ডারউইন দিবসে স্টেম সেল গবেষণার জন্য কিছু আশা
দিগন্ত সরকার
ক্লাউদিয়া ক্যাস্টিলো ত্রিশ বছর বয়সী এক কলম্বিয়ান মহিলা। তার আর দশটা মানুষের মত সবকিছুই স্বাভাবিক, কিন্তু সমস্যা একটাই। দীর্ঘদিন টিউবারকুলোসিসে ভুগে তার বাঁদিকের ফুসফুস একেবারে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। এখন তাকে সুস্থ করে তোলার উপায় ছিল একটাই – বাঁ দিকের ফুসফুস বাদ দেওয়া। অথবা, সমগ্র শ্বাসনালীটা বদলে ফেলা। এতদিনের রক্ষণশীল চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রথমটাই করার কথা – যদিও তাতে আয়ু কমে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। স্পেনের বার্সেলোনায় শয্যাশায়ী ক্লাউদিয়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা একটু অন্যরকমই ভেবেছিলেন। আর তাদের অন্যরকম চিন্তার সুফল হিসাবে আজকে ক্লাউদিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ।
অনেকেই ভেবে জিজ্ঞাসা করবেন হয়ত, শ্বাসনালী তো একটা মৃতের শরীর থেকে নিয়ে প্রতিস্থাপন করলেই কাজ সহজে হয়ে যায়, এর জন্য এত চিন্তার কি আছে? ঘটনা হল, অন্যের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপন অনেক সময়ই শরীর “সহজ ভাবে” মেনে নেয় না। কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া উপদ্রুত হলে শরীর যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেভাবেই নতুন অঙ্গকেও বহিরাগতদের দলে ফেলে আর রোগ-প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তাকে আক্রমণ করে। এর ফলে সেই নতুন সিস্টেমে শ্বাসনালীও সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। একে বলে ট্রান্সপ্লান্ট রিজেকশন। শ্বাসনালীর মত অঙ্গের ক্ষেত্রে এই রিজেকশনের সম্ভাবনা প্রবল।
তাহলে নতুন শ্বাসনালী আসবে কি ভাবে? ক্লাউদিয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারেরা তার শরীরের এক বিশেষ ধরনের কোষ এ কাজে ব্যবহার করলেন – তার নাম স্টেম সেল। ক্লাউদিয়ার শরীরের স্টেম সেল তার অস্থিমজ্জা থেকে সংগ্রহ করে তা থেকে তৈরী করা হল শ্বাসনালীর কোষ। এরই মধ্যে এক মৃতের শ্বাসনালী সংগহ করে সেখান থেকে জীবকোষগুলোকে একে একে সরিয়ে ক্লাউদিয়ার নিজের স্টেম সেল থেকে উৎপাদিত কোষ দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করা হল। তাহলে যে শ্বাসনালী পাওয়া গেল তাকে শরীর আর বহিরাগত ভাবতে পারবে না, কারণ শরীরের আর দশটা কোষের সাথে তার হুবহু মিলে যায়। এবার সেই “নিজস্ব” শ্বাসনালী প্রতিস্থাপিত করা হল ক্লাউদিয়ার শরীরে। প্রত্যাশামতই দিন-দশেকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠল ক্লাউদিয়া। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আর স্টেম সেল গবেষণায় এ এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
কি এই স্টেম সেল যা ভেল্কিবাজী দেখিয়ে কোষ পুনরুৎপাদন করে ফেলছে? এটা জানতে গেলে আমাদের স্কুলে পড়া জীববিজ্ঞানের দুটো টুকরো জ্ঞানের কথা মনে করতে হবে। স্কুলে নিশ্চয় পড়েছিলেন যে মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের কোষ আছে – কোনোটা চ্যাপ্টা, কোনোটা লম্বা, কোনোটা অনেক অক্সিজেন ধরতে পারে, কোনোটাতে নিউক্লিয়াস নেই আবার কোনোটাতে অনেকগুলো নিউক্লিয়াস। আবার স্কুলেই এটাও পড়া হয়েছিল যে মানুষের শরীর ভ্রূণাবস্থায় শুরু হয় একটি মাত্র কোষ থেকে – সেই কোষই বিভাজিত হয়ে সারা শরীরের কোষ তৈরী হয়। তাহলে কিভাবে একই কোষ বিভাজিত হয়ে ভিন্ন-ভিন্ন ধরণের কোষে রূপান্তরিত হয়? ভ্রূণাবস্থায় প্রথম কোষটি কয়েকবার বিভাজিত হবার পরে একধরণের কোষ তৈরী হয় যা বিভাজিত হয়ে যে কোনো ভিন্ন ধরণের কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। তারা হল আসলে একপ্রকারের স্টেম সেল। এই ধরণের স্টেম সেলকে এমব্রায়োনিক স্টেম সেল বলে। পূর্ণ মানুষের শরীরেও কোষ পুনরুৎপাদনের জন্য স্টেম সেল কাজে আসে – এই স্টেম সেল অ্যাডাল্ট স্টেম সেল নামে পরিচিত। কোনো ক্ষতের ওপর চামড়া গজানোর জন্য একধরণের স্টেম সেল বিভাজিত হয়ে কোষ সরবরাহ করে। কিন্তু এটাও লক্ষ্যণীয়, যে পূর্ণ মানুষের শরীরের স্টেম সেল আর যেকোনো ধরণের কোষ তৈরী করতে পারে না। তাই বড়সড় ক্ষত হলে, তার ওপর চামড়া গজায়, কিন্তু মাংসটা আর গজায় না। স্টেম সেলের পুনরুৎপাদন-ক্ষমতা বয়সের সাথে সাথেই সীমিত হয়ে যায়।বিজ্ঞানীরা আশা করেন যে ভবিষ্যতে স্টেম সেল থেকে যে কোনো ধরণের কোষই তৈরী করা সম্ভব হবে। ধরা যাক কারো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তার হার্টের দুর্বলতর বা অকেজো কোষগুলোকে যদি স্টেম সেল থেকে পাওয়া হার্টের কোষ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে ফেলা যায়, তাহলে সেই হার্ট সুস্থভাবে কাজ করবে, হার্ট অ্যাটাকের রুগীকে আর মৃত্যুর জন্য দিন গুণতে হবে না। ইঁদুরের ওপর এই পরীক্ষা করে দেখাও গেছে যে তা হার্ট অ্যাটাকের পরে সুস্থ হয়ে উঠছে। আবার, পার্কিন্সন্স ডিসিসের সময় আবার মানুষের মস্তিষ্ক ডোপামিন নামে একটি রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদনকারী কোষগুলোর অকালমৃত্যু ঘটে। পারকিন্সন্সে আক্রান্ত ইঁদুরের মধ্যে এই ধরণের কোষ উৎপাদনকারী স্টেম সেল ঢুকিয়ে দিয়ে দেখা গেছে তারা চটজলদি সুস্থ হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানীরা আশা রাখেন অচিরেই এই সাফল্য মানুষের ক্ষেত্রেও রোগ নিরাময়ের চাবিকাঠি হাতে এনে দেবে।
রোগ সারানোর ধাপগুলোও খুব সরল। প্রথম ধাপে, কিছু অনিষিক্ত ডিম্বাণু সংগ্রহ করে তাদের সাথে কিছু শুক্রাণুর নিষেক ঘটানো হয়। সৃষ্ট জাইগোট কয়েকদিনের মধ্যে ব্লাস্টোসিস্ট নামে বহুকোষী ভ্রূণ গঠন করে। এই ব্লাস্টোসিস্ট কালচার করে বিভিন্ন ধরণের কোষ বানানো সম্ভব ল্যাবরেটরিতে – নার্ভ কোষ, হৃৎ কোষ বা রক্তকণিকার কোষ। পরে সময়মত এই কোষগুলো শরীরে ঢুকিয়ে আসল কোষের অভাব মেটানো সম্ভব।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? বিজ্ঞান তো নিজের পথেই এগোচ্ছে। সমস্যাটা স্টেম সেল নিয়েই। স্টেম সেলের গবেষণা করতে গেলে যুক্তিসঙ্গত হিসাবেই অনেক স্টেম সেল লাগে। সহজ হিসাবে সেই স্টেম সেল পাওয়া যেতে পারে দুভাবে – পূর্ণ মানুষের শরীর থেকে সীমিত ক্ষমতার স্টেম সেল আর মানব-ভ্রূণের প্রাথমিক দশা থেকে। প্রথমটার ক্ষমতা সীমিত তাই বিজ্ঞানীদের অতটা আগ্রহ নেই তা নিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় ধরণের স্টেম সেল নিয়ে নিলে ভ্রূণের একরকম “প্রাণনাশ” হয়। তাতেই রক্ষণশীলদের আপত্তি। যা এক একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারত, তাকে “মেরে” ফেলে গবেষণার কাজে লাগানো হবে – বিজ্ঞানীদের এত স্পর্ধা? এর পরে তো দুদিন পরে কোনো রোগের গবেষণায় বাচ্চাদেরও গিনিপিগ হিসাবে কাজে লাগানো হবে। অনেক ধর্মমতে ভ্রূণের মধ্যেই আত্মা প্রবেশ করে, তাই ভ্রূণহত্যা মানবহত্যার সম-অপরাধ। সেই “অপরাধ” কেবল মাত্র গবেষণার কাজে করতে দিতে তারা রাজী নন। স্বাভাবিক ভাবেই, সরকারী টাকায় স্টেম সেলের গবেষণা আমেরিকার মত রক্ষণশীল দেশে চালানো সবসময় সম্ভব হয় না।
ডারউইনের জন্মের দুশো বছর পরে, এই বছরেই আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা করেছেন যে আমেরিকায় সরকারি সাহায্যে স্টেম সেল গবেষণার ওপর সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। অবশেষে বিজ্ঞানীরা আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন যে ওরিজিন অব স্পিসিসের প্রকাশের দুশো বছর পরে তারা অবশেষে কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই স্টেম-সেল নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে পারবেন।
ডারউইন এখানে কিভাবে এলেন? স্টেম সেল গবেষণার সাথে ডারউইনের বিবর্তনবাদের সম্পর্ক কোথায়? বিবর্তন কি তাহলে স্টেম সেলের গবেষণার বিষয়বস্তু? – সন্দিহান অনেকেই প্রশ্ন করবেন। এই মুহুর্তে বিবর্তনের সাথে স্টেম সেলের সরাসরি কোনো সম্পর্ক হয়ত নেই, কিন্তু এই গবেষণায় ডারউইনের অবদান অনস্বীকার্য। গ্যালিলিও গ্যালিলেইকে যে কারণে মহাকাশ বিজ্ঞানের পথিকৃত বলা চলে, সেই একই কারণে ডারউইনও স্টেম সেল গবেষণার জনক। গ্যালিলিও পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন – প্রমাণ করেছিলেন পৃথিবী হল সৌরজগতের মামুলি এক গ্রহ, পৃথিবীর মত আরো অনেক গ্রহ আছে, আছে সূর্যের মত অনেক নক্ষত্র। যার ফলে তৈরী হয়েছিল বাকি অসীম মহাবিশ্বকে জেনে নেবার এক অপরিসীম ইচ্ছা আর চেষ্টা – যার ফলশ্রুতিতে আজকে আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলে ফিনিক্স অভিযান করছে, ভয়েজার সৌরজগত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলেছে। ডারউইনও জীবজগতের সিংহাসন থেকে এক ধাক্কায় টেনে নামিয়েছেন মানবজাতিকে। মনুষ্য-প্রজাতি যে বিশেষভাবে সৃষ্ট কোনো জীব নয়, বরং গরিলা বা শিম্পাঞ্জীও আমাদের দূরসম্পর্কের মাসতুতো বা পিসতুতো ভাই হয় – তা মহাবিশ্বে মানুষের অবস্থান সম্পর্কে যুক্তিবাদী এক ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছে। আর যেহেতু ভ্রূণাবস্থায় বিবর্তনের ধাপগুলোই দ্রুত পেরিয়ে যায় মাতৃজঠরে, তাই আমরা বলতেই পারি, মাতৃজঠরে পাঁচ দিন বয়সের মনুষ্যভ্রূণ একটা বহুকোষী জীবের থেকে কোনো অংশে আলাদা নয়। এই ভ্রূণের না আছে কোনো পূর্ণ মানুষের মত চিন্তাশক্তি বা উপলব্ধি। সুতরাং, সামগ্রিক মানবজাতির কল্যাণে তাদের পরীক্ষার কাজে ব্যবহার করা নিতান্তই আরেকটা বহুকোষী জীবকে ব্যবহার করারই সমতুল্য।
সমস্যা হল, ডারউইনের জন্মের দুশো বছর পরেও তার প্রকাশিত তত্ত্ব এখনও বিতর্কিত। আরো মজার ব্যাপার, এই বিতর্ক বিজ্ঞানীমহলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নয়, বরং বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে ধার্মিক ও রাজনীতিবিদদের। তাই স্টেম সেল উৎপাদনকারী ভ্রূণ যে আদপেই এক বহুকোষী জীবের সমতুল্য, সেই বোধ সকলের সমানভাবে তৈরী হয় নি। অতীতে লেখা ধর্মগ্রন্থ-উদ্ধৃতির সাহায্যে আজও তারা মানবভ্রূণকে বিবর্তনের পথের এক যাত্রী হিসাবে দেখতে নারাজ। আর সেই সাথেই আমাদের ভবিষ্যতও বন্ধক রয়ে গেছে আমাদের অতীতের হাতে।
তথ্য সূত্র –
১) সি এন এন প্রশ্নোত্তর
২) হাউ স্টাফ ওয়ার্ক্স – স্টেম সেল
৩) খবরটা পড়তে পারেন এখানে
দিগন্তদা, যারা রোগের ভুক্তভোগী তারাই যানে তাদের রোগ সারানোর জন্যে স্টেম সেল কতটা জরুরী। আপনাকে ধন্যবাদ এমন ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে এমন তথ্যবহুল লেখার জন্যে। ভালো থাকবেন। :bye:
অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ দিগন্তের ! স্টেমসেল নিয়ে বাংলায় লেখা পাওয়া সত্যই দুর্লভ। দিগন্তের লেখা সেই আক্ষেপ ঘুঁচাবে।