেয়া যাক।

বিবর্তন কি?

বিবর্তন ব্যাপারটা আসলে কি? সাদা মাঠাভাবে বিবর্তন বলতে আমরা বুঝি পরিবর্তনকে।  আমরা নানারকম পরিবর্তনের সাথে এমনিতেই পরিচিত। প্রকৃতির নানা রকম পরিবর্তন আমরা হর হামেশাই দেখি।  ভূত্বকের পরিবর্তন হয়, নদী নালা, খাল বিল শুঁকিয়ে যায়, অগ্ন্যুৎপাতে শহর ধ্বংস হয়, আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে,  গ্লোবাল ওয়ার্মিং এ এন্টার্কটিকার বরফ গলে যায়, কিংবা সুপারনোভা বিস্ফোরনে গ্রহাণুপুঞ্জ ধ্বংস হয়  – এগুলো উদাহরনের  সাথে আমরা সবাই কমবেশী পরিচিত।  কিন্তু এগুলো সবই জড়গগতে পরিবর্তনের উদাহরণ।  জীবজগতকে অনেকদিন ধরেই রাখা হয়েছিলো সমস্ত পরিবর্তনের উর্ধ্বে।  কারণ মনে করা হত ঈশ্বরের সৃষ্টি জীবজগৎ  সর্বাঙ্গীন সুন্দর, আর নিখুঁত। তাই এদের কোন পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। সকল জীব, সকল প্রজাতি সুস্থির, আবহমান কাল ধরে অপরিবর্তিত আছে এবং থাকবে।   ডারউইন এবং ওয়ালেসের প্রস্তাবিত বিবর্তন তত্ত্ব মূলতঃ জীবজগতের অপরিবর্তনীয়তার এই মিথটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।  তাদের তত্ত্বই প্রথমবারের মত বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিয়েছে যে জীবজগতও আসলে স্থির নয়, জড়জগতের মত জীবেরও পরিবর্তন হয়, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তনের হার খুবই ধীর।  ডাগ্লাস ফুতুইয়ামা তার Evolutionary Biologyবইয়ে বিবর্তনকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে –

“In the broadest sense, evolution is merely change, and so is all-pervasive; galaxies, languages, and political systems all evolve. Biological evolution … is change in the properties of populations of organisms that transcend the lifetime of a single individual. The ontogeny of an individual is not considered evolution; individual organisms do not evolve. The changes in populations that are considered evolutionary are those that are inheritable via the genetic material from one generation to the next. Biological evolution may be slight or substantial; it embraces everything from slight changes in the proportion of different alleles within a population (such as those determining blood types) to the successive alterations that led from the earliest protoorganism to snails, bees, giraffes, and dandelions.”

আমি আমার প্রবন্ধে আমার আলোচনা কেবল জীবজগতের বিবর্তনেই সীমাবদ্ধ রাখব। জীববিজ্ঞানে একে অভিহিত করা হয়  জৈব বিবর্তন নামে।  আমি এ লেখায় বিবর্তন বলতে মূলতঃ জৈব বিবর্তনই বোঝাবো।   বিবর্তনের ধারনাটি কিন্তু জটিল কিছু নয়।  ডারউইন যখন তার এই বিখ্যাত তত্ত্বটি তার বন্ধু হাক্সলিকে বোঝাতে শুরু করেছিলেন, হাক্সলি মাথা চাপড়িয়ে বলেছিলেন – ‘এমনি স্টুপিড আমি যে এই সোজা ব্যাপারটা আপনি বলার আগে কখনোই মাথায় আসেনি।’   বিজ্ঞানিদের মতে আমরা আমাদের চারপাশের যতরকমের জীবজগতের সাথে পরিচিত, তাদের সবার পূর্বপূরুষ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়াসদৃশ সরল এককোষী জীব, যাদের উদ্ভব পৃথিবীতে হয়েছিলো প্রায়  তিনশ কোটি বছর আগে।  প্রায় ষাট কোটি বছর আগে বাস করত এমন এক প্রকার কৃমি জাতীয় জীব যা থেকে ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত হয়েছে মাছ, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপাইয়ী প্রাণী সমূহ। প্রায় এককোটি পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগেকার ছুঁচো-সদৃশ একধরণের প্রানী থেকে এসেছে স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং মানুষের পুর্বপূরুষেরা। মূলকথা হল, আমাদের পৃথিবীতে দেখা জীবজগতের মধ্যে উৎপত্তিগতভাবে, বংশধারার উত্তরাধিকারসূত্রে পারষ্পরিক একটা সম্পর্ক রয়েছে।  অর্থাৎ, তিনশ কোটি বছর আগে থেকে শুরু করে বর্তমানকালের সকল জীবই আসলে একে অন্যের আত্মীয়!

ছবিঃ ) তিনশ কোটি বছর আগে থেকে শুরু করে বর্তমানকালের সকল জীবই আসলে একে অন্যের আত্মীয়!  খ) পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিবর্তনের এক সরল রেখচিত্র

কিভাবে বিবর্তন কাজ করে? এটা বলতে গেলেই কিন্তু  ডারউইনের অবদানের কথা সামনে এসে পড়বে। ১৯৫৯ সালে চার্লস ডারউইন ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’ নামে যে গ্রন্থ রচনা করেন, তাতে তিনি প্রথমবারের মত ব্যাখ্যা করেন বিবর্তনের পিছনে চালিকা শক্তি হল প্রাকৃতিক নির্বাচন’ বা ন্যাচারাল সিলেকশন বলে একটা ব্যাপার। প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাপারটা কিন্তু ভারি মজার। রোমান্টিক ব্যক্তিরা হয়ত এতে রোমান্সের গন্ধ পাবেন। জীব জগতে স্ত্রীই হোক আর পুরুষই হোক কেউ হেলা ফেলা করে মেশে না। মন-মানসিকতায় না বনলে, প্রকৃতি পাত্তা দেবে মোটেই। প্রকৃতির চোখে আসলে লড়াকু স্ত্রী-পুরুষের কদর বেশী। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃতি যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেছে নেয় আর অযোগ্য প্রতিদ্বন্দীকে বাতিল করে দেয়, ফলে একটি বিশেষ পথে ধীর গতিতে জীবজন্তুর পরিবর্তন ঘটতে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।  কিভাবে সেটা ঘটে? ঝানুমাথা বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্ব কপচিয়ে সেটা ব্যাখ্যা করবেন। আমি খুব বেশি জটিলতার মধ্যে না ঢুকে প্রাকৃতিক নির্বাচন জিনিসটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য বেছে নেব নীচের তিনটা ধাপকে –

১) জনপুঞ্জের অধিবাসীরা নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে (জীববিজ্ঞানীরা এর একটা গালভরা নাম দিয়েছেন – ‘রেপ্লিকেশন‘)।

২) প্রতিলিপি করতে গিয়ে দেখা যায় – প্রতিলিপি গুলো নিঁখুত হয় না, অনেক ভুল ভাল হয়ে যায় (জীববিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘মিউটেশন‘)

৩) এই ভুল ভালের কারণে প্রজন্মে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের তারতম্য ঘটে ( জীববিজ্ঞানিরা বলেন ‘ভ্যারিয়েশন‘)

কাজেই রেপ্লিকেশন, মিউটেশন এবং ভ্যারিয়েশনের সমন্বয়ে যে সিলেকশন প্রক্রিয়া জীবজগতের জনপুঞ্জে যে পরিবর্তনের জন্য দায়ী তাকেই আমরা প্রাকৃতিক নির্বাচন নামে অভিহিত করব।  [আধুনিক জীববিজ্ঞানী এবং বংশগতিবিদেরা অবশ্য প্রজাতির উৎপত্তি এবং পরিবর্তনের পেছনে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পাশাপাশি অন্য বেশ কিছু ফ্যাক্টরকেও এখন গন্য করে থাকেন, যেমন – জিন মিউটেশন, ক্রোমজম মিউটেশন, জেনেটিক রিকম্বিনেশন, জিনের পুনরাগমন বা জিন প্রবাহ, জেনেটিক ড্রিফট এবং অন্তরণ বা আইসোলেশন। তবে এই প্রবন্ধে আমি জটিলতা এড়াতে কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচনের ব্যাপারটাই ব্যাখ্যা করব ] ডারউইনের মতে, জীবন সংগ্রামে যে সকল পরিবৃত্তি বা ভ্যারিয়েশন জীবকে সুবিধা করে দেয়, সেগুলো জীবকে টিকে থাকতে আর অধিক হারে বংশধর রেখে যেতে সাহায্য করে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যে পরিবৃত্তিগুলো অধিক অভিযোজনক্ষম, সেগুলোর বাহক জীবেরা বাড়তি সুবিধা পেয়ে উদ্বর্তিত হয়। ডারুইন একে বলেছিলেন পরিবর্তনযুক্ত উত্তরাধিকার বা ‘ডিসেন্ট উইথ মডিফিকেশন’। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবে চলতে থাকলে একসময় পরিবর্তনযুক্ত উত্তরাধিকার থেকে নতুন প্রজাতির উপত্তি হয়। ব্যাপারটা আরো ভালভাবে বোঝা গেছে আনবিক জীববিদ্যা এবং জেনেটিক্সের আবির্ভাবের পর।  এর ফলেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের পাশাপাশি বিবর্তনের জন্য খুঁজে পাওয়া গেছে আরো কিছু ফ্যাক্টর: জিন মিউটেশন, ক্রোমজম মিউটেশন, জেনেটিক রিকম্বিনেশন, জেনেটিক ড্রিফট এবং অন্তরণ বা আইসোলেশন। জীবন সংগ্রামে যে সব প্রকারণ জীবকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে বেশী সুবিধা করে দেয় সেই সব জিনের অধিকারী জীবই বড় হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকে এবং যারা পরিবেশের সাথে কম খাপ খাওয়াতে পারে তাদের তুলনায় তারা অনেক বেশী সন্তান রেখে যেতে সক্ষম হয়। ডারউইন বিবর্তনকে দেখেছিলেন ব্যক্তিগত প্রাণী বা উদ্ভিদ এবং প্রজাতির স্তরে, আর আধুনিক জীববিজ্ঞানিরা  বিবর্তন দেখেন জিন, বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য এবং জনপুঞ্জে। একটি প্রজাতির কতগুলো জীব যখন নিজেদের মধ্যে যৌন প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে তখন তাদের জনপুঞ্জের সবার জিনের সমষ্টিকে একসঙ্গে বলে জিন সম্ভার। একদিকে যৌন প্রজননের মাধ্যমে ছেলে মেয়ের মধ্যে বাবা মার জিনের যে জেনেটিক রিকম্বিনেশন হয় তার ফলে পরবর্তী প্রজন্মে জিনের অদলবদল ঘটে, আবার অন্য দিকে, জিনের মধ্যে আকস্মিকভাবে পরিবর্তন ঘটার ফলে কখনও কখনও তার ডিএনএর গঠন বা সংখ্যায়ও পরিবর্তন ঘটে, যাকে বলা হয় পরিব্যাক্তি। মিউটেশনের মাধ্যমেই প্রকারণের সৃষ্টি হচ্ছে আর তারপর যৌন প্রজননের মাধ্যমে তা সমগ্র জিন পুলে মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। কাজেই আধুনিক বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেন জনপুঞ্জে জিনপুলের পরিবর্তনের নিরিখে।  সে হিসেবে বিবর্তনের আধুনিক (নব্য ডারউইনবাদী) সংজ্ঞাটি হবে অনেকটা এরকম –

Evolution is a change in the gene pool of a population over time. 

এখন কথা হচ্ছে, কিশোর যেমন বলেছেন –

বিবর্তন কি কেবল এক চমকপ্রদ কল্পকাহিনী?

বিবর্তন চমকপ্রদ, তাতে সন্দেহ নেই, তবে মোটেই কল্পকাহিনী নয়।  কেন নয়? এত তত্ত্বকথায় না গিয়ে একটু খোলা মন নিয়ে বিষয়টা পর্যালোচনা করলেই হয়।  আজ থেকে দেড়শ বছর আগে জীববিজ্ঞানীদের প্রায় সকলেই কিন্তু ছিলেন সৃষ্টিতাত্ত্বিক (এমনকি ডারউইন নিজেও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন ধর্মতত্ত্ব শিখে ধর্মযাজক হওয়ার জন্য)। তখন কেউ প্রাণ কিভাবে সৃষ্টি হল, কিংবা প্রজাতি কিভাবে সৃষ্টি হল এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে ঈশ্বরের মাহাত্ম্য খুঁজতেন, বিশ্বাস করতেন ধর্মগ্রন্থে বলা ‘ছয় দিনে বিশ্ব তৈরীর কাহিনীতে’ কিংবা নূহ নবীর আমলে ঘটা মহাপ্লাবনের কেচ্ছা কাহিনীতে, সে সমস্ত সৃষ্টিতাত্ত্বিকরাই ঈশ্বর কিভাবে এগুলো বানিয়েছেন তা খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পারলেন যে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত কেচ্ছা কাহিনী গুলোর সাথে বাস্তবতার মিল পাওয়া যাচ্ছে না। তারা নিজেরাই বুঝলেন যে পৃথিবীর বয়স বাইবেলে বর্ণিত ছয় হাজার বছরের চেয়ে ঢের বেশী; নূহের প্লাবনের সাথে মাটি খুঁড়ে পাওয়া ফসিল রেকর্ড গুলো মিলছে না। শুধু তাই না পাওয়া যাচ্ছে কিম্ভুতকিমাকার বিলুপ্ত প্রজাতির হাড়-গোড় আর আর জীবাশ্ম। এমনকি পাওয়া যাচ্ছে ‘মিসিং লিঙ্ক’ হিসেবে পরিচিত দুই ট্যাক্সার বৈশিষ্ট্যযুক্ত নানা ফসিল। ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্বের এবং পরবর্তীতে সাইটোজেনেটিক্স এবং আনবিক জীববিজ্ঞানের আবির্ভাবের পর সবকিছুই তাদের কাছে পানির মত পরিস্কার হয়ে গেল।  বলা বাহুল্য যে, আজকের দিনে জীববিজ্ঞানীদের সকলেই বিবর্তনবাদী। কোন বৈজ্ঞানিক জার্নালেই বিবর্তনকে অস্বীকার বা বিরোধিতা করা হয় না; সেখানে হয়তো বিবর্তন কিভাবে ঘটছে তার পদ্ধতি নিয়ে (যেমন ধীর গতিতে ঘটছে নাকি উল্লফন ঘটছে) মতানৈক্য হতে পারে, বিতর্ক হতে পারে বিবর্তনের পদ্ধতি কি ফাইলেটিক, স্যালটেশন নাকি কোয়ান্টাম এ নিয়ে; কিন্তু বিবর্তন যে ঘটছেই সে ব্যাপারে জ্বীবিজ্ঞানী এবং প্রাণরসায়নবিদদের মধ্যে এখন কোনোই সংশয় নেই। আর সেজন্যই বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী এবং আধুনিক বিবর্তনবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা থিওডসিয়াস ডাবঝানস্কি বলেছেন যে,

Nothing in Biology makes any sense except in the light of evolution

মানে, বিবর্তনের আলোকে না দেখতে পারলে জীববিজ্ঞানের কোন কিছুরই অর্থ হয় না। এ কথা খুবই সত্যি। বস্তুতঃ বিবর্তনের সপক্ষে প্রমাণ আজ এতোই বেশী যে সেগুলোকে অস্বীকার করার অর্থ অনেকটা পৃথিবীর গোলত্বকে অস্বীকার করার মতই। আসুন আমরা বরং বিবর্তনের সাক্ষ্যপ্রমাণগুলোর দিকে তাকাই।

বিবর্তনের সাক্ষ্যঃ

বিবর্তন বা জৈব অভিব্যক্তির পক্ষে যে সমস্ত সাক্ষ্য হাজির করা যায় তা হল : প্রাণ রাসায়নিক প্রমাণ, কোষবিদ্যা বিষয়ক প্রমাণ, শরীরবৃত্তীয় প্রমাণ, সংযোগকারী জীবের (connecting link) প্রমাণ, ভৌগলিক বিস্তারের (Geographical distribution) প্রমাণ, তুলনামূলক অঙ্গসংস্থানের প্রমাণ, শ্রেনীকরণ সংক্রান্ত প্রমাণ, নিষ্ক্রিয় বা বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গের প্রমাণ ইত্যাদি। আর ফসিলের সাক্ষ্য তো আছেই। তবে ১৯৫০ সালের পর থেকে বিবর্তনের সপক্ষে সবচেয়ে জোরালো এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া গেছে ‘আনবিক জীববিদ্যা’ (molecular biology) এবং সাইটোজেনেটিক্স (cytogenetics) থেকে। ১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএনএ’র আনবিক গঠন উদ্‌ঘাটন করেন। তারা ডিএনএ অনুর যে মডেল প্রস্তাব করেন তা ‘ওয়াটসন-ক্রিক’ যুগল-সর্পিল মডেল নামে পরিচিত। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে দুই বিলিয়ন ডলার বাজেট নিয়ে ২০ বছর ব্যাপী মানব-জিনোম প্রকল্প শুরু হয়, যা ২০০৪ সালে শেষ হয়েছে। ভবিষ্যতে জিনের মধ্যে খুঁজলেই পাওয়া যাবে আমাদের বিবর্তনের ইতিহাস। ইতিমধ্যেই দেখা গেছে আমাদের ডিএনএ শিম্পাঞ্জীর ডিএনএ’র সাথে প্রায় ৯৮.৬%, ওরাং ওটাং-এর সাথে ৯৭% এবং ইদুরের সাথে ৮৫% মিলে যাচ্ছে। এর উত্তর কি? উত্তর খুব সোজা। বিবর্তন তত্ত্ব বলছে প্রজাতিগুলো যত কাছাকাছি সম্পর্কিত, তাদের জেনেটিক গঠনও থাকবে কাছাকাছি। শিম্পাঞ্জীকুলের সাথে আমাদের জেনেটিক গঠণে এতো মিল কারণ, আমরা ৫০-৮০ লক্ষ বছর আগে এক ধরনের শিম্পাঞ্জী থেকে বিবর্তিত হয়েছি। সে তুলনায় ইদুরের ডিএনএ’র সাথে আমাদের ডিএনএ’র মিল কম কারণ সেই প্রজাতি থেকে বিচ্ছিন্নকরণ ঘটেছিল শিম্পাঞ্জী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনেক অনেক আগে। কিশোর সাহেব কি এগুলোর খবর জানেন না?

 বিভিন্ন জীবের বংশানুসৃত দ্রব্য ডিএনএ এবং আরএনএ এবং প্রোটিনের অনুগুলোর আনবিক গঠণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তাদের আনবিক গঠণ ও একই রকমের। যেমন প্রকৃতিতে ৩৯০ রকমের এমাইনো এসিড পাওয়া গেলেও দেখা গেছে প্রতিটি জীব গঠিত হয়েছে মাত্র ২২টি এমাইনো এসিডের রকমফেরে। অর্থাৎ একই রকমের (২২টি) এমাইনো এসিড দিয়ে সকল জীবের প্রোটিন গঠিত। প্রোটিন অনুতে এমাইনো এসিডের আবশেষগুলোর পর্যায়ক্রমিক বিন্যাসকে বলে এমাইনো এসিড অনুক্রম। ঠিক একই রকমভাবে দেখা গেছে যে, সকল জীবের ডিএনএ অনুর গঠন একক বেসও একই ধরনের। মাত্র চার প্রকার বেস (এডেনিন, গুয়ানিন, থাইমিন ও সাইটোসিন) দিয়ে সকল জীবের ডিএনএ গঠিত। প্রতি বছরই প্রকৃতিতে প্রায় হাজার খানেক করে নতুন প্রজাতির  সন্ধান পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। প্রতিদিনই নতুন নতুন ডিএনএ এবং প্রোটিন সংশ্লেষণ করছেন তারা ল্যাবরেটরীতে বসে। একটি ক্ষেত্রেও তারা ব্যতিক্রম পাননি। জীব জগতের প্রজাতি যদি কোন ‘অতিপ্রাকৃত মহাপরাক্রমশালী’ স্রষ্টার হাতের কারসাজিতে সৃষ্ট হতো, তবে ইচ্ছে করলেই তিনি অজানা অচেনা জেনেটিক পদার্থ দিয়ে কোন প্রজাতি বা জীব তৈরী করতে পারতেন। সেরকম কোন জীবই এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। আসলে সকল জীবের উৎপত্তি যদি একই উৎস থেকে বিবর্তিত না হয়ে থাকে তবে আধুনিক জীববিদ্যার এ সমস্ত তথ্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। কাজেই সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই যে, জীবের উৎপত্তি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় – তা সে ‘আশরাফুল মাখলুকাৎ’ মানুষই হোক অথবা বিশাল বপু হিপোপটেমাসই হোক – সকলেই একই উৎসের ধারাবাহিক বিবর্তনের ফসল।

শুধু তাই নয় – আনবিক জীববিদ্যা খুব ভাল ভাবে দেখিয়েছে যে প্রোটিনে এমাইনো এসিডের অনুক্রমে পরিবর্তনের কারণ ডিএনএ জেনেটিক কোডে মিউটেশন। মিউটেশনের হারও নানাভাবে নির্ণয় করা হয়েছে। যেমন প্রোটিনের এমাইনো এসিড অনুক্রম ও নিউক্লিয়িক এসিডে পলিনিউক্লিয়িড অনুক্রম বিশ্লেষণ করে যথাক্রমে এমাইনো এসিড আর বেসের প্রতিস্থাপন হিসেব করে মিউটেশনের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। দেখা গেছে সমগ্র জীব জগতে গড়ে ১৭.৬ মিলিয়ন বছরে একটি এমাইনো এসিড প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এর ভিত্তিতে হিসেব করলে দেখা যায় প্রাণী ও উদ্ভিদ একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে ৭৯২ মিলিয়ন বছর আগে। এ হিসেবটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের হিসেবের সাথে অবিকল মিলে যায়। সরিসৃপ এবং স্তন্যপায়ীদের ‘সাইটোক্রোম সি’ অনুর মধ্যে এমাইনো এসিডের গড় পার্থক্য থেকে হিসেব করে বের করা হয়েছে যে এ দুটি গ্রুপের পৃথক হতে সময় লেগেছে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছর। ঠিক একই ভাবে শিম্পাঞ্জী, ওরাং-ওটাং ও মানুষ বিবর্তনের ধারায় কখন একে অন্য থেকে স্বতন্ত্র হয়েছে তাও খুব নির্ভরযোগ্যভাবে নির্ণয় করা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের শাখাগুলোর সমস্ত সাক্ষ্যই বিবর্তন তত্ত্বের পক্ষে গেছে, এমন কোন কিছু পাওয়া যায়নি যাতে মনে হতে পারে বিবর্তন তত্ত্ব অথৈ সমুদ্রে পড়েছে।

কোষবংশগতিবিদ্যা এবং আনবিক জীববিদ্যা বর্তমানে বিবর্তনের সপক্ষে এক অফুরন্ত তথ্য ভান্ডার। শুধু এগুলোর সাহায্যেই প্রমাণ করা যায় যে প্রকৃতিতে বিবর্তন ঘটেছে এবং সেই সাথে নির্ভরযোগ্যভাবে রচনা করা যায় পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি ও বিকাশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, মাটি খুঁড়ে ফসিলগুলো যদি নাও পাওয়া যেত, তবু শুধু জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করেই বিবর্তনকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব – এটি এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়। ডঃ রিচার্ড ডকিন্স তাই তাঁর ‘The Ancestor’s Tale’ বইয়ে বলেছেন :

“In spite of the fascination of fossils, it is surprising how much we would still know about our evolutionary past without them. If every fossil were magicked away, the comparative study of modern organisms, of how their patterns of resemblances, especially of their genetic sequences, are distributed among species, and of how species are distributed among continents and islands, would still demonstrate, beyond all sane doubt, that our history is evolutionary, and that all living creatures are cousins. Fossils are a bonus. A welcome bonus, to be sure, but not an essential one.’

ম্যাক্রোবিবর্তনের পক্ষে খুব জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে রক্তরস বিজ্ঞান থেকেও। রক্তকে জমাটবদ্ধ হতে দিলে যে তরল পদার্থ পৃথক হয়ে আসে তার নাম সিরাম। এতে থাকে এন্টিজেন। এ সিরাম এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে প্রবেশ করালে উৎপন্ন হয় এন্টিবডি। যেমন মানুষের সিরাম খরগোশের দেহে প্রবেশ করালে উৎপন্ন হয় এন্টি হিউম্যান সিরাম। এতে থাকে এন্টি হিউম্যান এন্টিজেন। এ এন্টিহিউম্যান সিরাম অন্য মানুষের সিরামের সাথে মেশালে এন্টিজেন এবং এন্টিবডি বিক্রিয়া করে অধঃক্ষেপ বা তলানি উৎপন্ন হয়।  এই অ্যান্টি হিউম্যান সিরাম মানুষ, নরবানর, ‘পুরোন পৃথিবীর’ বানর, লেমুর প্রভৃতির সিরামের সাথে বিক্রিয়া করালে দেখা যাবে, যে প্রাণীগুলোর সাথে মানুষের সম্পর্কের নৈকট্য যত বেশি তলানির পরিমান তত বেশি হয়।  প্রাণীগুলোর মধ্যে বিক্রিয়ার অনুক্রম হল :

মানুষ –> নরবানর –>পুরোন পৃথিবীর বানর –> লেমুর

অঙ্গসংস্থানবিদদের মতে উল্লিখিত প্রাণীদের মধ্যে সর্বাধিক আদিম হচ্ছে লেমুর, আর সবচেয়ে নতুন প্রজাতি হচ্ছে মানুষ। তাই মানুষের ক্ষেত্রে তলানির পরিমাণ পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি আর লেমুরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম। দেখা যাচ্ছে বিবর্তন যে অনুক্রমে ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়েছে রক্তরস বিজ্ঞানের ‘অ্যান্টিজেন এন্টিবডি’ বিক্রিয়াও সে ধারাবাহিকতাকেই সমর্থন করে।

এই ছোট্ট প্রবন্ধে বিবর্তনের সাক্ষ্যের আলামত লিপিবদ্ধ করতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই মহাভারত হয়ে যাবে। তারপরও পাঠকদের জন্য সামান্য কিছু ‘প্রমাণ’উল্লেখ না করলে অন্যায়ই হবে –

* জীবজগত  রেপ্লিকেশন, হেরিটাবিলিটি, ক্যাটালাইসিস এবং মেটাবলিজম  নামক সার্বজনীন মৌলিক প্রক্রিয়ার অধীন, যা জীবন প্রক্রিয়ার এক অভিন্ন উৎসের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে।

* সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতি উদ্ভুত হলে প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকবে, এক গ্রুপ থেকে সাব গ্রুপ তৈরি হবে, এবং এ সমস্ত কিছুকে জাতিজনি বৃক্ষ (Phylogenetic tree) আকারে সাজানো যাবে। ঠিক তাই পাওয়া যাচ্ছে। 

* বিবর্তন তত্ত্ব থেকে আমরা যে সমস্ত সিদ্ধান্ত টানছি তা প্রত্নতত্ত্ব, জৈব রসায়ন, আনবিক জীববিদ্যা, কোষ বংশবিদ্যা কিংবা জেনেটিক ট্রেইটের থেকে পাওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সাথে মিলে যাচ্ছে।

* প্রাণীর ফসিলগুলো এই জাতিজনি বৃক্ষের ঠিক ঠিক জায়গায় খাপ খেয়ে যাচ্ছে। বহুক্ষেত্রে আমরা ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল বা ‘মিসিং লিঙ্ক’ খুঁজে পেয়েছি।

* বহু প্রানীর মধ্যে অসম্পূর্ণ ডানা, চোখ কিংবা নিষ্কৃয় অঙ্গাদির অস্তিত্ব রয়েছে।

* আতাভিজম মাঝে মধ্যে ঘটতে দেখা যায়।  তিমির পেছনের পা, ডলফিনের পেছনের ফিন, ঘোড়ার অতিরিক্ত আঙ্গুল বিশিষ্ট পা কিংবা  লেজবিশিষ্ট মানব শিশু প্রকৃতিতে মাঝে মধ্যেই জন্ম নিতে দেখা যায়। এটা বিবর্তনের কারনেই ঘটে।  কারণ, কোন অংগ লুপ্ত হয়ে গেলেও জনপুঞ্জের জীনে ফেনোটাইপ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ডিএনএ সেই তথ্য রেখে দেয়। তার পুনঃপ্রকাশ ঘটতে পারে বিরল কিছু ক্ষেত্রে। লেজ বিশিষ্ট মানব শিশুর কিছু সচিত্র বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যাবে এখানে।

* জীবজগতে প্রজাতির বিন্যাস বিবর্তনের ইতিহাসের ক্রমধারার সাথে সঙ্গতি বিধান করে। যেমন, মার্সুপিয়ালেরা শুধু আস্ট্রেলিয়াতেই সীমাবদ্ধ। যা কিছু ব্যতিক্রম পাওয়া যায় তাকে কন্টিনেন্টাল ড্রিফট বা মহাদেশীত সঞ্চারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। মুল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অন্তরিত দ্বীপে এমন সমস্ত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রানী পাওয়া যাচ্ছে যা মূল ভূখন্ডে অনুপস্থিত।  ডারউইনও গ্যালাপাগাস দ্বীপে গিয়ে নানা রকমের ঠোঁটের আকার সম্পন্ন ফিঙ্গে, বিরাট গলা বিশিষ্ট কচ্ছপ পেয়েছিলেন, দেখেছিলেন সাঁতার কাটা ইগুয়ানা, যেগুলো আর কোথাও দেখা যায় না।  তেমনি কোকাস দ্বীপে এমন একধরনের কাঁকড়া দেখেন যারা গাছের নীচে পড়া নারকেল ভেঙ্গে খায়।, এক ধরনের কুকুর দেখেন যারা ডুব দিয়ে সমুদ্রের পানি থেকে মাছ শিকার করে আনে, কিছু মাছ আছে যারা আবার কোরাল খেয়ে জীবন ধারণ করে। ওখানে বিরাট বিরাট আকারের ঝিনুক আছে যা মানুষের পা কামড়ে ধরে আর ডুবিয়ে মেরে ফেলে। ওখানকার ইদুরেরা তালগাছের আগায় গিয়ে বাসা বাঁধে। কাজেই অন্তরণের ফলে জীবজগতে নানা ধরণের অভিযোজিত বৈশিষ্ট্যর আগমন ঘটে এবং তা থেকে নতুন নতুন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে তা বহুভাবেই প্রমাণিত।

* বিবর্তন তত্ত্ব অনুয়াযী পুর্ব বিকশিত অংগ-প্রত্যঙ্গ থেকেই নতুন অঙ্গের কাঠামো তৈরির ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীর সামনের হাত বা অগ্রপদের মধ্যে তাই লক্ষ্যনীয় মিল দেখা যায়! ব্যাঙ, কুমীর, পাখি, বাদুর, ঘোড়া, গরু, তিমি মাছ এবং মানুষের অগ্রপদের গঠন প্রায় একই রকম।  তুলনামূলক একটা ছবি দেখা যাবে এখান থেকে। এখন আমরা জানি, আধুনিক জেনেটিক্স-এর গবেষণাও সেই একই দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করছে।

* একই ব্যাপার খাটে আনবিক স্তরেও।  তাই ফ্রুটলাই  আর মানুষের মধ্যে বাহ্যিক পার্থক্য যতই থাকুক না কেন, এরা শতকরা সত্তুরভাগেরও বেশি ‘কমন জিন শেয়ার করে। আর যে পূর্বপূরুষের সাথে কাছাকাছি সময়ে কোন প্রজাতি বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তাদের জিনগত নৈকট্যও তত বেশি  থাকে। সেজন্যই মানুষের সাথে ওরাং ওটাং -এর ডিএনএ অণুর বেইস জোড়ের মধ্যে পার্থক্য মাত্র ২.৪%, গরিলার সাথে ১.৪%, আর শিম্পাঞ্জীর সাথে মাত্র ১.২%। বিবর্তন তত্ত্ব সঠিক না হলে এই ব্যাপারটি কখনোই ঘটতো না।

* অনেক সময় একই ধরনের কাজ করলেও বিবর্তন ঘটে স্বতন্ত্র ভাবে কিংবা সমান্তরাল পথে। যেমন, পাখি, বাদুর কিংবা পতঙ্গের পাখা উড়তে সহায়তা করলেও এদের  গঠন ভিন্ন । 

* প্রজাতি গঠনের বিভিন্ন উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। 

* আধুনিক বিজ্ঞানের কোন শাখা থেকে পাওয়া তথ্য বিবর্তনের বিপক্ষে যাচ্ছে না।

লুপ্ত এবং নিষ্ক্রিয় অঙ্গাদি: বিবর্তনবিরোধীদের জবাব কি?


বিবর্তনের পক্ষে এরকম গন্ডা গন্ডা প্রমাণ হাজির করা যায়। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হল মানবদেহে থেকে যাওয়া বিলুপ্ত প্রায় অংগের প্রমাণ। যেমন, আমাদের পরিপাকতন্ত্রের অ্যাপেন্ডিক্স কিংবা পুরুষের স্তনবৃন্ত। এগুলো দেহের খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে লাগে না, এবং বর্তমানে অ্যাপেন্ডেসাইটিস রোগের বড় উৎসই হল এই অ্যাপেন্ডিক্স। তা হলে এগুলো দেহে থাকার কি ব্যাখ্যা? একজন ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনারের’ সৃষ্টি এত ‘আনইন্টেলিজেন্ট’ হবে কেন যে ত্রুটিগুলো ছা-পোষা সাধারণ মানুষেরও চোখে পড়বে? কিশোর বলেছেন, ‘অনেক খোজা খুজি করে বিজ্ঞানীরা মানব দেহের এপেন্ডিসাইটিস নামক একটা প্রত্যঙ্গকে অপ্রয়োজনীয় বা অপসৃয়মান এরকম সিদ্ধান্তে এসেছে।’  কিশোরের কথা শুনে মনে হচ্ছে নিষ্ক্রিয় অংগ খোঁজার জন্য আকাশ পাতাল চষে ফেলতে হচ্ছে। আর স্বর্গ-মর্ত চষে ফেলে যেন শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছে একমাত্র অংগ এপেন্ডিক্স!

না শুধু অ্যাপেন্ডিক্স নয়, আমাদের দেহে রয়ে গিয়েছে চোখের নিক্টিটেটিং ঝিল্লি, কান নাড়াবার কিছু পেশী, ছেদক, পেষক এবং আক্কেল দাঁত, মেরুদন্ডের একদম নীচে থেকে যাওয়া লেজের হাড়, সিকাম সহ শতাধিক নিষ্ক্রিয়, অবান্তর এবং বিলুপ্ত অঙ্গাদি।  নীচে মানব দেহের কিছু বিলুপ্ত প্রত্যঙ্গের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল –

 

* পুরুষের স্তনবৃন্ত: স্তন এবং স্তনবৃন্ত মূলতঃ দরকার মেয়েদের। পুরুষদের এটা কোন কাজে আসে না। অথচ সকল পুরুষদের দেহে বিবর্তনের সাক্ষ্য হিসবে রয়ে গেছে স্তনবৃন্তের চিহ্ন।  

* পুরুষদের ইউটেরা:ুরুষদেহের অভ্যন্তরে সুপ্ত এবং অব্যবহার্য অবস্থায় স্ত্রী-জননতন্ত্রের স্তিত্ব আছে।

* ত্রয়োদশ হাড়: আধুনিক মানুষদের পাঁজরে বারো সেট করে হাড় থাকে। কিন্তু মানুষদের জনপুঞ্জের শতকরা ৮ ভাগ লোকের ক্ষেত্রে তেরতম হারের সন্ধান পাওয়া যায়। এই ত্রয়োদশ হাড় দেহের বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা যায় গরিলা ও  শিম্পাঞ্জীর মধ্যে। মানুষ যে এক সময় প্রাইমেটদের থেকে বিবর্তিত হয়েছে এই আলামতগুলো দেখে বোঝা যায়।  

* লেজের হাড়:ানবদেহের মেরুদন্ডের একদম নীচে থেকে যাওয়া লেজের হাড় (Coccyx) আমাদের কোন কাজেই আসে না। আমাদের আদি প্রাইমেট পূর্বপুরুষেরা গাছের ডালে ঝুলে ভারসাম্য বজায় রাখার কাজে একে ব্যবহার করত।

* আক্কেল দাঁত:াথুরে অস্ত্রপাতি আর আগুনের ব্যবহার জানার আগে মানুষ মূলতঃ নিরামিশাষী ছিলো। আক্কেল দাঁত তখন কিছুটা কাজে লাগলেও এখন আর লাগে না। 

*অ্যাপেন্ডিক্স: অ্যাপেন্ডিক্স মানুষের কোন কাজে আসে না, বরং অ্যাপেন্ডিসাইটিস নামের রোগের উস এটি।

* গায়ের লোম: মানুষকে অনেক সমউ ‘নগ্ন বাঁদর’ বা ‘নেকেড এপ’ নামে সম্বোধন করা হয়। আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই লোমশ শরীরের অস্তিত্ব দেখা যায় এখনো। আমরা লোমশ প্রাইমেটদের থেকে বিবর্তিত হয়েছি বলেই এই আলামত এখনো রয়ে গেছে।

* গুজ বাম্প: শীতে বা ভয়ে আমাদের শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। তখন আমাদের দেহের লোমকূপ ফুলে ওঠে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের গায়ের কেশর, লোম বা পালক ফুলিয়ে বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করার উপায় খুঁজত। এই আলামত বিবর্তনের কারণেই আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। 

* কান নাড়ানোর পেশী: আমাদের বিখ্যাত কমেডিয়ান রবিউল তার কান নাড়াতে পারতেন। আমাদেরও অনেক বন্ধুবান্ধব কান নড়াতে পেরে অন্যদের মজা দেন। পনি যদি আপনার কান আপনার চ্ছায় নারাতে পারেন, তবে আপনার উচি হবে আপনার প্রাইমেট পূর্বপুরুষদের একটা ধন্যবাদ দেয়া।

* আঁখি আবরনী: আপনি আয়নার সামনে দাঁরালে আপনার চোখের কোনায় যে উঁচু মাংশপিন্ড দেখেন, তা হচ্ছে আপনার চক্ষু আবরণী বা ‘আই লীড’। এটাও আপনার আছে বিবর্তনের প্রত্যক্ষ আলামত হিসেবে। 

কোন মহান ‘সৃষ্টি তত্ত’  কিংবা ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ দিয়ে এগুলো ব্যাখ্যা করা যায় না। এ মুহূর্তে এগুলোকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে কেবল বিবর্তন তত্ত্ব। দেখা গেছে, এপেন্ডিক্স এবং সিকাম মানুষের কাজে না লাগলেও তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হজম করার জন্য অত্যাবশকীয় অংগ। প্রাচীন নরবানর যেমন অস্ট্রালোপিথেকাস রবাস্টাসেরা তৃণ সহ সেলুলোজ জাতীয় খাদ্য প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করত। এখনো শিম্পাঞ্জীরা মাংশাসী নয়। কিন্তু মানুষ খাদ্যাভাস বদল করে লতা পাতার পাশাপাশি একসময় মাংশাসী হয়ে পড়ায় দেহস্থিত এই অংগটি ধীরে ধীরে একসময় অকেজো এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তাই এখন অ্যাপেন্ডিক্স এবং সিকাম আমাদের কাজে না লাগলেও রেখে দিয়ে গেছে আমার এ প্রবন্ধের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ‘বিবর্তনের সাক্ষ্য’। ঠিক একই ভাবে তিমির বিলুপ্তপ্রায় অংগ হচ্ছে পেছনের পায়ের হাড়গুলো যেগুলো খুব পরিষ্কার ভাবে সাক্ষ্য দেয় যে এরা একসময় আর্টিওডাক্টিলা (হিপোপটেমাসের মত এক ধরনের স্থলচরী স্তন্যপায়ী প্রাণী) হতে বিবর্তিত হয়েছে।  আমি আরেকটি প্রবন্ধ ‘নন্দিত নকসা – নাকি অজ্ঞানতা ? (‘ব্যাড ডিজাইন’) প্রবন্ধটিতে  -এ মানবদেহের  অসংখ্য নিস্ক্রিয় অংগের উদাহরণ হাজির করেছি যা আসলে জীবদেহের কোন কাজেই আসে না।  বিবর্তন তত্ত্ব ছাড়া এগুলোর কোন ব্যাখ্যা নেই, কারণ ডিজাইন মানতে গেলে বলতেই হবে যে ওগুলো ভুল ডিজাইন। কিশোর সাহেব সেগুলোকে অস্বীকার করতে গিয়ে বলেছেন –

বিজ্ঞানীরা মানব দেহের এপেন্ডিসাইটিস নামক একটা প্রত্যঙ্গকে অপ্রয়োজনীয় বা অপসৃয়মান এরকম সিদ্ধান্তে এসেছে। তাদের বক্তব্য- দৃশ্যমান কোন জৈবনিক কর্মকান্ডে এ প্রত্যঙ্গটি অংশ গ্রহন করে না বা প্রত্যঙ্গটি অপসারন করলেও মানুষের বেচে থাকায় কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না। ঠিক একারনে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ উপাঙ্গটি ক্রমশঃ ছোট হয়ে ক্ষীন হয়ে যায়।কিন্তু আসলেই কি তা ঠিক? হয়তো অতি সূক্ষ্ম কোন জৈবনিক কর্মকান্ড তারা করে থাকে যা এখনও বিজ্ঞানীরা বের করতে পারে নি।

কিশোর অনেকগুলো ভুল করেছেন। মানব দেহের প্রত্যঙ্গটির নাম এপেন্ডিক্স, এপেন্ডিসাইটিস নয়। এপেন্ডিসাইটিস হচ্ছে এপেন্ডিক্সের প্রদাহজনিত রোগ।  বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এপেন্ডিক্স নামের প্রত্যঙ্গটি না থাকলে মানুষের কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু এপেন্ডিক্স থাকলে সারা জীবনে অন্ততঃ ৭% সম্ভাবনা থেকে যায় এপেন্ডিসাইটিসে আক্রান্ত হবার। এই মনোজ্ঞ ডিজাইনজনিত ত্রুটির ব্যাপারটি কিশোর সাহেব এড়িয়ে গেছেন। কিশোর সাহেব আরো যে জিনিসটি বলেননি তা হল, কোন অঙ্গের উপযোগিতা আছে কি নেই এটা বের করার সহজ পদ্ধতি হল এই উপাঙ্গটি ছাড়া কারো বেঁচে থাকতে বা চলতে ফিরতে বা স্বাভাবিক জীবন কাটাতে কারো কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, কিংবা অঙ্গটির অনুপস্থিতিতে কারো ‘সারভাইভাল ভ্যালু’ হ্রাস পাচ্ছে কিনা। যদি না পায়, তা হলে বুঝতে হবে এই প্রত্যঙ্গটির কোন বাড়তি উপযোগিতা নেই। কাজেই ‘হয়তো অতি সূক্ষ্ম কোন জৈবনিক কর্মকান্ড আছে যা বিজ্ঞানীরা বের করতে পারেনি’ – এগুলো বলার অর্থ হল পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া।  কিশোর দেহস্থিত এই হতচ্ছাড়া অপকারী অংগটিকে বাঁচাতে গিয়ে এমনকি হাত-পায়ের সাথেও তুলনা করতে ছাড়েননি। তিনি  বলেন, ‘মানুষের তো দুটি হাত বা পা কাটা গেলেও তো সে দিব্বি বেচে থাকে। তাহলে, কি বলতে হবে মানব দেহের জন্য কোন হাত পা এর দরকার নাই?’। কিশোর সাহেব এড়িয়ে গেছেন, হাত পায়ের সুনির্দিষ্ট কাজ আছে। মারা যদি নাও যায়, হাত পা কাটা পড়লে স্বাভাবিক চলৎশক্তি অনেকাংশেই ব্যহত হয়। হাত পা থাকার ফলে কারো  এপেন্ডিসাইটিসের মত প্রদাহ তৈরি হয় না কিংবা মৃত্যু  ঝুঁকিও তৈরি হয় না।  কাজেই হাত পায়ের সাথে এপেন্ডিক্সের তুলনা করাটা বালখিল্যই।

মধ্যবর্তী বা ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল নিয়ে ঘোট পাকিয়ে আর কি কোন লাভ আছে?

কিশোর সাহেব ইচ্ছায় হোক, আর অনিচ্ছায় হোক, সবচেয়ে বড় যে ভুলটি তার লেখায় করেছেন তা হল, প্রকাশ্যে বলা কোন মধ্যবর্তী বা ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল নাকি পাওয়া যায়নি।  তিনি বলেছেন,

একটি প্রজাতি যখন বিবর্তন ধারায় অন্য প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবে তখন নিশ্চয় দুই প্রজাতির মাঝা মাঝি এক মধ্য প্রজাতির জীব হিসাবে দীর্ঘদিন অতি বাহিত করবে কারন বিবর্তন ঘটে হাজার হাজার নয় বরং লক্ষ লক্ষ বছর ধরে । সুতরাং প্রকৃতিতে ভুরি ভুরি সেই সমস্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রজাতির দেখা মেলার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানীদের যাবতীয় তত্ত্বের মুখে ছাই দিয়ে সারা পৃথিবীতে এ ধরনের একটাও মধ্যমর্তী জীব বা প্রানীকে খুজে পাওয়া যায় না।

এটি একটি অসাড় এবং মিথ্যা উক্তি। যদিও ফসিল সংখ্যায় পাওয়া গেছে তুলনামূলকভাবে কম (এবং এটি প্রত্যাশিতই, কারণ পাললিক শিলা ছাড়া আর কোন শিলায় ফসিল তৈরী হতে পারে না, আর যাও বা পাললিক শিলার মধ্যে কোন ফসিল তৈরী হয়, অধিকাংশ সময়ই তা থেকে যায় মানুষের অগোচরে), তারপরও তা  দু-একটিও নয়, তুচ্ছও নয়। ঘোড়া, হাতী এবং উটের বিবর্তনের পুংখানুপুংখ ফসিল রেকর্ড পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় পাওয়া গেছে ‘মিসিং লিঙ্ক’ বলে কথিত দুটি ফাইলা বা অন্যান্য ট্যাক্সার বৈশিষ্টসমৃদ্ধ মধ্যবর্তী বা ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল। যেমন সরিসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী জীবে উত্তোরণের সম্পূর্ণ ধাপগুলো খুব ভালভাবে ডকুমেন্টেড (দেখুন : Evoluion, Doglas J. Futuyma, pp 76)। Synapsids, Therapsida, Cynodonta থেকে শুরু করে আদি স্তন্যপায়ী প্রাণী পর্যন্ত সবগুলো ধাপের একাধিক ফসিল পাওয়া গেছে। এমনকি তাদের চোয়াল কিভাবে ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়ছে সেগুলোও ফসিল থেকে উদ্ধার করা গেছে। ডঃ ফুতুয়ামা (যিনি মূলতঃ স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনের উপরেই সারাজীবন গবেষণা করেছেন) তার বইয়ে বলেন,

‘The fossil record thus shows that most mammalian characters (e.g. posture, tooth differentiation, skull changes associated with jaw musculature secondary palate, reduction of elements that became middle ear bones) evolved gradually. Evolution was mosaic, with different characters advancing at different rates. No new bones were evolved: all the bones of mammals are modified from those of the stem group of “reptiles” (and in turn from those of amphibians and even lobe-finned fishes). Some major changes in the form of structures are associated with changes in their function. The most striking example is the articular and quadrate bones, which serves for jaw articulation in all other terapods, but became the sound-transmitting middle ear bones of mammals.’

ঠিক তেমনি ভাবে সরীসৃপ থেকে কিভাবে পাখী বিবর্তিত হয়েছে তারও প্রায় সম্পূর্ণ ধাপগুলো পাওয়া গেছে। তার মধ্যে আছে Eoraptor, Herrerasaurus, Ceratosaurus, Allosaurus, Compsognathus, Sinosauropteryx, Protarchaeopteryx, Caudipteryx, Velociraptor, Sinovenator, Beipiaosaurus, Sinornithosaurus, Microraptor, Archaeopteryx, Rahonavis, Confuciusornis, Sinornis, Patagopteryx, Hesperornis, Apsaravis, Ichthyornis, Columba ইত্যাদির ফসিল। এর মধ্যে আর্কিওপটেরিক্সের (Archaeopteryx)ই পাওয়া গেছে গন্ডা খানেক ফসিল। যেমন ১৮৬১ সালে জার্মানীর ল্যাংগেনালথিমে (পরে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে স্থানান্তরিত; থডে ল্লনৈদনৈ শপচেমিনে), ১৮৭৭ সালে ব্লুমেনবার্গে (ভরেলনি শপচেমিনে), ১৯৫৮ সালে ল্যাংগেনালথিমে, ১৮৫৫ সালে রিডিনবার্গে , ১৯৫১ সালে ওয়ার্কারসজেলে, ১৯৬০ সালে জার্মানীর ইৎসচাটে, ১৯৯১ সালে ল্যাংগেনালথিমে, ২০০৫ এবং ২০০৬ এ জার্মানীতে আর্কিওপটেরিক্সের বিভিন্ন ফসিল উদ্ধার করা হয়েছে। চীনে (লিয়াওনিং) গত কয়েক বছরে এধনের ‘ডানা বিশিষ্ট ডায়নোসরের’ (Feathered Dinosaur) ফসিল পাওয়া গেছে প্রচুর। এর অনেকেগুলোই একেবারে সম্পূর্ণ ফসিল। যেমন,  আর্কিওপটেরিক্সের (বার্লিন স্পেসিমেন) কিংবা চীনে সম্প্রতি পাওয়া চার ডানা বিশিষ্ট মাইক্রোর‌্যাপটর গুইয়ের (নীচের ছবি) ফসিল দেখলেই বোঝা যায় যে এগুলোতে হাড় গোড়ের ছাঁচ থেকে শুরু করে পালক-বিশিষ্ট পাখা সবকিছুই এত স্পষ্ট যে এ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদ্যায় অজ্ঞ মানুষজনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন :

চিত্র : চীনে পাওয়া ‘ডানা বিশিষ্ট ডায়নোসরের’ (Feathered Dinosaur) ফসিল : মাইক্রোর‌্যাপটর গুই

মাছ এবং উভচর প্রাণীর মধ্যবর্তী ফসিলের উদাহরণ তো আছেই কোলাকান্থ এবং লাং ফিশ।  কোলাকান্থের একটি প্রজাতি জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেছে মাদাগাস্কার উপকূল এলাকায় ১৯৩৮ সালে। এর মধ্যে মাছ এবং উভচর প্রানীর বিবর্তনের এতগুলো মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যে একে ‘জীবন্ত ফসিল’ই বলা চলে।  এছাড়া সম্প্রতি পাওয়া গেছে মাছ থেকে চতুষ্পদী প্রানীতে বিবর্তনের মধ্যবর্তী বৈশিষ্টযুক্ত প্রাণী টিক্টালিকের ফসিল।  পাওয়া গেছে স্তন্যপায়ী প্রানী থেকে তিমির বিবর্তনের মাঝামাঝি ধাপগুলোর (Pakicetus inachus, Ambulocetus natans, Indocetus ramani, Dorudon, Basilosaurus) অসংখ্য ফসিল।  সরিসৃপ এবং স্তন্যপায়ীদের মাঝামাঝি জায়গার এত ফসিল এত অবিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া গেছে যে বিজ্ঞানীরা ধন্দে পড়ে যান যে এগুলোকে ‘ম্যামেলরূপী রেপ্টাইল’ বলবেন নাকি ‘রেপ্টাইলরূপী ম্যামল’ বলবেন।

চিত্র :মাছ এবং চতুশপদী প্রানীর বৈশিষ্ট্যযুক্ত টিক্টালিক

নরবানর (এপ) এবং মানুষের মধ্যবর্তী হারানো সূত্রের জীবাশ্মও কয়েক দশক আগে খুব ভালভাবেই পাওয়া গেছে। প্রখ্যাত জার্মান জীববিজ্ঞানী ও বিবর্তনবিদ আর্নেস্ট হেকেল (১৮৩৪-১৯১৯) উনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই ‘সৃষ্টির ইতিহাস’ -এ মন্তব্য করেছিলেন যে মানব বিবর্তনের ধারা যদি ঠিক হয়ে থাকে তবে মানুষ এবং এপের মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রাণীর জীবাশ্ম বা ফসিল শিগগিরি পাওয়া যাবে। প্রাপ্ত ফসিল থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আজ বলা যায় : Australopithecus এবং Homo -এর কয়েকটি প্রজাতিকে (যেমন, Australopithecus afarensis, Australopithecus africanus, Homo habilis, Homo erectus) তো মানব বিবর্তনের হারানো সূত্র বলা যেতেই পারে। আমাদের জনপ্রিয় ফসিল ‘লুসি’ Australopithecus afarensis প্রজাতির অন্তর্গত। শ্রোণিচক্র ও উরুর হারের গঠন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, লুসি সোজা হয়ে দাঁড়তে আর দৌড়াতে পারত।  আর লুসির তো কেবল এই দু’ জায়গার হাড় নয়, সেই সাথে পাওয়া গেছে চোয়াল, উরু, হাত, বাহু, বক্ষপিঞ্জর সহ পুরো করোটি। লুসির জীবশ্মটি আবিষ্কার করেছেন মার্কিন বিজ্ঞানী ডোনাল্ড জোহানসন (ধনৈালদ ছ. ঝডৈানসনৈ), ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ার হাডার থেকে। পরে এ ধরনের আরো অনেক ‘লুসির’ সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৭৮ সালে তাঞ্জানিয়ার লাটেও-লি তে এবং ১৯৯৫ সালে চাদের করোটো-রোতে। এমনকি লুসির চেয়েও পুরোন ‘বাইপেডাল মানুষের’ ফসিল পাওয়া গেছে ২০০৫ সালে। এদের সবাইকেই নরবানর আর মানুষের মধ্যবর্তী ‘হারানো যোগসূত্র’ হিসেবে ধরা হয় কারণ, এদের করোটির গঠন ছিল অনেকটা শিম্পাঞ্জীর মত (৪০০-৫০০ ঘন সি সি), কিন্তু তাদের দাঁতের গঠন ছিল আধুনিক মানুষের মত। আর তা ছাড়া এরা যে দু’পায়ের উপর ভর করে খাড়া হয়ে চলতে পারত তা তো আগেই বলা হয়েছে। এছাড়া এদের শরীরের সাথে বাহুর অনুপাত মেপে দেখা গেছে ( মানুষের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৭১.৮, শিম্পাঞ্জীর ক্ষেত্রে ৯৭.৮, আর লুসির ক্ষেত্রে ৮৪.৬) লুসির অবস্থান এ দু’প্রজাতির মাঝামাঝি। এরা পৃথিবীতে ছিল ৩ থেকে ৪ মিলিয়ন বছর আগে।


মানুষের অন্য প্রজাতিরও ফসিল পাওয়া গেছে অনেক। যেমন, নিয়ান্ডার্থাল আর ক্রো-ম্যাগনন। ১৮৬৬ আলে ফুলরট যখন প্রথম নিয়ান্ডর্থাল মানুষের ফসিল খুঁজে পেলেন ডুসেলডর্ফ শহরের কাছে চুনের এক খনি থেকে, অনেকেই তা যে মানুষের জীবাশ্ম – তা মানতে রাজী ছিলেন না। যেমন ডঃ ওয়াগনার বলেছিলেন, এটি কোন জীবাশ্ম নয়, বরং এক বৃদ্ধ ওলন্দাজের করোটি। বন নগরের ডঃ মেয়র বলেছিলেন এটি নেপোলিয়নের পেছনে ধাওয়া করা এক কসাক সৈন্যের করোটি। প্রনার-বে বলেছিলেন এটি সেল্টদের একটি খুলি। এমনকি রুডল্‌ফ ফিরকোর (
Rudolf Virchow) মত নামজাদা বিজ্ঞানী মনে করেছিলেন এটি কোন রিকেট রোগাক্রান্ত কোন লোকের বিকৃত মাথার খুলি হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় যে সেটি মানুষেরই একটি অন্য প্রজাতি, এবং এর নামকরণ করা হয় : Homo sapiens neanderthalen-sis বা চলতি ভাষায় নিয়ান্দার্থাল মানব। পরে তো নিয়ান্ডার্থাল মানুষের আরো ফসিল পাওয়া গেছে ফ্রান্সের লি মোস্টিয়া, লা ফেড়াসি, লা কুইনা, জিব্রাল্টারে; ইতালির মন্তে সিরসিয়ো ও সাগোপেস্তারে; ইরাকের শানিদারে, ইউক্রেনের কিইক-কোবাতে, ক্রোয়েশিয়ার ক্রাপিনাতে, জার্মানীর এহরেনডার্ফে, ইসরাইলের তাবুন, আমুদ এবং কেবারা-তে। এছাড়া ইউরোপ এবং এশিয়ার বাইরে আরো অনেক স্থানেই এদের ফসিল পাওয়া গেছে। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সময় পাওয়া গেছে জাভা মানুষ, পিকিং মানুষ, রামা-পিথেকাস, টাউং শিশু (Australopithecus africanus) , ওমানো মানুষ, ন্‌গালোবা মানুষ, জেবেল কাফজেহ, ভেরটেচ্‌জলেশ্চাস মানুষ, পেট্রালোনা মানুষ, টাউটাভেল মানুষ, সোয়ানকম্ব মানুষ, স্টেইনহেম মানুষ সহ অসংখ্য ফসিল।


উইকিপেডিয়ার পেইজেও ট্রাঞ্জিশনাল ফসিলের একটা ভাল তালিকা আছে। কোন প্রজাতির কয়টি ফসিল পাওয়া গেল এটি আজ কোন প্রশ্ন নয়, মুল প্রশ্ন হল একটি ফসিলও কি এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে যা বিবর্তনের ধারাকে লংঘন করে? এর সোজা সাপ্‌টা উত্তর – না এখন পর্যন্ত একটিও তেমন ফসিল পাওয়া যায় নি। একবার বিজ্ঞানী জেবি এস হালডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কিভাবে বিবর্তনকে ভুল প্রমাণ করা যায়? উত্তরে হালডেন বলেছিলেন, কেউ যদি প্রক্যাম্বরিয়ান যুগে খরগোশের ফসিল খুঁজে পায় :

I will give up my belief in evolution if someone finds a fossil rabbit in the Precambrian

বলা বাহুল্য এ ধরনের কোন ফসিলই এ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয় নি। না হওয়ারই কথা, কারণ বিজ্ঞানীরা বিবর্তনের যে ধারাটি আমাদের দিয়েছেন তা হল :

মাছ –> উভচর –> সরীসৃপ –> স্তন্যপায়ী প্রানী।

খরগোশ যেহেতু একটি পুরোপুরি স্তন্যপায়ী প্রাণী, সেহেতু সেটি বিবর্তিত হয়েছে অনেক পরে এবং বিভিন্ন ধাপে (মাছ থেকে উভচর, উভচর থেকে সরিসৃপ এবং সরিসৃপ থেকে শেষ পর্যন্ত খরগোশ), তাই এতে সময় লেগেছে বিস্তর। প্রিক্যাম্বরিয়ান যুগে খরগোশের ফসিল পাওয়ার কথা নয়, কারণ বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী এ সময় (প্রিক্যাম্বরিয়ান যুগে) থাকার কথা কতকগুলো আদিম সরম প্রাণ – যেমন নিলাভ সবুজ শৈবাল, সায়নোব্যকটেরিয়া ইত্যাদি (ফসিল রেকর্ডও তাই বলছে)। আর স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে ট্রায়োসিক যুগে (প্রিক্যাম্বরিয়ান যুগ শেষ হওয়ার ৩০ কোটি বছর পরে)। কাজেই কেউ সেই প্রিক্যাম্বরিয়ান যুগে খরগোশের ফসিল খুঁজে পেলে তা সাথে সাথেই বিবর্তনতত্ত্বকে নস্যাৎ করার জন্য যথেষ্ট হত।  সৃষ্টিবাদীদের জন্য দুর্ভাগ্য এখনও তেমন কোন ফসিল পাওয়া যায়নি।


শুধু খরগোশ নয়, বিবর্তনের ধারাটি সকল জীবের জন্যই একইভাবে প্রযোজ্য। যেমন বিবর্তন তাত্ত্বিকদের মতে বিবর্তনের ধারায় মানুষ যেহেতু এসেছে অনেক পরে (সিনোযোয়িক যুগের আগে নয়), তাই তার আগে, যেমন ডায়নোসরের ফসিলের সাথে একই বয়সী কোন মানুষের ফসিল পাওয়া যাওয়ার কথা নয়। সবচেয়ে পুরোনো খাড়া হয়ে হাটা মানুষের ফসিল ইথিওপিয়ায় পাওয়া গেছে যা ৪০ লক্ষ বছরের পুরোনো। আর ডায়নোসারেরা প্রবল প্রতাপে এ পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে সেই জুরাসিক যুগে (১৪ কোটি থেকে ২০ কোটি বছর আগে)। ডায়নোসরের বিলুপ্তি ঘটে ক্রেটাসিয়াস যুগে (এখন থেকে সাড়ে ছ কোটি বছর আগে)। সৃষ্টিবাদীরা মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি করে ডায়নোসারের আমলে ‘মানুষের ফসিল’ পাওয়ার চেষ্টা করলেও সেগুলো একটিও ধোপে টিকেনি। তাই প্রফেসর রিচার্ড ডকিন্স বলেছেন :

And far telling – not a single authentic fossil has ever been found in the “wrong” place in the evolutionary sequence. Such an anachronistic fossil, if one were ever unearthed, would blow evolution out of the water.

শুধু তো ফসিল নয়, জীববিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, আনবিক জীববিদ্যার কোন শাখাই বিবর্তনের কোন সাক্ষ্যের বিরোধিতা তো করছেই না, বরং যত দিন যাচ্ছে বিবর্তনের ধারাটি সবার কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে; বিবর্তনতত্ত্ব দিন দিন হয়ে উঠছে এক কথায় অপ্রতিরোধ্য।

সত্যই কি অর্ধবিকশিত বা অসম্পূর্ণ অংগ প্রকৃতিতে নেই?

কিশোর বলেছেন –

এ তত্ত্ব অনুযায়ী জীব জগতে অনাদিকাল থেকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও অভিযোজন ঘটে চলেছে ও অনির্দিষ্টকাল ধরে তা চলবে। তার অর্থ বর্তমানেও তা চলছে। তা যদি হয় তা হলে বর্তমানে বহু প্রজাতির প্রানী পাওয়া যাবে যারা অর্ধ বিকশিত বা কিছু কিছু অঙ্গ অর্ধবিকশিত বা বিকাশমান পর্যায়ে আছে । দুর্ভাগ্য বশত: প্রকৃতি জগতে এমন কোন অর্ধ বিকশিত জীব দেখা যায় না । যাদের দেখা যায় তারা প্রত্যেকেই স্বয়ং সম্পুর্ন এবং পূর্ন বিকশিত। কোন জীবেরই অর্ধবিকশিত বা ত্র“টি পূর্ন কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখা যায় না ।

কিন্তু তার ধারনা সত্যই ভ্রান্ত। যেমন, চোখের কথাই ধরি। আমরা এখনও আমাদের চারপাশে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত বিভিন্ন ধাপের চোখের অস্তিত্ব দেখতে পাই, অনেক আদিম প্রাণীর মধ্যে এখনও বিভিন্ন রকমের এবং স্তরের আদি-চোখের অস্তিত্ব দেখা যায়। কিছু এককোষী জীবে একটা আলোক-সংবেদনশীল জায়গা আছে যা দিয়ে সে আলোর দিক সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা করতে পারে, আবার কিছু কৃমির মধ্যে এই আলোক-সংবেদনশীল কোষগুলি একটি ছোট অবতল কাপের মধ্যে বসানো থাকে যা দিয়ে সে আরেকটু ভালোভাবে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। সমতলের উপর বসানো নামমাত্র আলোক সংবেদনশীলতা থেকে শুরু করে পিনহোল ক্যামেরার মত মেরুদন্ডী প্রাণীদের অত্যন্ত উন্নত চোখ পর্যন্ত সব ধাপের চোখই দেখা যায় আমাদের চারপাশে, এবং তা দিয়েই বিবর্তন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আসলে বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী, জীবের কোন অংশকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিকোন থেকে সুবিধাজনক অবস্হানে আসার জন্য পুর্ণাংগভাবে বিকাশিত হতে হয় না। অন্ধ হওয়ার থেকে আংশিক দৃষ্টিশক্তি থাকা অনেক ভালো। আমাদের মধ্যে অনেকেরই দৃষ্টিক্ষীণতার  বা দুরের বা কাছের দৃষ্টিহীনতার সমস্যা আছে, তার ফলে আমরা দুরে বা কাছে অস্পষ্ট দেখি। কিন্তু আমরা যদি আদিম কালের মত বন্য জীবন যাপন করতাম এই সীমাবদ্ধতাসহ চোখই আমাদেরকে অনেকখানি সুবিধা এনে দিতে পারতো। আমরা খাওয়া, আশ্রয়, সঙ্গী বা শিকারী পশুদের দেখতে পেতাম, তাদের নড়াচড়া বুঝতে পারতাম। যে বনে বাঘ নেই সে বনে যেমন শিয়াল রাজা – তেমনি যে জায়গায় সবাই কানা – সেখানে একচোখা রাতকানা বর্ণান্ধরাও রাজা হয়ে বাড়তি সুবিধা ভোগ করবে। কাজেই যে জনসমষ্টির মধ্যে কোন দৃষ্টিশক্তিই নেই বা খুবই সীমিত দৃষ্টিশক্তি আছে তাদের জন্য চোখের উদ্ভব বা চোখের মত যে কোন অঙ্গের বিন্দুমাত্র উন্নতিই অনেক বাড়তি সুবিধা এনে দেবে। একেবারেই দর্শনশক্তি না থাকা মানে হচ্ছে সে পুরোপুরিই অন্ধ, এখন প্রাণীটির মধ্যে যদি অর্ধেক বা সিকিভাগ দৃষ্টিক্ষমতাও বিকাশ লাভ করে তাহলেই সে কিছু হলেও তার শিকারীর গতিবিধি দেখতে পাবে বা বুঝতে পারবে। চোখের এইটুকু আংশিক বিকাশই প্রাণীটির বেঁচে থাকা বা না থাকার মধ্যে বিশাল একটি ভুমিকা রাখতে পারে। একই যুক্তি খাটে পাখার ক্ষেত্রেও, আমরা চারপাশে আংশিক পাখাসহ প্রচুর প্রাণী দেখতে পাই। টিকটিকি, ব্যাঙ, শামুক জাতীয় গ্লাইড করে চলে এমন অনেক প্রাণীর মধ্যেও আংশিক পাখার মত অংশ দেখতে পাওয়া যায়। গাছে থাকে এমন অনেক প্রাণীর দুই জয়েন্টের মাঝখানে পাখার মত একধরনের চামড়ার অস্তিত্ব দেখা যায় যেটা আংশিকভাবে বিকশিত পাখা বৈ আর কিছু নয়। পাখাটি কত ছোট বা বড় তা এখানে ব্যাপার নয়, প্রাণীটি যদি কখনও গাছ থেকে পড়ে যায় তাহলে ওইটুকু পাখা ব্যবহার করেই সে তার জীবন বাঁচাতে পারবে যা কিনা তাকে টিকে থাকতে বাড়তি সুবিধা জোগাবে। টক অরিজিনের’ দুটি লিঙ্কে ( | ) এই অভিযোগের কিছু ভাল ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।

জিরাফের গলা লম্বা হইলে আমারটা হইলো না কেন?

সেইটাই তো কথা।  জিরাফের গলাটা এত লম্বা হইলো, আমারটা কি দোষ করল? পাখির এত সুন্দর ডানা আছে, আমার পিঠে গজাইলো না ক্যান? কুত্তা এত দূর থেইকা গন্ধ শুইকা খাবার খুঁইজা পায়, ঈগল এত উপ্রে থেইকাও দেখতে পায় কোন জায়গায় খাবার আছে- আর আমার চোখের সামনে খাবার থাকলেও আমি টের পাইনা ক্যান? কন তো!

যাদের বিবর্তন নিয়ে খুব বেশি গভীর ধারনা নেই, যারা ডারউইনের বিবর্তনের সাথে ল্যামার্কিজমের পার্থক্য বঝেন না – তারা এ ধরনের প্রশ্ন অহরহ করেন।  কিশোরও করেছেন। তিনি বলেছেন –

প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব অনুযায়ী, কোটি কোটি বছর আগেকার হরিণ জাতিয় প্রানীরা খাদ্যেও অভাবে পড়ে উচু ডাল থেকে পাতা খেতে গিয়ে গলা লম্বা হয়ে তারা জিরাফে পরিনত হয়েছে (যদিও অন্য হাজারো রকম প্রানী একই সমস্যায় পড়া সত্ত্বেও তাদের গলা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে)… কোটি বছর ব্যপি ক্রমাগত প্রচেষ্টার পর হরিনদের গলা লম্বা হতেই পারে, …

এটা একটা খুবই ভুল ধারণা। ভদ্রলোক এখানে ল্যামার্কবাদের সাথে ডারউইনীয় বিবর্তনকে গুলিয়েছেন।  ডারউইনের সময় পর্যন্ত বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক কিভাবে কাজ করে কিংবা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চালিত হয় তা সম্পের্ক বিজ্ঞানীদের কোন স্পষ্ট ধারণাই ছিলো না। ল্যামার্ক (১৭৪৪- ১৮২৯) নামের এক বিজ্ঞানী তত্ত্ব দেন যে, অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো স্রেফ পরিবেশের ফল। জীবের যে অংগগুলো তার জীবনে বেশি ব্যবহূত হয় সেগুলো আরও উন্নত হতে থাকে, আর যেগুলোর বেশী ব্যবহার হয় না সেগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয় বা বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়। তার মধ্যে একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় উদাহরণ হচ্ছে জিরাফের গলা লম্বা হয়ে যাওয়ার কেচ্ছা কাহিনী। জিরাফের গলা লম্বা হওয়ার ল্যামার্কীয় ব্যাখ্যা হল – ‘লম্বা লম্বা গাছের ডগা থেকে কঁচি পাতা পেরে খাওয়ার জন্য কসরত করতে করতে বহু প্রজন্মের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে জিরাফের গলা লম্বা হয়ে গিয়েছে’। অর্থাৎ, ল্যামার্কের তত্ত্বের মূল কথা ছিল – অভিযোজনের কারণ হল পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রভাবে দেহের অংগসমূহের পরিবর্তন ঘটা। ল্যামার্ক আরও বললেন যে, একটি জীব তার জীবদ্দশায় ব্যবহার বা অব্যবহারের ফলে যে বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করে সেগুলো তার পরবর্তী প্রজন্মে বংশগতভাবে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু এটা কি ঠিক ব্যাখ্যা হল? কিন্তু ডারউইন এটা ঠিকই বুঝে ছিলেন যে, কোন অঙ্গের ব্যবহারের উপর নির্ভর করে জীবের বিবর্তন ঘটে না, প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করার জন্য শুধুমাত্র বংশগতভাবে যে বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মে দেখা যায় তারাই দায়ী। যে বৈশিষ্ট্যগুলো আপনি আপনার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আপানার দেহে পান নি, তার উপর বিবর্তন কাজ করতে পারে না। সেজন্যই মানুষ যতই চেষ্টা করুক কিংবা হাজার কসরত করুক তার পীঠের হাড্ডী পরিবর্তিত হয়ে পাখায় রূপান্তরিত হয়ে যায় না। আমার পায়ে জুতা পড়তে পড়তে ঠোসা গজালে, আমার বাচ্চার পায়েও ঠোসা গজায় না।  আসলে ল্যামার্কীয় ব্যাখ্যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে উনিশ শতকের সেষ ভাগেই ভাইজম্যানের  পরীক্ষায়। জার্মান জীববিদ আগস্ট ভাইজমান একবার জন্মের সাথে সাথে সাদা রঙের ছোট জাতের ইদুর ছানার লেজ কেটে দিয়ে বাইশটি প্রজন্মে সদ্য-ভূমিষ্ট ছানার লেজের দৈর্ঘ্য কমে কিনা তা মেপে দেখলেন। দেখা দেল, সদ্যভূমিষ্ট ছানার লেজের দৈর্ঘ্য কমেনি বা বাড়েনি। এ পরীক্ষা থেকে ভাইজমান পরিস্কারভাবে দেখালেন, জীবদেহে পরিবেশ দ্বারা উৎপন্ন প্রভাব বংশানুসৃত হয় না। এভাবে তিনি ল্যামার্কবাদের মূল-ভিত্তিটি ধ্বসিয়ে দেন। ভাইজম্যানের পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন বিজ্ঞানী বস এবং শেফার্ডসও। তারাও যথাক্রমে ইদুর এবং কুকুরের কান কেটে কেটে পরীক্ষাটি চালিয়েছিলেন। তারাও একই রকম ফলাফল পেয়েছিলেন। এরকম পরীক্ষা কিন্তু মানুষ বহুকাল ধরেই করে এসেছে। যেমন, ডোবারম্যান কুকুরের লেজ কেটে ফেলা, ইহুদী এবং মুসলমান বালকদের খৎনা করা, চীনদেশে একসময় প্রচলিত প্রথা অনু্যায়ী মেয়েদের পা ছোট রাখার জন্য লোহার জুতো পড়ানো, অনেক আফ্রিকান দেশে মেয়েদের ভগাঙ্গুর কেটে ফেলা, উপমহাদেশে মেয়েদের নাকে এবং কানে ছিদ্র করা ইত্যাদি। কিন্তু এর ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আকাংকিত লক্ষণটির আবির্ভাব হয় নি। ল্যামার্কের তত্ত্ব সঠিক হলে তাই ঘটার কথা ছিলো।  আসলে বিবর্তন হয় ডারউইন বর্ণিত প্রক্রিয়ায়, ল্যামার্ক যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেভাবে কখনোই নয়। 

না, উচু ডাল থেকে পাতা খেতে গিয়ে গলা লম্বা হয়ে যায়নি, কিংবা কোটি বছর ব্যপি ক্রমাগত প্রচেষ্টার পর হরিনদের গলা লম্বা হয়ে জিরাফ হয়নি;  বরং লম্বাগলার জেনেটিক ট্রেইট হয়ত আদি জিরাফ সদৃশ  জনপুঞ্জে ছিলোই। পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে বা অন্য কোন কারনে এই লম্বাগলার ট্রেইটওয়ালারা হয়ত কোন বাড়তি সুবিধা পেয়েছে (যেমন খাদ্যাভাবের সময় ঊঁচু গাছের লতাপাতার নাগাল পাওয়া), এবং তারা অধিক হারে বংশবৃদ্ধি করে লম্বা গলার বৈশিষ্টকে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত করে টিকিয়ে রেখেছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন, চাহিদা, ক্রমাগত প্রচেষ্টা এবং অর্জিত বৈশিষ্ট্যের কোন মূল্য নেই।  বিবর্তন কোন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা পরিকল্পণা নিয়ে কাজ করে না, কাজ করে অনেকটা ‘ব্লাইন্ড ওয়াচমেকারের’ মত।

সাগর বা হ্রদের পানির নীচের মাছগুলো অত অপরূপ রঙীন হতে গেল কেন?

কিশোর বলেছেন-

একুইরিয়ামে যে সব মন পাগল করা রঙীন মাছ আমরা দেখি, ওসব মাছের মন মাতাল করা রঙের এত দরকার পড়ল কেন? কোন কাজে ওদের অত রঙ লাগে? বরং ওদের অত রঙীন বর্নচ্ছটাকে তো একটা মরন ফাদ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কারন ওদের রং দেখে অপেক্ষাকৃত বড় রাক্ষুসী মাছগুলো সহজেই ওদের সনাক্ত করে শিকার করতে পারে।অন্য রাক্ষুসী মাছের জন্য ছোট মাছগুলো কিভাবে বা কেনই রঙীন হবে যা নাকি তাদের জন্য আত্মঘাতী?

আগেই বলেছি বিবর্তন কোন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা পরিকল্পণা নিয়ে কাজ করে না, কাজ করে অনেকটা ‘ব্লাইন্ড ওয়াচমেকারের’ মত। কাজেই কোন কিছুর ‘জন্য’ বা কোন ‘উদ্দেশ্য’ সামনে রেখে মাছেদের এমন মন মাতাল করা রং হয়নি। এভাবে ভাবাটাই আসলে ভুল। সঠিক প্রশ্নটি হবে – মাছের গায়ের রঙ কি তাদের তাদের টিকে থাকার পেছনে কোন বাড়তি উপযোগিতা দিয়েছিলো? এটা একটা ভাল প্রশ্ন। এর উত্তর হচ্ছে, বিবর্তনের সবকিছুই যে অভিযোজন কিংবা ‘বাড়তি উপযোগিতা’ নির্ভর তা কিন্তু নয়। বহু কিছু উদ্ভুত হয়েছে অন্য অনেক কিছুর অভিযোজনের ‘বাই-প্রোডাক্ট’ হিসবে, কিংবা ‘র‌্যাণ্ডম ড্রিফটের’ ফসল হিসেবে। যেমন, আমাদের হাড়ের যে সাদা রঙ এটাকে অভিযোজন বা এডাপ্টেশন দিয়ে ব্যাখ্যা করলে চলবে না। কারণ অভিযোজনের দিক দিয়ে হাড়ের সাদা রঙ এর কোন বাড়তি মূল্য নেই।  আমাদের হাড় যে ক্যালসিয়াম দিয়ে তৈরি তার ফলশ্রুতিতে ‘বাই প্রোডাক্ট’ হিসেবে এই সাদা রঙ তৈরি হয়েছে। আমাদের মানুষদের গায়ের রঙও কিন্তু ভিন্ন হয়। চুলের রঙ কারো সাদা, কারো কালো, কারো বা বাদামি। চোখের মনি কারো নীল, কারও কটা, কারো বা সবুজ।  হয়ত এগুলো কোনটারই অভিযোজিত সুবিধার জন্য হয়নি। হয়েছে অন্য কোন কারণের উপজাত হিসেবে। মানুষের সাদা হাড্ডি কিংবা চোখের মনির বিভিন্ন রঙের মত  মাছের রংও বাইপ্রোডাক্ট হিসবে তৈরি হতে পারে, অসম্ভব তো কিছু নয়।

এখন কথা হচ্ছে, এই রঙবেরঙের ব্যাপারটা তো মাছেদের ক্ষেত্রে হুমকি হবার কথা। শিকারী মাছদের চোখে পরে যাওয়ার কথা তাই না?  কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো হয়ই। কিন্তু তারপরও কেন রঙ বেরঙ্গের মাছগুলো টিকে থাকল এর ভাল ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীদের কাছে আছে। যেমন, উগান্ডা কেনিয়া এবং তাঞ্জানিয়ার চারিদিকে পরিবেষ্টিত ভিক্টরিয়ান হ্রদে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন- লাল কমলা ইত্যাদি গাঢ় রঙের মাছগুলো মুলত থাকে হ্রদের নিচের দিকে কারণ লাল রঙের আলো নীলচে আলোর চেয়ে হ্রদের অনেক বেশি গভীরে যায়। সাদা সবুজ আর হাল্কা রঙের মাছগুলো থাকে পানির উপর দিকে। এভাবেই রঙের তারতম্য এবং পানির গভীরতাকে কাজে লাগিয়ে তারা শিকারীদের চোখ এড়িয়ে টিকে থাকে। ভিক্টরিয়ান হ্রদে তো রঙের এই তারতম্যকে পুঁজি করে  পৃথক প্রজাতিই তৈরি করে ফেলেছে মাছেরা।

ছবিঃ ক্লাউন মাছ আর এনিমোনের সহবিবর্তন

আরেকটি ব্যাপার কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। অনেক মাছই কিন্তু গায়ের রঙ এর সাথে মিলিয়ে সামুদ্রিক গাছ-পালা আর পরিবেশ বাছাই করে সহ-বিবর্তন বা ‘কো-ইভলুশন’ গড়ে তুলে নিজেদের টিকিয়ে রাখে। এমনি একটি চমকার উদাহরণ হচ্ছে ‘কালারফুল  ক্লাউন’ মাছের সাথে এনিমোনের সহবিবর্তন।   এ ধরনের মাছ তার গাঢ় রঙের কারণে সহজেই অন্যের শিকারে পরিণত হতে পারে, আত্মরক্ষার জন্য গাঢ় রঙের সামুদ্রিক এনিমোনের শুঁড়ের ভিতর প্রায়শঃই আত্মগোপন করে। এভাবে ক্লাউন মাছগুলো শিকারী মাছের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়। আবার অন্যদিকে এনিমোনগুলোও ক্লাউন মাছের কারণে উপকৃত হয়। কারণ ক্লাউন মাছগুলো এনিমোনভোগী ছোট মাছকে তাড়িয়ে দেয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এই ক্লাউন মাছগুলো গায়ের রঙকে কাজে লাগিয়েই সহবিবর্তনের মাধ্যমে শিকারি মাছদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলেছে।

 

বিবর্তন মানে কি কেবল মারামারি-কাটাকাটি?

কিশোর মনে হয় নাই মনে করেন। শুধু কিশোর নয়, অনেকেই বিবর্তনের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। তারা মনে করেন বিবর্তন মানে হচ্ছে কেবলই একজনকে দাবড়িইয়ে আরেকজনের বেঁচে থাকা।  কিশোর বলেছেন –

বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যদি সঠিক হয় তাহলে প্রকৃতি রাজ্যে সর্বত্র চরম বিশৃংখলা বিরাজমান থাকবে। কারন প্রতিটি জীব জন্তু তাদের অস্তিত্বের জন্য পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত থাকবে যার ফলে প্রকৃতি রাজ্যে সব সময় বিশৃংখল অবস্থা বিরাজ করবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন।

আসলে কিন্তু তা মোটেই নয়। প্রকৃতি জগতে প্রতিযোগিতা আছে, ভালমতই আছে। কিন্তু একে স্রেফ মারামারি কাটাকাটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা বালখিল্যই।  প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার নিয়ে প্রজাতিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে আমাদের চারপাশে একটু চোখ মেলে তাকালেই।  আমাদের চারপাশের উদ্ভিদ এবং প্রাণীরা যে পরিমাণে বংশবৃদ্ধি করে তার বেশীরভাগই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। বন্যা কিছু চমকার উদাহরণ হাজির করেছেন তার ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইটিতে। সেখান থেকে কিছু উদাহরণ হাজির করি। একটা পুরোপুরি বড় হওয়া কড মাছ বছরে প্রায় ২০ থেকে ৫০ লাখ ডিম পাড়ে, একটি মেপল বা আম বা জাম গাছে হাজার হাজার ফুল এবং ফল ধরে, কিন্তু এর বেশীরভাগই পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করে, আমাদের দেশের ইলিশ মাছের কথাই চিন্তা করে দেখুন না। সমুদ্র থেকে নদীগুলোতে এসে তারা কি হারে ডিম পারে আর তাদের মধ্যে ক’টাই বা শেষ পর্যন্ত পুর্ণাঙ্গ মাছে পরিণত হয়ে টিকে থাকতে পারে! বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে একটা কড মাছের ডিমের ৯৯% ই প্রথম মাসেই কোন না কোন ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, বাকি যা বেঁচে থাকে তার প্রায় ৯০% জীবনের প্রথম বছরেই কোন না কোনভাবে মৃত্যুবরণ করে। ডারউইনও তার বইয়ে এই একই জিনিস দেখিয়েছেন হাতীর বংশবৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় হাতীর বংশবৃদ্ধির হার তুলনামুলকভাবে খুবই কম, কিন্তু তারপরও একটা হাতী তার জীবনে যে ক’টা বাচ্চার জন্ম দেয় তার মধ্যেও সবগুলি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে না। ডারউইন হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, হাতী অন্য সব প্রাণীর তুলনায় সবচেয়ে কম বংশবৃদ্ধি করেও তার ৯০-১০০ বছরের জীবনে প্রায় ৬ টি বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। অর্থা যদি সবগুলো বাচ্চা বেঁচে থাকে তাহলে এক জোড়া হাতী থেকে ৭০০-৭৫০ বছরে প্রায় ১৯০ লক্ষ হাতীর জন্ম হবে । প্রকৃতিতে প্রায় সব জীবই এরকম বাড়তি শিশুর জন্ম দিয়ে থাকে, একটা ব্যকটেরিয়া প্রতি ২০ মিনিটে বিভক্ত হয়ে দুটো ব্যকটেরিয়ায় পরিণত হয়, হিসেব করে দেখা গেছে যে এরা সবাই বেঁচে থাকলে এক বছরে তারা বংশ বৃদ্ধি করে সারা পৃথিবী আড়াই ফুট উচু করে ঢেকে দিতে পারতো। একটা ঝিনুক কিংবা কাছিম একবারে লাখ লাখ ডিম ছাড়ে, একটা অর্কিড প্রায় ১০ লাখ বীজ তৈরী করতে পারে।  কিশোর সাহেব তার প্রবন্ধে মানুষের উদাহরণ হাজির করেছেন।  মানুষের ব্যাপারটা খানিকটা ব্যতিক্রম।  কারণ চিকিসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষ প্রকৃতির উপর ছড়ি ঘুরাতে শুরু করেছে। চিকিসাবিজ্ঞানের এতখানি উন্নতি ঘটার আগে অর্থাৎ মাত্র একদেড়শো বছর আগেও শিশু মৃত্যর হার ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক বেশী। আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে, কৃত্রিমভাবে আমরা এখন একদিকে জন্ম নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছি, অন্যদিকে শিশু আধুনিক চিকিসার কল্যানে মৃত্যুর হারও কমিয়ে আনতে পেরেছি।  তারপরো সীমিত সম্পদের উপর প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা কারো অগোচরে থাকে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এভাবেই সব জীব যদি বংশবৃদ্ধি করতে থাকতো, অর্থাএকেকটা জীব তার সারা জীবনে যতগুলো ডিম বা বাচ্চার জন্ম দিতে সক্ষম তার সব গুলো যদি টিকে থাকতো তাহলে এতদিনে পৃথিবীতে আর কারোরই থাকার ঠাঁই হতো না। আসলে খেয়াল করলে দেখা যায় যে, প্রকৃতিতে ঠিক এর উলটোটা ঘটছে – সংখ্যার দিক থেকে যত উদ্ভিদ বা প্রাণীর জন্ম হয় বা বেঁচে থাকে, তার তুলনায় তাদের বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা বহু গুণ বেশী। শেষ পর্যন্ত এর মধ্যের ছোটটো একটা অংশই শুধু বড় হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। যে কোন প্রজাতি হঠা করে অনেক বেশী হারে বংশবৃদ্ধি করে ফেলতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বিস্তৃতি প্রাকৃতিক নিয়মেই বন্ধ হতে হবে। কারণ, তাদের সবার বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমান খাদ্যের বা অন্যান্য সম্পদের প্রয়োজন তা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডারউইন ভাবলেন, তাহলে প্রকৃতিতে প্রাণের এই বিশাল অপচয় এবং বাড়তি বংশবৃদ্ধির ব্যাপারটার অবশ্যই কোন ব্যাখ্যা থাকতে হবে!  ডারউইন প্রথমবারের মত বিবর্তন তত্ত্বের সাহায্যে এর একটি ব্যাখ্যা দেন।  তিনি পর্যবেক্ষণ থেকে সঠিকভাবেই সিদ্ধান্তে আসেন যে, প্রকৃতিতে সবসময় খাদ্য, বেঁচে থাকা, জায়গা, সঙ্গী নির্ধারণ, আশ্রয়, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে একধরনের নিরন্তর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে।  তিনি এর নাম দেন জীবন সংগ্রাম (struggle for survival)। এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলতে থাকে একই ধরনের প্রজাতির ভিতরের প্রতিটি জীবের মধ্যে এবং এক প্রজাতির সাথে আরেক প্রজাতির মধ্যে। আবার প্রতিটি জীবের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বা প্রকারণের কারণে এই অনন্ত প্রাকৃতিক সংগ্রামে কেউ বা সহজেই খাপ খাইয়ে নিয়ে বেশীদিন টিকে থাকতে সক্ষম হয়, আর অন্যরা আগেই শেষ হয়ে যায়। অর্থা প্রতিটি জীবের মধ্যে প্রকৃতি তুলনামুলকভাবে বেশী উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের টিকিয়ে রাখে। সোজা কথায়, একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে সংগ্রাম করে যারা টিকে থাকতে সক্ষম হয়, তারাই শুধু পরবর্তী প্রজন্মে বংশধর রেখে যেতে পারে, এবং তার ফলে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোরই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অনেক বেশী প্রকটভাবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থা, যে প্রকারণগুলো তাদের পরিবেশের সাথে অপেক্ষাকৃত বেশি অভিযোজনের ক্ষমতা রাখে, তাদের বাহক জীবরাই বেশীদিন টিকে থাকে এবং বেশী পরিমানে বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এভাবে প্রকৃতি প্রতিটা জীবের মধ্যে পরিবেশগতভাবে অনুকুল বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের নির্বাচন করতে থাকে এবং ডারউইন প্রকৃতির এই বিশেষ নির্বাচন প্রক্রিয়ারই নাম দেন প্রাকৃতিক নির্বাচন। ব্যাপারটা বোঝা কি খুব কঠিন?   আসলে  বিবর্তনবাদ তত্ত্ব সঠিক  বলেই আমরা  সর্বত্র চরম বিশৃংখলার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছি, এর উলোটি নয়।

আর তাছাড়া প্রকৃতির এই প্রতিযোগিতাকে এত খারাপ চোখে দেখারও কিছু নেই।  প্রতিযগিতামূলক জীবন সংগ্রাম থেকেই তৈরি হয় বিভিন্ন ধরণের  পারষ্পরিক সহযোগিতা, মিথোজীবীতা কিংবা সহ-বিবর্তন।  শিকারী মাছদের থেকে বাঁচার জন্য ক্লাউন মাছদের সাথে এনিমোনের সহবিবর্তনের কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি।  আমাদের দেহেও বাস করে অনেক উপকারী ব্যাক্টেরিয়া।  আমাদের দেহে বাস করার ফলে আমরা যেমন এদের দিয়ে উপকৃত হচ্ছি, তেমনি সেই ব্যাকটেরিয়াগুলোঅ উপযূক্ত পোষক দেহ পেয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছে।   ডারউইন নিজেও সহবিবর্তনের অনেক উদাহরণ হাজির করেছিলেন, নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি লন্ডনের এক গ্রীন হাউসে মাদাগাস্কারের বিশেষ একটা অর্কিড দেখেন যার মধু রাখার পুষ্পাধারটি ১১ ইঞ্চি লম্বা । তিনি তা দেখে মন্তব্য করেন যে, মাদাগাস্কারের যে জায়গায় এই অর্কিডটা দেখা যায়, সেখানে এমন এক ধরনের মথ জাতীয় কোন পোকা থাকতেই হবে যাদের সুর বা হুল হবে একই রকমের লম্বা। কারণ এই লম্বা মধুর পুষ্পাধারের ভিতর শুর ঢুকিয়ে মধু খাওয়ার সময়ই মথগুলো অর্কিডটার পরগায়ন ঘটাবে। এবং তাইই হলো – কয়েক দশক পরে বিজ্ঞানীরা ঠিকই খুঁজে পেলেন সেই মাদাগাস্কার স্ফিংস মথ Xanthopan morganii praedicta আসলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা নিরন্তর প্রতিযোগিতার কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাবার ফলে নিজেদের টিকিয়ে রাখতেই বিভিন্ন প্রাণি এবং উদ্ভিদ অনেক সময়ই নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সহযগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ ধরোনের উদাহরণ আছে বহু।  হামিং বার্ডের সাথে  অর্নিথোপথিলাস ফুলের সহবিবর্তন, এংরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মথের সহবিবর্তন এগুলওর প্রত্যক্ষ উদাহরণ। কোন সেবমূলক কাজে উসাহিত হয়ে নয় কিংবা উপকারি মনোভাবের বহিঃপ্রকাশের ফলে নয়, বরং কঠিণ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রয়োজনেই মূলতঃ তারা পারস্পরিক সহযোগিতায় যেতে তারা বাধ্য হয়। আসলে প্রকৃতিতে এমন কোন জীব নেই যে শুধু নিঃস্বার্থভাবে অন্য প্রজাতির সেবা করার জন্য বেঁচে থাকে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মেই সে বিলুপ্ত হয়ে যেতে বাধ্য। ডারউইন তার ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’ বইতে তার পাঠকদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ ধরণের একটা প্রজাতি খুঁজে বের করার জন্য, এবং আজ পর্যন্ত কেউ সে চ্যালেঞ্জের উত্তর দিতে পারেনি।

আমি লেখাটি শেষ করার আগে আরো একবার কিশোর সাহেবকে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাকে এই ফলপ্রসু আলোচনার সুযোগ করে দেবার জন্য। মুক্তমনা অবশ্যই গঠণমূলক সমালোচনকে সবসময় স্বাগত জানায়। তবে শুধু সমালোচনা করার জন্য সমালোচনা করলে ক্ষেত্রবিশেষে বিষয়বস্তুর গুরুত্ব হ্রাস পায়।  অনেককেই দেখেছি বিবর্তন সম্পর্কে সঠিক পড়াশোনা আর জানাশনার না করে বিভিন্ন ক্রিয়েশনিস্ট সাইট থেকে পাওয়া চটকদার অর্ধসত্য বা মিথ্যাকেই সত্য বলে মনে করেন এবং বড় বড় প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। লিখতে চান ভাল কথা, লেখালিখির উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয় – তবে তারা যদি বিবর্তনের উপর লিখতে শুরু করার আগে বিবর্তনের উপর কিছু অথেন্টিক কিছু বই পড়ে নিতেন তাহলে আমাদের অনেক উপকার হত। আমি এর আগে এক বিবর্তনবাদে সংশয়ীর প্রত্যুত্তরনামের লেখাটিতে নেক প্রশ্ন আর সংশয়েরই জবাব দিয়েছিলাম। কিন্তু একই বিষয়গুলো প্রোপাগান্ডার মত করে বারবারই ঘুরে ফিরে আসে। সঙ্গত কারনেই এ লেখাটিতে আমার আগের দেয়া উত্তরের অনেক পুনরুক্তি করতে হয়েছে। ধরণের জানা বিষয়গুলোর লাইন বাই লাইন রিফিউট করাটা শুধু সময়ের অপচয়ই নয়, বিরক্তিকরও বটে।  ডঃ ইরতিশাদ আহমেদও আমাদের এবারের ডারউইন দিবসে পাওয়া প্রবন্ধ – ‘বিবর্তনতত্ত্ব – “আমরা বান্দর থাইকা আইছি এবং আরো কিছু ভুল ধারণা’ প্রবন্ধটিতে এ ধরনের বেশ কিছু প্রচলিত ভুল ধারনার খন্ডন করেছেন। আমি নীচে কিছু বই এবং সাইটের নাম উল্লেখ করলাম, যাতে ভবিষ্যতে একই ধরণের অবাঞ্ছিত বিতর্ক এড়ান যায়।

রেফারেন্সঃ

Index to Creationist Claims, Talk Origin.

29+ Evidences for Macroevolution, talk Origin

বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণাগুল, বন্যা আহমেদ

এক বিবর্তনবাদে সংশয়ীর প্রত্যুত্তরে, অভিজিৎ রায়

বিবর্তনের পথ ধরে, বন্যা আহমেদ; ফেব্রুয়ারি ২০০৭; অবসর

বিবর্তনবিদ্যা, ড. ম আখতারুজ্জামান, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৮।

Only a Theory: Evolution and the Battle for America’s Soul, Viking Adult 2008

The Ancestor’s Tale: A Pilgrimage to the Dawn of Evolution, Richard Dawkins, Mariner Books, 2005

Evolution, Mark Ridley, Wiley-Blackwell, 2003

Evolution, Douglas J. Futuyma, Sinauer Associates, 2005

The Blind Watchmaker: Why the Evidence of Evolution Reveals a Universe Without Design, W. W. Norton, 1996

The Science of Evolution and the Myth of Creationism: Knowing What’s Real and Why It Matters, Ardea Skybreak, Insight Press; illustrated edition edition, 2006

ডারউইন দিবস ২০০৯