ডারউইন দিবস এবং

নন্দিনী হোসেন

১২ই ফেব্রুয়ারী চার্লস ডারউইন এর দুইশততম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হতে যাচ্ছে সারা পৃথীবি জুড়ে । ১২ ফেব্রুয়ারী ১৮০৯ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহন করেন চার্লস রবার্ট ডারউইন । যার পিতামহ Erasmus Darwin ছিলেন তৎকালীন ইংল্যান্ডের অর্থাৎ আটারোশ শতাব্দীর অন্যতম একজন নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবি । গড অথবা ঈশ্বর ভাবনার বাইরে ক্ষুদ্র হলেও একটি ধারা সেই Ancient World থেকেই আমাদের এই পৃথীবি, বা জীবন ও জগত নিয়ে নানাভাবে চিন্তাভাবনা করে আসছিলন । ডারুইন এর বিবর্তন তত্ত্ব নিয়েও তার সমসাময়িক এবং কিছুটা আগে থেকেই কেউ কেউ কাজ করছিলেন । এমনকি ডারুইন এর পিতামহ, Erasmas DarwinEvolution এর ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিলেন বলে জানা যায় । পরে এই থিওরী দিন দিন আরও পরিণতি লাভ করে – বিশেষ করে Advance of geology এর কারণে যখন থেকে বিরাট সংখ্যক ফসিল আবিষ্কৃত হতে লাগল পৃথিবীর নানা প্রান্তে । আবার এটাও দেখা গেলো যে কোন কোন বিশেষ ফসিল আবার কিছু বিশেষ বিশেষ জায়গায় ছড়িয়ে আছে । তা ছাড়া ব্যাপক Geological exploration এর ফলে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণ করা ও সম্ভব হলো, যা বাইবেলীয় ধারণার সাথে একেবারেই যায়না । তৎকালীন অধিকাংশ উইরোপবাসী যেখানে মগ্ন ছিলো বাইবেলে বর্ণিত সাত দিনে পৃথিবী ‘গড’ কতৃক সৃষ্টি হওয়ার গালগল্পে – সেখানে ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ডারউইনের গ্রন্থ Origin of Species প্রকাশিত হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই চারিদিক থেকে ধর্ম গেলো, ধর্ম গেলো রব উঠে । তাকে নানাভাবে আক্রমন করা হয় । বিশেষ করে চার্চতন্ত্র তার বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠে প্রবলভাবে । যে গ্রন্থে তিনি ‘গড’ কর্তৃক সৃষ্ট সৃষ্টির সেরা জীব ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ এর ধারণা ভেঙ্গেই শুধু দেননি, homo sapiens যে আসলে apes এরই বিবর্তীত রূপমাত্র তাও প্রকাশ করেছেন । মোটকথা, Natural Selection এর মাধ্যমে কি করে বিবর্তিত হচ্ছে ‘গড’ এর তথাকথিত ‘সৃষ্টি জগত’ তারই বর্ণনা আমরা পাই ‘On the Origin of Species by Means of Natural Selection’ গ্রন্থে। বোঝা গেলো এখানে ‘গড’ এর আসলে কোন কেরামতি নেই । মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ট বানানোর গরজ ‘গড’ এর থাকলেও নেচারের সে গরজ নেই বলাই বাহুল্য । বিষয়টা হজম করা আসলেই শক্ত ছিলো – তখনকার চার্চকেন্দ্রিক মোল্লাদের জন্য তো বটেই, এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত জনদের মধ্যেও। তারপর থেকে কেটে গেছে দু’শ বছর । তখনকার অবস্থার সাথে যে এখনকার অবস্থা আমূল বদলে গেছে তা বলা যাবেনা কিছুতেই । এখনো ইউরোপ, আমেরিকায় মানুষ ধর্ম বিশ্বাস একেবারে বাদ দিয়ে দেয়নি । বিষয়টা অপ্রিয় হলেও সত্য – নারীদের ভিতর অন্ধবিশ্বাস , কূসংস্কার , ধর্ম্বিবিশ্বাসের মাত্রা এবং প্রবনতা গুলো পুরূষের তুলনায় অনেক বেশী । এই ব্যাপারটা যেমন গোড়া মুসলিম দেশ গুলোতে সত্য, তেমনি উন্নত বিশ্বের বেলায় ও প্রযোজ্য । হ্যা পার্থক্য অবশ্যই আছে, তা হচ্ছে মাত্রাগত । এসব দেশে আমাদের বাংলাদেশের মতো কেউ ফতোয়ার স্বীকার হয়না, ধর্মের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়না নানা শৃংখল, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া হয়না কাউকে, এমনকি শিক্ষা দীক্ষা থেকে শুরু করে সমাজে-রাষ্ট্রে প্রায় সমান সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছে – তারপরো নারীকে পুরূষের সমান মনে করা হয় বা সমান মূল্য দেওয়া হয়, তা বলা যাবে না । আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্রিটেনের কথা বলতে পারি, কারণ এদেশে আমি দীর্ঘদিন ধরে বাস করছি । ‘ডমেষ্টিক ভায়োলেন্স’ বলে একটা কথা খুব চালু আছে । কারণ এই ব্যাপারটা নারীর বিরুদ্ধে ঘটে বেশ ব্যাপকভাবেই । এমন নয় যে এখানে এসবের বিরুদ্ধে কোন জনমত নেই, বা এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়না – কিন্তু তারপরও তো ব্যাপারটা আটকানো যাচ্ছানা । আটকানো যাচ্ছে না , কারণ নারীকে ‘দূর্বল’ ভাবা হয় । পুরূষের মগজেই আছে এই ধারণা – নারী অপেক্ষাকৃত দূর্বল – অতএব নারীকে মেরে কেটে পার পাওয়া যাবে ! আরো অবাক হতে হয়, নারী বিষয়ক নামী দামী ম্যাগাজিন গুলোর অবস্থা দেখলে । এসব ম্যাগাজিন নেড়েচেড়ে দেখলে, যে কারো মনে হওয়া স্বাভাবিক, নারীর কাজ বুঝি কেবল পুরূষের মনোরঞ্জনে সাজ-গুজ করা আর নানা ছলাকলা শেখা ! পাতার পর পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন থাকে নানা ধরণের ব্লাক ম্যাজিক হতে মুক্তি পাওয়া থেকে শুরু করে বয়ফ্রেন্ডকে ফিরিয়ে পাওয়া পর্যন্ত – কী নেই ! নারীর ‘মেধা’ বলে কোন বস্তু আছে, এসব ম্যাগাজিন দেখলে মনে হয়না । নারীর যত কুঁই কুঁই সব পুরূষের জন্য – পুরূষকে ঘীরে ! এসকল ম্যাগাজিনের কাটতিও প্রচুর । সম্পাদক, পাঠক সকলেই েনারী । কিন্তু ম্যাগাজিন গুলোর মালিক আবার পুরূষ ! । অন্যদিকে আবার দেখা যায় ধর্মবাদীরা ও চার্চতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে নারীকে কাজে লাগাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই । তবে অবশ্য হায়ারার্কির নীচের স্তরে এদের অবস্থান । পণ্য বলে কথা ! পুজিবাদের যেমন নারীকে দরকার পণ্য হিসেবে – তেমনি নারীর বিনম্র মূর্তি উপ্সস্থাপন করে কাজ হাসিল করতে চার্চ গুলোও কম যায়না । প্রায়ই দেখা যায় রোববার গুলোতে একদল নারী দলবেঁধে মানুষের দরজায় দরজায় কড়া নাড়ে । প্রায় আপাদমস্তক অবগুন্ঠিতা, মুখে স্মিত হাসি, হাতে বাইবেল ! হেসে হেসে বর্ননা করে বাইবেলের মাহাত্যের কথা, মানুষ ভোগবাদী হয়ে দু ‘দিনের দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে । মারামারি,কাটাকাটি করছে, যার জন্য পৃথিবীতে এতো অশান্তি – সুনামী,হ্যারেকেন,দৈব দুর্বিপাক লেগেই আছে । ‘গড’ এর শাস্তি বলে কথা ! আসলে , সব কিছু দেখে শুনে মনে হয় পশ্চিমের দেশ গুলোতে আগের ‘ধর্মবাদ’ অথবা বর্তমান পুজিবাদ কোনটাই নারীর জন্য সঠিক পথটি দেখায়নি । ধর্মেরতো পথ দেখানোর প্রশ্নই উঠেনা –পূজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায়ও নারী অনেক পিছিয়ে আছে । পিছিয়ে আছে পুরূষের তুলনায় । কারণ, এখানে পূজির যে দৌরাত্ব, যে লোভী সর্বগ্রাসী চেহারা, তাতে নারীর অংশগ্রহন একেবারেই নগন্য । নারী নিজে এখানে পণ্যের ভূমিকা পালন করে মাত্র । এই বৃত্ত থেকে নারীর পূর্নাঙ্গ মুক্তি আসলে এখনো সুদূর পরাহত । নীতি নির্ধারণে, রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রে আনুপাতিক হারে নারীর সংখ্যা এখনো অনেক অনেক কম । রাজনীতিবিদ নারী, রাষ্ট্রপ্রধান নারী এখনো দূর্লভ । দু’চার জনের উদাহরণ দেখে তুষ্টি লাভ করার কোন কারণ নেই । যাই হোক । এবার আসি মুক্তমনার ডারউইন ডে পালন করা বিষয়ে – এর আগেও ২০০৬ এ মুক্তমনা ডারউইন ডে পালন করেছিলো বেশ হৈ হৈ করে । সেখানে প্রথিতযশা সব লেখকদের সাথে আমার নিজেরো একটা লেখা ছিলো, ‘আলোর মশাল জ্বালো’ শিরোনামে । সেখানে যে কথাগুলো লিখেছিলাম, বিশেষ করে আমাদের দেশের বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে, তা আজো সমানভাবে প্রাসংগিক । তাই মোটামুটি একই কথা আবারো বলতে হচ্ছে । এখানে একটা বিষয় ভাবলে বেশ কৌতুক বোধ হয় , যেখানে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ুয়াদের হওয়া উচিত সংশয়ী, বিজ্ঞানের চেতনা সমৃদ্ধ, সেখানে আমাদের দেশে ঘটছে ঠিক তার উলটোটা । বিজ্ঞান পড়ে ধর্মকথা বিলোয় ! যা কিছু টিম টিম করে প্রগতির আলো জ়্বলছে বা যারা জ্বালিয়ে রেখেছে, তারা সবাই শিল্প-সাহিত্যের মানুষ । বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত-রা এগিয়ে না এলে খাঁটি বিজ্ঞান মনষ্ক প্রজন্ম তৈরী তো এমনি এমনি হবেনা । তেমন ভালো বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই খুবই হাতে গুণা । গত দু’তিন বছর ধরে একুশের বইমেলায় মুক্তমনার লেখকদের বিজ্ঞান বিষয়ক বই বেশ সাড়া জাগিয়েছে । অভিজিত রায় এবং ফরিদ আহমেদের বই ছাড়াও বিশেষ করে বলতে হয় বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইটির কথা । বিবর্তনের মতো কঠিন একটি বিষয়কে প্রাঞ্জল, হ্রুদয়গ্রাহী ভাষায় উপস্থাপণ করা হয়েছে বইটিতে – যে বই পড়ে বোঝতে কারোর-ই অসুবিধা হবার কথা নয় । এই ধরণের বই আমাদের এই প্রজন্মের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে এখন । তাছাড়া অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে ভালো বিজ্ঞান শিক্ষক এর অভাব ও প্রকট । দেশের প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্টান গুলো হচ্ছে এক একটা বাণিজ্যের আখড়া । বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনার সময় এদের কারোর নেই । ছেলে মেয়েরা পড়া মুখস্ত করে উগড়ে দিচ্ছে পরীক্ষার খাতায় – পড়াশোনা করার সময় কোথায় এদের ব্যস্ত জীবনে? উপরে উপরে এরা পালিশ প্রজন্ম ঠিক-ই, কিন্তু অন্দরে এখনও ভয়াবহ কূসংস্কার বিরাজ করছে অধিকাংশের-ই । এখনো এরা অনেকেই বই মেলাতে ভূত প্রেত আর হাল্কা গল্প উপন্যাস খুঁজে বেড়ায় !

ওদিকে দেশ ছেয়ে গেছে মাদ্রাসায় – আমাদের ‘শিক্ষিত’ জন’রা অনেকে আবার আলহাদিত বোধ করেন, ‘গরীব লোকের ছেলেমেয়ে গুলো অন্তত শিক্ষা তো পাচ্ছে’ ভেবে ! এতটুকু শিক্ষা যে খয়রাতী পয়সার কল্যাণে পাচ্ছে, তাই তো ঢের ! ভেবে পাইনা এমন শিক্ষার আসলে দরকার-ইবা কী , যে শিক্ষা দেশে জংগী তৈ্রীতে সাহায্য যোগায় । যারা মোল্লাদের রিজার্ভ শক্তি হিসেবে কাজ করে, কথায় কথায় রাস্তায় বেড়িয়ে আসে, লালনের মূর্তি ভাঙ্গতে অথবা তসলীমার ‘মুন্ডু’ চাইতে । যাদের আসলে কোণ ধারনাই নেই, তসলীমা নাসরীন আসলে কী লিখেছেন,কেন লিখেছেন অথবা ভাস্কর্য্য জিনিষটাই বা আসলে কী । আসলে এরা নিজেরাও জানেনা কিছু হাতে গুণা মোল্লাদের লেঠেল বাহিনী হওয়াই এদের ভবিতব্য । সরকার গুলো বরাবর-ই দেখা গেছে – এদের ভয় পায় এবং সমঝে চলে । অন্যদের দাবী দাওয়া নিয়ে সরকারের কোন মাথা ব্যাথা না থাক্লেও, এদের দাবীর প্রতি সব সরকারের-ই অসীম দরদ ! আবদার করা মাত্র দাবী পূরণ হয়ে যায় ।

না, হতাশার কথা বলে শেষ করবোনা । এবার অন্তত কিছু আশা করতেই পারি – দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসবে । এখন দেখার বিষয় ‘দিন বদল’ আসলেই কথার কথা নাকি সত্যি সত্যি দিন আমাদের বদলে যাচ্ছে …

সবাইকে ডারউইন ডের শুভেচ্ছা