শ্রদ্ধাঞ্জলি: জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী চার্লস ডারউইন
কেশব কুমার অধিকারী
নিঃসন্দেহে ঝড় তুলেছিলেন এই বিজ্ঞানী, এই সেদিন অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি । তিনি যা বলেছেন আজও দ্ব্যর্থহীন ভাবে তা পরিত্যাজ্যতো নয়ই বরং বহু ক্ষেত্রেই তা নতুন করে ভাবতে আর নতুন আঙ্গিকে গবেষণায় উত্তরোত্তর উৎসাহিত করেই চলেছে । তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞানী, সৃষ্টিবাদী দার্শনিক, ইংল্যন্ডের চার্চবিশপ থেকে শুরু করে প্রথিতযশা বিজ্ঞানীরা পর্য্যন্ত তাঁর প্রদত্ত তত্ত্বের আলোকে অনিঃশেষ বিতর্কে জর্জরিত । আর এই বিতর্কের অবসানও সহসা হবার যো নেই, তাঁর সংগৃহীত পর্বত প্রমাণ তথ্য ও উপাত্য ! কি নেই তাতে ? জীববিদ্যার মৌলিকত্ত্ব থেকে শুরু করে ভূতত্ত্ব, ভূগোল, শরীরবিদ্যা, ফসিল ও প্রাগৈতিহাসিক জীবাশ্ম পর্য্যন্ত সবই তাঁর পর্যালোচনার ভেতরে । এই মহীরূহের উপর ভিত্তিকরেই দাঁড়িয়ে আছে তাঁর যুগান্তকারী প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটি । যার ফলে সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞানীরা প্রাণ-সৃষ্টি এবং এর বিকাশ এবং বহুমাত্রিকতার বিঞ্গান ভিত্তিক কারণ অনুসন্ধানে বহুদূর এগিয়েছেন ।
এই মহান বিজ্ঞানীর জন্ম হয় আজ হতে দুইশ’ বছর আগে ইংল্যান্ডের শ্রপশায়ার কাউন্টির শ্রশবারিতে ১৮০৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারীতে । বাবা-মায়ের ছয় ছেলে-মেয়ের পঞ্চম সন্তান ছিলেন তিনি । ডাক্তার রবার্ট ওয়ারিং ডারউইন (১৭৬৬ – ১৮৪৮) এবং সুসানাহ্নি ওয়েজউড্ (১৭৬৫ – ১৮১৭) ছিলেন যথাক্রমে চার্লস এর বাবা এবং মা । চার্লস এর দাদু ছিলেন বিখ্খ্যাত মৃৎশিল্পী যোশেফ ওয়েজউড্ (১৭৩০ – ১৭৯৫); আর ঠাকুরদাদুতো বিখ্খ্যাত ডাক্তার ইরাস্মাস ডারউইন (১৭৩১ – ১৮০২) । ১৭৯৪-১৭৯৬ সালে তিনি ‘জুনোমিয়া’ নামে বিবর্তনের প্রণালীর ওপরে একটি তথ্য সমৃদ্ধ প্রকাশনা উপস্থাপন করেন । ছোট্ট চার্লস সেই থেকেই ঠাকুর দাদুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, হয়ে উঠেন প্রকৃতি প্রেমিক । নিঃস্বর্গের প্রতিটি প্রাণী, গাছ-পালা তাঁর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় । কি এক অনাবিল আনন্দে প্রকৃতির উদার আহ্বানে সেই ছোট্ট চার্লস তখন থেকেই সংগ্রহ করতে থাকেন বিভিন্ন ধরনের পাথর, শামুক-ঝিনুকের খোল, পাখীর ডিম, বিচিত্র পাতা, পোকা-মাকড়, প্রজাপতি আরোও কতো কি! এই যে শখের বসে সংগৃহীত উপাত্য, এই যে অচিন্তনীয় রহস্যে ঘেড়া প্রাকৃতিক বৈচিত্রের সংগৃহীত সম্ভার, পরবর্তী জীবনে তাঁর সমগ্র চিন্তার জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলো । পারিবারিক ভ্রমনে এই চার্লস একবার এসেছিলেন ওয়েলস্ এ । সেখানকার প্রকৃতির রূপবৈচিত্র, ভৌগোলিক বৈশাদৃশ্য আর কীট-পতঙ্গের বিচিত্রতা তাঁকে মুগ্দ্ধ করেছিলো । শুধু তাই নয়, এই অনিঃশেষ কৌতুহল নিয়ে ফিরে গেলেও বার বার তিনি এখানে এসেছিলেন এই ভৌগোলিক রূপ-বৈচিত্র্য আর সব বৈশাদৃশ্যের রহস্য ভেদের তৃষ্ঞা নিয়ে ।
মাত্র আট বছর বয়েসে মা’কে হাড়ান । রেভারেন্ড জি. কেইস এর পরিচালিত ইউনিটারিয়ান ডে স্কুলে ভর্তি হলেন তখন । বছর পেরুতে না পেরুতেই চলে এলেন ডক্টর স্যামুয়েল বাটলারের শ্রসবারির বোর্ডিং স্কুলে । ১৮২৫ সাল পর্যন্ত এখানেই অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন চার্লস । ইংরেজী সাহিত্যের খ্যাতনামাদের ঐশ্বর্য্যের অনুসন্ধানে নামলেও এতোটুকুও উৎসাহ খুঁজে পেলেন না ওখানে । বরং রসায়ন এবং কিছু কিছু ব্যাবহারিক বিঞ্গানে তাঁর উৎসাহের কমতি ছিলো না মোটেও । ছেলের এহেনো মতিভ্রমে বিচলিত পিতা তাঁকে পাঠালেন স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিনে পড়াশুনার উদ্দ্যেশ্যে । আশা করেছিলেন, ছেলে তাঁরই মতো ডাক্তার হয়ে উঠবে বাবার হেঁটে যাওয়া পথ ধরে ধরে । কিন্তু ব্যবহারিক মেডিসিনের দিকেই চার্লসের ঝোঁক ছিলো বেশী, অসুস্হ মহিলা কিংবা শিশুদের চিকিৎসা বা ব্যবস্হা পত্রের চাইতে । প্রথাগত বিদ্যাচর্চা, তা সে চমকপ্রদ রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিনেরই হোক কিংবা ইউনিটারিয়ান সোসাইটির আয়োজিত শরীরবিদ্যা, ভূগোল কিংবা প্রাণীবিদ্যা বিষয়কই হোক, বক্তৃতা বা পূথিগত বিদ্যাচর্চা তাঁর কাছে ছিলো বিরস এবং আবেদনহীন । বরং ভালোবাসতেন সহ শিখ্খার্থী সমেত মাঠে ঘাটে ঘুড়ে বেড়িয়ে বিভিন্ন বৈচিত্রময় উপাত্য সংগ্রহে । এসময়ে তিনি এক কৃষ্ঞাঙ্গ ট্যাক্সিডার্মিস্ট এর কাছ হতে জেনেছিলেন কি করে বিভিন্ন পাখীর নমুনা সংগ্রহ করে রাখা যায় । অনেক অনেক বসন্ত দিন তিনি পার করেছিলেন ‘মায়ের’-এ তাঁর অতি প্রিয় মামা ‘জো’ এর বাড়ীতে । দিনের পর দিন পার করেছেন মামার সাথে পাখী শিকারে, নদীতে ঝিলে মাছ ধরে । সেসময় তিনি সামুদ্রিক প্রজাতি ব্রায়োজোয়ান ফ্লাসষ্ট্রার উপরে এক প্রকাশনা পড়েছিলেন এবং যোগদান করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লিনিয়ান সোসাইটিতে । এসময় তিনি খুঁজে পান যে, মস্ জাতীয় এই প্রাণীটির সিলিয়া (এক ধরনের পাখনা) রয়েছে যার দরুন সে নিজেকে স্হানান্তরে সক্ষম । এটিই ছিলো চার্লস ডারউইনের অসংখ্য গুরুত্ত্বপূর্ণ সফল অনুসন্ধানী কর্মকান্ডের প্রথম আবিষ্কার ।
এই বিশাল জাগতিক বৈচিত্রের প্রতি তাঁর অন্তহীন অনুসন্ধিৎসা আর গভীর প্রকৃতি প্রেম তাঁকে টেনে বের করে নিয়েছিলো ঘর থেকে বাহিরে । সমগ্র জীবণকে তিনি সমর্পণ করেছিলেন এই অতলান্ত প্রকৃতির রূপ-রহস্য ভেদের এবং সৃষ্টি আর বিকাশের সূখ্মতম জটিল প্রকৃয়ার ধারাবাহিকতা নির্ণয়ে । ছেলের এই অগতানুগতিকতা এবং বিক্ষিপ্ত মনোবৃত্তিতে বিচলিত পিতা বুঝলেন, চার্লসের ডাক্তার হয়ে গড়ে উঠার কোনই সম্ভাবনা নেই । এক পর্য্যায়ে প্রস্তাবও করলেন চার্চের ধর্ম যাজকের কর্তব্য পালনে । যাই হোক নিজের সীমাবদ্ধতার বিষয় গুলো স্মরণে এনে খানিকটা যেনো বিচলিতই হলেন চার্লস । সুতরাং একজন ব্যক্তিগত শিক্ষকের সাহচর্য্যে গ্রীক ভাষা চর্চা আরম্ভ করলেন তিনি । লখ্খ্য, ক্যম্ব্রিজে অধ্যয়ন । যেখানে তিনি ১৮২৮ হতে ১৮৩১ পর্য্যন্ত অধ্যয়ন শেষে বি. এ. ডিগ্রী নিয়ে স্নাতক হন । অনেকটা দ্বিধান্বিত চিত্তে শংকায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন পড়াশুনায় আবারো । আবারো ভয় এবং একধরনের অসন্ত্তুষ্টি এই ধীর লয়ে প্রচলিত বক্তৃতা প্রবন পড়াশুনায় । বরং পছন্দ করতেন হাতে কলমে এবং সরাসরি ফিল্ড এস্কারশনে, যেখানে উদ্ভিদতত্ত্ব, ভূ-তত্ত্ব, প্রাণী-বৈচিত্র, পোকামাকড় সমেত প্রাকৃতিক সামষ্টিক রূপবৈচিত্রের বিশ্লেষন সম্ভব । তবুও দ্বিধান্বিত চিত্তে সংশয়ে শুরু করলেন তিনি ।
সঙ্গীত, চিত্রকলার মতো বিষয় গুলোও তাঁকে আকর্ষণ করতো, মোহময়তায় খানিকটা যেন আসক্তিও । সহপাঠীদের সঙ্গে চিরাচরিত তাসের আড্ডা, গভীর রাতের মদের আড্ডা, এ সবই তাঁকে যেমন সবার মাঝে টেনেছে তেমনি তিনিও পেয়েছেন সবার মাঝে এক হবার অসাধারন সুযোগ । এই ক্যাম্ব্রিজে থাকা কালীনই তিনি উদ্ভিদবিদ্যায় বুৎপত্তি লাভ করেন । মূলতঃ অধ্যাপক জন স্টিভেন হেনস্লো (১৭৯৬ – ১৮৬১) এর প্রত্যখ্খ্য সংসর্গে ও তত্ত্বাবধানে । এই অধ্যাপক হেনস্লো পরবর্তীতে চার্লস ডারউইনের একদিকে যেমন বিশেষজ্ঞ গবেষনা তত্ত্বাবধায়ক অন্যদিকে অসামান্য হৃদয় বন্ধনে আবদ্ধ বিশ্বস্হ বন্ধুতেও পরিনত হন । এনার ই প্রত্যখ্খ্য অনুপ্রেরণা আর আগ্রহে এইচ. এম. এস. বিগেল জাহাজের বিশেষজ্ঞ উদ্ভিদবিদ হিসেবে চার্লস ডারউইন নিয়োগ পান । যদিও জাহাজে তিনি ছিলেন ডাক্তার! এদিকে ছেলের এহেনো সিদ্ধান্তে বাবা রবার্ট ওয়ারিং ডারউইনতো বেঁকে বসলেন দারুন অসন্তুষ্টিতে । এগিয়ে এলেন মামা জো । তিনি শেষ পর্য্যন্ত বুঝাতে সক্ষম হলেন ডাঃ ওয়ারিং ডারউইন কে যে, এ ধরনের ভ্রমন চার্লস এর জন্যে বরং মঙ্গলজনকই হবে । তাঁর নিজের মতামতও তেমনই এবং চার্লস এর সমগ্র জীবনে এই অভিজ্ঞতা অসম্ভব গুরুত্ত্বপূর্ন ছিলো । যাইহোক, ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিজরয় (১৮০৫ – ১৮৬৫) এর পরিচালনায় ১৮৩১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর দ্য বিগেল চার্লস ডারউইনকে সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ডেভনের প্লাইমাউথ থেকে ছেড়ে গেলো ।
দীর্ঘ যাত্রায় কেপ ভার্ড এর সেন্ট জাগোতে এসে পৌঁছুলেন শুরুতেই । তারপরে একে একে টেরা ডেল ফুগো, ফকল্যান্ড, চিলো, ভালপারাইসো, গেলাপোগাস, আরকিপেলাগো, কেলিং আইসল্যান্ড, কেপ অব গুডহোপ, এসেনসোন হয়ে আ্যজোরস্ এ আসেন । প্রায় পাঁচ বছর ধরে গোটা পৃথিবী চষে বেড়িয়ে মহাসমুদ্রের মায়া কাটিয়ে শ্যামল মাটির ভালোবাসার স্পর্শে ফিরে এলেন । কিন্তু সঙ্গে নিয়ে এলেন অপার বিষ্ময়! আর অচিন্তনীয় রকমের পর্বত প্রমান প্রামান্য দ্রব্য । তার মধ্যে অন্যতম ছিলো অসংখ্য ভূ-তাত্ত্বিক উপাত্য আর প্রাণীর ফসিল এবং কিছু কিছু জীবন্ত সংগ্রহ । অধ্যাপক হেনস্লোকেও পাঠালেন কিছু উপাত্য তাঁর বাড়িতে আনুসঙ্গীক বিস্তারিত গবেষনায় গূঢ় রহস্য ভেদের লখ্খ্যে ।
এদিকে সমুদ্র ভ্রমনে থাকা কালীন চার্লস লয়েল (১৭৯৭ – ১৮৭৫) এর প্রিন্সিপাল অব জিওলজি (১৮৩০ -১৮৩৩) হাতে পেয়ে তিনি অবাক বিষ্ময়ে লখ্খ্য করলেন পৃথিবীর ভূ-তাত্ত্বিক বৈচিত্রময়তা , এর সমরূপতা, ধারাবাহিক বিবর্তন, যেনো এক ছান্দিক বৈশিষ্ট্য । ভূ-বৈচিত্রের এই ধারাবাহিক বিবর্তন যখন তিনি প্রত্যখ্খ্য করলেন তখন চার্লস লয়েল এর গবেষণার গূঢ়ার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হলেন না ডারউইন । নিজেই সেই মতামত প্রচারে এবং পরবর্তী পদখ্খেপ গ্রহন করলেন ব্যপক অনুসন্ধানে গবেষণায় । এসময় ১৮৩৯ সালে তিনি প্রকাশ করলেন পত্রিকান্তরে তাঁর ভূ-তাত্ত্বিক বিবর্তনবাদ এর সুপ্রতিষ্ঠিত নিয়ম তাঁর “দ্য প্রেজেন্ট ইজ দ্য কী’ টু দ্য পাস্ট” প্রবন্ধে । এখানে তত্ত্বের পাশা পাশি স্হান পেয়েছে তাঁর বিগেল জাহাজের প্রত্যখ্খ্য অভিজ্ঞতা । তৎকালীন গুড়ুত্ত্বপূর্ণ প্রকাশনা সংস্হা গুলো ততোধিক গুড়ুত্ত্বে চার্লস ডারউইনের প্রত্যখ্খ্য অভিজ্ঞতা আর উদ্ঘাটিত তথ্য প্রচলিত ধ্যান ধারনার বিপরীতে জনসন্মুখে তুলে ধরেছিলো । শুধু তাই নয়, তাঁর আরোও বিষ্ময় এই যে, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতেও যে রূপ-বৈচিত্র তারও মূলে যে ধারাবাহিক বিবর্তনবাদ কাজ করছে তারও উপাত্য থেকে তথ্য সহ পাঁচ পাঁচটি ভলিউম তিনি প্রকাশ করলেন । নাম দিলেন “জুওলজি অব দ্য ভয়েজ অব এইচ. এম. এস. বিগেল” । এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮৩৮ সালে অথবা ১৮৪৩ এর মাঝে কোন এক সময়, যেখানে তিনি বিস্তারিত বিবরণ, ছবি, চিত্রকল্প সংযোজন করেছিলেন ।
১৮৩৬ সালে ইংল্যন্ড এ ফিরে আসার অব্যবহিত পরেই ডারউইন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন তৎকালীন সুধী বিঙ্গানী এবং তাঁর সতীর্থ বৃন্দের ঔৎসুক্যের ভাড়ে । এঁদের মধ্যে লয়েল, একজন মার্কিন উদ্ভিদবিদ আশা গ্রে (১৮১০ – ১৮৮৮), ইংলিশ উদ্ভিদবিদ স্যর জোসেফ ডালটন হুকার (১৮১৭ – ১৯১১) এবং ইংলিশ প্রাণীতত্ত্ববিদ থমাস হেনরী হাক্সলী (১৮২৫ – ১৮৯৫) ছিলেন অন্যতম । এদেরই সহচার্য্যে চার্লস ডারউইন এসময় জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন । এ সময় তিনি ব্যাপক পড়াশুনা এবং তথ্য বিশ্লেষন করেন, ভূ-তাত্ত্বিক ও ভূ-প্রাকৃতিক বিবর্তন এবং প্রাণ সৃষ্টি ও প্রাণ বিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়াবলীতে । লিনেন সোসাইটি জার্নালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রজাতির আনুক্রমিক পরিবর্তন, ভূ-তাত্ত্বিক বিবর্তনের ধারা, বিভিন্ন সামুদ্রিক জীবের জীবন বৈশিষ্টের উপরে তাঁর গবেষণার ফলাফল । এসব খ্খেত্রে তাঁর সংগৃহীত উপাত্য সমূহই ছিলো দিক নির্দেশনা আর উপসংহারে পৌঁছাবার মূল হাতিয়ার । এসময় তিনি তাঁর সমুদ্রযাত্রার অভিঙ্গতা লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন । ১৮৪২ সালে প্রকাশ করেন “দ্য স্ট্রাকচার অব দ্য কোরাল রীফস্” ।
১৮৫৯ সালে প্রকাশ করেন তাঁর বিঙ্খ্যাত গ্রন্থ “দ্য অরিজিন অব স্পিসিস বাই মিনস্ অব ন্যাচারাল সিলেকশন” ।
এদিকে আরো একজন ইংলিশ আ্যন্থ্রপোলজিষ্ট এবং প্রাণীতত্ত্ববিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস্ (১৮২৩ – ১৯১৩) প্রায় সমসাময়িক কালেই একই বিষয়ে স্বাধীন ভাবে গবেষণা করেছিলেন । তিনিও প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটি পৃথক ভাবে প্রস্তাব করেন এ সময় তাঁর গবেষণা লব্ধ উপাত্য বিশ্লেষনে । কিন্তু ডারউইন কর্তৃক প্রকাশিত তত্ত্বটি সমস্তকিছু ছাপিয়ে এতো বিস্তৃতি লাভ করেছিলো এবং সাড়া জাগিয়েছিলো যে, বইটি প্রকাশের পরে কয়েকটি সংস্করণ মূহুর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় । প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই অন্ততঃ ১২টিরও বেশী ভাষায় বইটি অনূদিত হয়ে যায় । সেই থেকেই শুরু ডারউইনিজমের, দেশে দেশে, যুগে যুগে যে প্রচলিত সমাজ সভ্যতা, হঠাৎ আঘাতে ভেঙ্গেপড়ে, ধ্বংসস্তুপের উপরে গড়ে উঠে নতুন সমাজ সভ্যতার বিকাশ, ডারউইনিজমের পরে তেমনটিই ঘটেছে আর আজ তার বিকাশ ও পরিপক্কতার পালা উপনীত । তাঁর সেই প্রাণের বিবর্তনবদিতা আর প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব আজ মানব সভ্যতার চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে যেনো কুঠার আঘাত, এই হচ্ছে ডারউইনিজম ।
জো’ আঙ্কেলের মেয়ের প্রেমময় বন্ধনে ধরা পরেছিলেন ডারউইন । অবশেষে ১৮৩৯ সালের ২৯শে জানুয়ারী ডারউইন বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন মামাতো বোন ইমা ওয়েজউড কে নিয়ে । কেন্ট কাউন্টির ডাউনিতে তাঁরা ঘর বাঁধলেন । প্রথম সন্তান উইলিয়াম ইরাসমাসের (১৮৩৯ – ১৯১৪) জন্ম তাঁকে এতটাই মোহীত এবং উদ্বেলিত করেছিল যে তিনি এসময় প্রাণী জগতের আবেগকে বিশ্লেষিত করতে গিয়ে লিখলেন “এক্সপ্রেশন অপ দ্য ইমোশনস ইন মেন এন্ড আ্যনিমেলস্”। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭২ সালে । ক্রিশ্চিয়ানিটিতে বিশ্বাসী এই বিঙ্গানী তাঁর সমস্ত বিশ্বাস পরিত্যগ করেন তাঁর দ্বিতীয় কণ্যা এ্যনী এলিজাবেথের (১৮৪১ – ১৮৫১) আকষ্মিক মৃত্যুতে । এসময় মানসিক ভাবে তিনি ভীষন রকম ভেঙ্গে পড়েন । পরবর্তী মেয়ে ম্যারী ইলেনরও জন্মের পরে ঐ বছরই মারা যান ১৮৪২ সালে । ম্যারী ইলেনরের ছোটবোন হেনরীয়েটা ইমার (১৮৪৩ – ১৯০৪) ডাক নাম ছিলো ইতি । এই ইতিই তার বাবা চার্লস ডারউইনকে প্রায়সঃই সহযোগীতা করতেন তাঁর কাজে । তাঁর পরবর্তী সন্তান স্যার জর্জ হাওয়ার্ড ডারউইন (১৮৪৫ – ১৯১২) পরবর্তী কালের নামকরা ইংলিশ মহাকাশচারী । তার ছোট বোনের নাম ছিলো এলিজাবেথ (১৮৪৭ – ১৯২৬) যিনি চিরকুমারী ছিলেন । তার ছোট ভাই স্যার ফ্রান্সিস (১৮৪৮ – ১৯২৫), পিতার পথ ধরে এগিয়েছিলেন বহুদূর । তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বনাম ধন্য উদ্ভিদবিদ এবং ক্যাম্ব্রিজের বিখ্খ্যাত অধ্যাপক । বাবার সাথে যুক্ত থেকে একদিকে তিনি চালিয়েছেন নিরন্তর গবেষণা অন্যদিকে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে চার্লস ডারউইনের সঙ্গে সহলেখক হিসেবে কাজ করেছেন “দ্য পাওয়ার অব মুভমেন্ট ইন প্ল্যান্ট” –এ ১৮৮০ সালে । ১৮৮৭তে অবশ্য তিনি তাঁর বাবার জীবনী এবং কিছু অপ্রকাশিত চিঠি পত্র সহ গুরুত্ত্বপূর্ন চার্লস ডারউইনের জীবন ইতিহাস প্রকাশ করেন । ১৯১৩ সালে তাঁর কৃতিত্ত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ পান ‘নাইট’ উপাধি । চার্লস ডারউইনের পরবর্তী সন্তান মেজর লিওনার্ড ডারউইন (১৮৫০ – ১৯৪৩) ছিলেন রাজ প্রকৌশলী । পরবর্তী কালে তিনি রয়েল জিওলজিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন । এর পরে এলেন স্যার হোরাস ডারউইন (১৮৫১ – ১৯২৮) । স্যার হোরাসই হলেন বিখ্খ্যাত ক্যাম্ব্রিজ সাইন্টিফিক কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা । চার্লস ডারউইন এবং ইমার কনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্মেছিলেন চার্লস ওয়ারিং (১৮৫৬ – ১৮৫৮), কিন্তু সম্ভবতঃ হামে আক্রান্ত হয়ে শৈশবেই তিনি বিদায় নেন ডারউইন দম্পতির মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে।
বিশ্ব চরাচরে এই দার্শনিক যতই তাকিয়েছেন তাঁর দুচোখ মেলে প্রতিবারই তিনি হয়েছেন হতবাক বিষ্ময়ে বিমূঢ় ! মনের দিক থেকে যেমন ছিলেন উদার তেমনি ছিলেন নরম আরোও স্পষ্টভাবে বললে ছিলেন আবেগ আশ্রয়ী । অতি সহজে যেমন বেদনার্ত হতেন তেমনি এসবের যন্ত্রনা থেকে দূরে থাকতে নিজেকে কর্মে ব্যপৃতও রাখতেন তিনি । অতি উদ্দীপনা এবং কর্ম চাঞ্চল্য, তার সাথে যুক্ত আবেগী মন হওয়ায় খুবই সংশয়ে থাকতেন তিনি । হয়ত এটি কাল হয়ে দেখা দিয়েছিলো তাঁর মাঝে । অল্প বয়েসেই হৃদরোগের লখ্মন দেখা দেয় । বিগেল জাহাজে ভ্রমনের প্রাক্কালেই তিনি টের পান তাঁর হৃদযন্ত্রের বেসুরো বেতাল স্পন্দন । কিন্তু চুপ থেকে যান, পাছে কাজে বিঘ্নঘটে কিংবা সবাই বাধ সাধে কাজে, সহযোগীতায় ।
সম্পূর্ন বাস্তববাদী নীরেট বিজ্ঞানমনষ্ক এই দার্শনিক তাঁর বিখখ্যাত গ্রন্হ “অরিজিন অব স্পিসিস” এ যে দৃষ্টি উন্মোচন করে দিয়েছিলেন সেটিই ছিলো আধুনিক বিজ্ঞানের নিজের দিকে ফিরে তাকাবার ক্ষন ! সমস্ত পশ্চাদ্পদতা, দৈন্যতা, সংকোচ কে দূরে ঠেলে দিয়ে এক কঠিন বস্তুবাদী দর্শনের ভীত রচনা করেছিলেন তিনি ।
যুগ যুগ ধরে যে সভ্যতা আয়েসী আর মতলববাদী ধর্মীয় গোঁড়ামীর শৃংখলে আবদ্ধ, আজও মানুষ মুক্ত হতে পারেনি সেই শৃংখল হতে । চার্লস ডারউইন হচ্ছেন সেই কালের ক্ষনজন্মা পুরুষ যিনি মানব জাতিকে দেখিয়েছিলেন প্রকৃত আলোর সন্ধান, দিয়েছিলেন হাতছানি । প্রাণের সমস্ত আবেগ, ভালোবাসা আর নিষ্ঠা যেনো তাঁরই নির্দ্দেশিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত হয় সমান্তরাল ভাবে, এমনতর শ্রদ্ধাই আজ তাঁর প্রাপ্য ।
১৮৮২ সালের ১৯শে এপ্রিল ৭৩ বছর বয়েসে নিজ আলয়ে পরিজন পরিবেস্টিত আধুনীক বিঙ্গানমনষ্কতার প্রবক্তা পুরুষ চার্লস ডারউইন আমাদের কাছ হতে বিদায় নেন অনন্ত কালের যাত্রায় । শুধু রেখে যান বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠ আর ঝাপসা দৃষ্টি, যাতে চিরাচরিত সামন্ততান্ত্রিক মিথ্যে ধারনা গুলো আর কন্ঠে নিনাদিত না হয়, দৃষ্টি যেনো সংকুচিত হয়ে না আসে বিশ্বমানবতার অতীত কোন অশ্বারোহীর শিরঃস্ত্রাণে ।
কেশব কুমার অধিকারী, সহযোগী অধ্যাপক, বায়োটেকনোলজী ও জেনেটিক ইন্জিনীয়ারিং বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, ঢাকা, বাংলাদেশ
[বি. দ্র.: তথ্য সমূহ ইন্টারনেট থেকে সংকলিত এবং ভাষান্তরিত]
Leave A Comment