প্রথম র্পব-

You may fool all the people some of the time; you can even fool some of the people all the time; but you can not fool all of the people all the time. অর্থাৎ, সকল মানুষকে কিছু সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায়। কিছু কিছু মানুষকে সকল সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায়, কিন্তু সকল মানুষকে সকল সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায় না।– (মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৮০৯—১৫ এপ্রিল, ১৮৬৫)

প্রতিটি মানব সমাজে বিশৃঙ্খলা, মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি, আর্থ-সামাজিক অবনতির অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রধান ও অন্যতম কারণ হচ্ছে ‘ধর্ম’ (Religion)। সমাজবিজ্ঞান আর নৃবিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি আদিম-অসহায় মানুষদের অজ্ঞতা, কল্পনা আর ভয়ভীতি থেকে একদা ধর্মের উৎপত্তি; এবং এর যাত্রা শুরু আজ থেকে প্রায় চল্লিশ থেকে পঁচিশ হাজার বছর আগের মানুষের পূর্বপ্রজাতি নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতির মধ্যে। আস্তে আস্তে সময়ের পরিক্রমায় মানুষের যেমন ক্রমবিকাশ ঘটেছে, চিন্তাচেতনার নানা স্বরূপ প্রস্ফুটিত হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন দর্শনে, তেমনি ধর্মীয় চেতনারও বিস্তৃতি ঘটেছে ভিন্ন ভিন্নরূপে। বিচ্ছিন্ন মানুষ বনে-জঙ্গলে বন্য-হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সংগ্রহের সুবিধার্থে আর ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, খরা, অধিক বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দাবানল ইত্যাদি) থেকে বেঁচে থাকতে গিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে, গোষ্ঠীবদ্ধ থেকে সমাজবদ্ধ হয়েছে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করেছে। এই সমাজ কাঠামো টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেদের মতো করে কিছু নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সে সময়কার মানুষের জীবন-জগৎ সম্পর্কে পরিপূর্ণ কিংবা বিশ্লেষণী জ্ঞান না থাকার দরুন তাদের মধ্যে প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য, বন্য পশুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য, পেটপুরে কিছুটা খাবার সংগ্রহের নিশ্চয়তা লাভের উদ্দেশ্যে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রাক-ধর্মীয় চেতনা বিস্তার লাভ করে। প্রাক-ধর্মীয় চেতনার ধারণার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ সময়ে আত্মার ধারণা থেকে টোটেমবাদ, টোটেমবাদ থেকে সর্বপ্রাণবাদ, সর্বপ্রাণবাদ থেকে সর্বেশ্বরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ থেকে বহুঈশ্বরবাদ-এ মোড় নিয়েছে, সমন্বয় ঘটেছে; তবে এগুলো সবসময় সবজায়গায় কখনো একরৈখিক ছিল না। স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, সমন্বিত হয়েছে। ধীরে ধীরে বহুঈশ্বরবাদ থেকে আবার একেশ্বরবাদে পৌঁছেছে। এখন সময় এসেছে ধর্মীয় একেশ্বরবাদকে ছেঁটে ফেলে নিরীশ্বরবাদের দিকে যাত্রা শুরু করার। এগুলো আজ নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত সত্য। বর্তমানে প্রচলিত একেশ্বরবাদ বা বহুঈশ্বরবাদের ধর্মীয় শাস্ত্রগুলো কঠোর পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে রচিত, যেখানে নারী নরকের কীট। শাস্ত্রগুলি স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েই রেখেছে, নারী পুরুষের অধীন, নারী শয়তানের বেশ ধরে আসে, শয়তানের বেশ ধরে যায়! নারীর কোনো গুণ নেই, তার কাজ শুধু পুরুষদের দূষিত করা ইত্যাদি। বাইবেলে ঈশ্বর বলেন, তিনি তার মতো করেই মানুষ সৃষ্টি করছেন (God created man in his own image) (জেনেসিস, ১:২৭)। কিন্তু তৌরাত, ইঞ্জিল, বেদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, কোরান ইত্যাদি বর্তমানে প্রচলিত তথাকথিত ধর্মীয় শাস্ত্রগুলো নির্মোহভাবে পাঠ করলে বোঝা যায় এগুলো চরম পিতৃতান্ত্রিকতার ধ্বজাধারী পুরোহিত-মোল্লা-পাদ্রিরাই ‘ভগবান’, ‘ঈশ্বর’, ‘আল্লাহ’, ‘গড’-এর মুখ দিয়ে তাঁদের নিজস্ব চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন। নিজেরা যেভাবে জগতকে দেখতেন, বিচার করতেন, তেমনি কায়েমী স্বার্থ রক্ষা করার তাগিদ থেকে হোক কিংবা নিজের উদরপূর্তির জন্যই হোক, অথবা নিজের ভয়-ভক্তি-বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে সৎ উদ্দেশ্য থেকেই হোক, তারা শাস্ত্রগুলোর বক্তব্যকে ‘সৃষ্টিকর্তা’, ‘সর্বশক্তিমান’ ঈশ্বরের নামে রটিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। যে ধর্ম ছিল একসময় মানুষের কল্পিত আশ্রয়, হতাশ মানুষদের নিরাপত্তার আচ্ছাদন, সভ্যতার আলো না-পাওয়া, যুক্তি-বিবেকের সমন্বয় ঘটাতে না-পারা কতিপয় দুর্বল মানুষের ভ্রান্ত অবলম্বনমাত্র; সেই ধর্মই আজকের যুগে গোটা সমাজের জন্য দানবরূপে দেখা দিয়েছে। শোষিত মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে, ধর্মকে শাসকগোষ্ঠীর সর্বনাশা ব্যবহার আর বোকার স্বর্গে বাস করা কতিপয় কাণ্ডজ্ঞানহীন (কিংবা শাসকগোষ্ঠীর সহযোগী অতি ধুরন্ধর) লোকের তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা-চর্চার দ্বারা ধর্ম আজ গোটা মানবজাতির জন্যে এক বিরাট বিষবৃক্ষ। গোটা ধর্মটাই ‘মৌলবাদ’ আর ‘রাজনীতি’র মিশেলে তৈরি; এই দুটি ধারণা ব্যতীত পৃথিবীতে কোনো ধর্মের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া বর্তমানে দুষ্কর এবং তা কোনো ধর্ম থেকেই কোনোকালে বিচ্ছিন্ন ছিল না। ফলে অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই সৃষ্টি হয়েছে নানা মতভেদ, নানা বিভ্রান্তি, নানা বিদ্বেষ। নিজ নিজ ধর্মের প্রসার আর তালুক দখলের লোভ সবই একসূত্রে গাঁথা; যা মানুষে-মানুষে শুধু জিঘাংসাই বৃদ্ধি করেছে। ধর্মগুলো তাদের নিজস্ব গ্রন্থে (যেমন হিন্দুদের বেদ, মনুসহিংতা, গীতা ইত্যাদি, ইহুদিদের ওল্ডটেস্টামেন্ট, খ্রিস্টানদের ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট, মুসলমানদের কোরান-হাদিস) যেসকল সদাচার-ধর্মাচারের সুনির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট বয়ান দিয়েছে, তা’ই আজকের যুগে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল উৎস। ধর্মবাদীদের দৃষ্টিতে সেখান থেকে এক চুল পরিমাণ নড়বার উপায় নেই! প্রতিটি ধর্মই কর্তৃত্ববাদ বা প্রভুত্ববাদ (Authoritarianism)-এর পরিচায়ক। এক ধর্মের সাথে আরেক ধর্মের এই যে এতো মতভেদ-বিভেদ বিদ্যমান, এগুলোকে মনীষী রাহুল সাংকৃত্যায়ণের ভাষায় চিহ্নিত করা যায় এভাবে :

“একজন যদি পুবমুখো হয়ে পূজার বিধান দেয় তো অন্যজন পশ্চিমে। একজন মাথার চুল বড়ো রাখতে বলে তো অন্যজন দাড়ি। একজন গোঁফ রাখার পক্ষে তো অন্যজন বিপক্ষে। একজন পশুর কণ্ঠনালী কাটার নিয়মের কথা বলে তো অন্যজন মুণ্ডচ্ছেদ করতে বলে। একজন জামার গলা ডানদিকে রাখে তো অন্যজন বাঁ-দিকে। একজনের যদি এঁটোকাঁটার বাছ বিচার না থাকে তো অন্যজনের নিজের জাতের মধ্যেও তেরো হাড়ি। একজন পৃথিবীতে শুধু খোদার নাম ছাড়া আর কিছু থাকতে দিতে রাজি নয় তো আর-একজনের দেবতার সংখ্যা অগণিত। একজন গো-রক্ষার জন্য জান দিতে রাজি তো অন্য জনের কাছে গো কোরবানি অত্যন্ত পুণ্যের কাজ।” (দ্রষ্টব্য : তোমার ক্ষয়, পৃষ্ঠা ২০)।

‘বাংলাদেশের সক্রেটিস’ হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তার বিখ্যাত প্রবচনগুচ্ছে বলেছিলেন, “হিন্দুরা মূর্তিপূজারী; মুসলমানরা ভাবমূর্তিপূজারী। মূর্তিপূজা নির্বুদ্ধিতা; আর ভাবমূর্তিপূজা ভয়াবহ।” অধ্যাপক আজাদ মুসলমানদের ভাবমূর্তিপূজারী হিসেবে অভিহিত করলেও আরো অনেক আগেই আরবের (উত্তর সিরিয়া) অন্ধকবি আবু-আল-আলা আল মারি (৯৭৩-১০৫৭) তাঁর ‘লুজুমিয়াত’ কাব্যে মুসলমানদের হজের সময় কাবা শরিফকে বাঁ দিকে রেখে ডাইনে থেকে বাঁয়ে সাতবার প্রদক্ষিণ করা, কালো পাথরে চুম্বন বা মাথা নোয়ানো, সাফা-মারওয়া পর্বতের মাঝখানে দৌড়াদৌড়ি করা, মিনাতে ‘শয়তান’ লক্ষ্য করে পাথর মারা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে ইসলামের (মুসলমানদের) ‘পৌত্তলিক ভ্রমণ’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। ধর্ম কিংবা ধর্মবাদীদের কাছে একজন ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতার মূল্য অত্যন্ত গৌণ; গুরুতর গর্হিত কাজ! গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চাতো ধর্মবাদীদের কাছে ঈশ্বরদ্রোহের সমতুল্য! আজকের যুগেও স্বাধীনতার সংজ্ঞা এখানে নির্ধারিত হয় কিংবা নিয়ন্ত্রিত হয় কতিপয় প্রাগৈতিহাসিককালের ধ্যান-ধারণাকে অবলম্বন করে। বসে থাকা অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মোল্লা-পুরোহিতরা, একজন সাধারণ ব্যক্তির নিজস্ব বোধ-অনুভূতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেন প্রতিনিয়ত, কিংবা চাপিয়ে দিতে চান নিজেদের মত। কোনো ব্যক্তির জন্মের পর থেকে তার কী নাম হবে, সে কী কাপড় পরবে, কাপড় কতটুকু লম্বা হবে, গোড়ালির উপর উঠবে কি উঠবে না, মাথায় টুপি না টিকি দিবে, সে কী খাবে, গরু না শূকরের মাংস, কাকে বিয়ে করবে, কীভাবে করবে, কোন্ জাত-গোত্র-বর্ণের সাথে আত্মীয়তা হবে, তার সন্তানকে মসজিদ-মাদ্রাসা না গীর্জা মন্দিরে পাঠাবে, সে মারা গেলে সৎকার কীভাবে হবে, কবর দেয়া হবে, না আগুনে পোড়ানো হবে ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত বক্তব্যই ধর্মবাদীদের কাছে একমাত্র অনুসরণ ও অনুকরণের বিষয়; এর বাইরে কোনো ভিন্নমত কোনোভাবেই বরদাশত যোগ্য নয়।

আজ থেকে অনেক আগে রোমান দার্শনিক-রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত লুসিয়াস আনায়েউস সেনেকা (৪ খ্রিস্টপূর্ব-৬৫ খ্রিস্টাব্দ) ধর্মের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন এভাবে :

“সাধারণ মানুষের কাছে ধর্ম সত্য বলে বিবেচিত, জ্ঞানীর কাছে মিথ্যে আর শাসকগোষ্ঠীর কাছে তা শোষনের হাতিয়ার।” আমাদের প্রাচীন ভারতের লোকায়ত দার্শনিক চার্বাকবাদীরা প্রকাশ্যেই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা প্রচারিত ঈশ্বর-স্বর্গ-নরক-আত্মা-পাপ-পূন্য-যজ্ঞ ইত্যাদির বিরোধিতা করে বলতেন: “ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৈাকিকঃ/নৈব বর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকাঃ”। অর্থাৎ, “স্বর্গ বলে কিছু নেই; অপবর্গ বা মুক্তি বলেও নয়, পরলোকগামী আত্মা বলেও নয়। বর্ণাশ্রম-বিহিত ক্রিয়াকর্মও নেহাতই নিষ্ফল।” (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা ১৬-১৭) তারা আরো বলতেন; “যাদের না-আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মুরোদ, তাদের জীবিকা হিসাবেই বিধাতা যেন সৃষ্টি করেছেন অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, তিন বেদ, সন্নাসীদের ত্রিদণ্ড, গায়ে ভষ্মলেপন প্রভৃতি ব্যবস্থা; চোরেরাই মাংস খাবার মতলবে যজ্ঞে পশুবলির বিধান দিয়েছেন; ব্রাহ্মণদের জীবিকা হিসেবেই মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে (শ্রাদ্ধাদি) প্রেতকার্য বিহিত হয়েছে। তাছাড়া এসবের আর কোনো উপযোগিতা নেই। যারা তিনবেদ রচনা করেছেন তাঁরা নেহাতই ভণ্ড, ধূর্ত ও চোর। জর্ফরীতুর্ফরী প্রভৃতি অর্থহীন বেদমন্ত্র ধূর্ত পণ্ডিতদের বাক্যমাত্র।”

বৈদিক ধর্ম ও ব্রাহ্মণ সম্পর্কে চার্বাকবাদীদের এরকম চাঁছাছোলা সমালোচনার কারণেই আমরা রামায়ণ-মহাভারতে পাই চার্বাকদের ‘রাক্ষস’, ‘দুর্বৃত্ত’, ‘কূটকৌশলী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে নানাভাবে হেনস্থা করার কথা; তাদের বইপত্র পুড়িয়ে ফেলা, সমুদ্রে নিক্ষেপ করা, চার্বাকবাদীদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা ইত্যাদি। প্রতিটি ধর্মের ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, তাদের স্ব-স্ব ধর্মীয়-সমালোচকগনকে কী নির্দয়ভাবে দলন, দমন পেষণ করা হয়েছে এবং আজ ও করা হচ্ছে। রোমান সম্রাট সেনেকার বক্তব্য থেকে আরো স্পষ্টভাবে খোলাখুলি বলেছেন, হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবের গুরু ভীষ্ম; তিনি বলেন :

“রাজাদের পক্ষে ধর্মকর্মের অনুষ্ঠানই লোকসাধারণকে বশীভূত রাখার শ্রেষ্ট উপায়। রাজদণ্ডের প্রভাবেই পৃথিবীতে ধর্মের প্রচার সম্ভব হয়েছে। রাজার দণ্ডনীতি না থাকলে বেদ ও সমুদয় ধর্ম এক কালে বিনষ্ট হয়ে যায়। রাজধর্মের প্রাদুর্ভাব না থাকলে কোনো মানুষই নিজ ধর্মের প্রতি আস্থা রাখে না।” (দ্রষ্টব্য: ধর্মের ভবিষ্যৎ, পৃষ্ঠা ১১০ (মহাভারতের শান্তিপর্ব, ১২/৫৮-৫৯, ১২/৬৩))।

রাজদণ্ডের সাথে ধর্মপ্রচারের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, যেসকল ধর্ম রাষ্ট্র- ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে বা ধর্মবাদীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ণ ঘটেছে, কিংবা রাষ্ট্র বা শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, তারাই আজ প্রবল বিক্রমে বেঁচে রয়েছে; আর যারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পারেনি তাদের ইতিহাস বা বর্তমান অবস্থা জানতে আজ আমাদের মিউজিয়ামে যেতে হয়! আলোচনার পরিসর সীমিত রাখার স্বার্থে আমরা এখানে সংক্ষেপে হিন্দু ধর্মবাদীদের ক্ষমতায়ণের ধারাটি জেনে নেই : এখন পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান থেকে জানা যায়, হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক আর্যরা মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব পনেরশো শতাব্দীর দিকেই ইরান-আফগানিস্তান অঞ্চল থেকে ভারতীয় অঞ্চলে আসে এবং আস্তে আস্তে এ অঞ্চলের আদি অধিবাসী ভূমিপুত্র অনার্যদের (শূদ্র) হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে শুরু করে, এবং একসময় তারা সফল হয় প্রচার করতে, বেদভিত্তিক বৈদিক ধর্ম। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর দিকে সম্রাট অশোক (২৬৪-২৩৮ খ্রিস্টপূর্ব) রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তৃতি ঘটলে, বৈদিক ধর্মের সাথে তীব্র দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। মৌর্য বংশের পতন, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সুঙ্গ বংশের অভ্যুত্থান এবং খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী সাতবাহন এবং গুপ্ত রাজাদের রাষ্ট্রীয় সমর্থন-পৃষ্ঠপোষকতা এবং ব্রাহ্মণ শ্রেণীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান ত্বরান্বিত হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে সেনরাজারা হিন্দুধর্মের গাছে জল-সার দিয়ে চাষাবাদ করেছেন। কিন্তু যখন রাষ্ট্রশক্তি পুনরায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী আফগান-তুর্কিদের হাতে চলে যায় তখন আবার হিন্দু ধর্মটি অস্তিত্বের সংকটে ভোগতে শুরু করে। পরে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে মুসলমানদের হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে কিছুটা হলেও প্রাণশক্তি ফিরে পায় ব্রাহ্মণ্যবাদের দোসর এই ধর্ম। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতে প্রকাশ্যে এবং পরোক্ষভাবে সুবিধা পেয়ে চলছে হিন্দু ধর্মটি!

ধর্ম আর ধর্মবাদীদের ব্যাপারে ‘মানবজাতির বিবেক’ বলে পরিচিত ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের (১৬৯৪-১৭৭৮) একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। দার্শনিক ভলতেয়ার বলেন : ‘The first clergyman was the first sly rogue that met the first fool…, অর্থাৎ পৃথিবীর প্রথম পুরোহিত বা মোল্লা ব্যক্তিটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ধূর্ত বাটপাড়, যার মোলাকাত হয়েছিল প্রথম বোকা-নিবোর্ধ ব্যক্তিটির সঙ্গে; বাটপাড় ব্যক্তিটি নির্বোধ ব্যক্তিকে বুঝিয়ে-পাড়িয়ে নিজের অনুগত প্রথম ভক্ত বানিয়ে ফেলে। ক্রমে পুরোহিত তথা ধর্মযাজকেরা নতুন নতুন সুযোগ বুঝলো—সৃষ্টি হল পুরোহিততন্ত্র (Priestcraft); তারা সহজ সরল মানুষের অন্ধবিশ্বাসের সুযোগে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা উৎকৃষ্টতা ও ডিভিনিটি দাবি করলো। মানুষ তাদের দাবি মেনে নিল, সঙ্গে সঙ্গে ধর্মযাজকেরা উৎপাদনশ্রম থেকে রেহাই পেল। পুরুষ মৌমাছি (Drone) মধুমক্ষিকার মতো তারা সাধারণের কষ্টার্জিত সম্পদ শুয়ে-বসে ভোগ করতে লাগলো। মানুষের ধর্ম-বিশ্বাস, দুর্বলতা, বিশ্বাসপ্রবণতা, সরলতা ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে যুগে যুগে অনাচার, রক্তপাত, ডাইনি শিকার, শোষণ, নিপীড়ণ প্রভৃতির মহড়া চালিয়ে আসছে তথাকথিত ডিভিনিটির দাবিদার ডিভিন পুরোহিতেরা।” (দ্রষ্টব্য : পার্থিব জগৎ, পৃষ্ঠা ১২৭)। খ্রিস্টধর্ম, পুরোহিত শ্রেণী ও রোমান ক্যাথলিক চার্চকে লক্ষ্য করে ভলতেয়ারের একটি বিখ্যাত স্লোগান ছিল এরকম, “এই কুখ্যাত বস্তুটাকে গুড়িয়ে দাও!” (Crush the Infamy!)| শুধু ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার নয়, পৃথিবীর অনেক দার্শনিক, চিন্তাবিদ, মনীষী, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি যুক্তিসঙ্গত কারণে কঠোর ভাষায় ‘ধর্ম’কে আক্রমণ করেছেন। ইউরোপের অষ্টাদশ শতকের জ্ঞানবাদী আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতা Baran D Holbach (১৭২৩-১৭৮৯) বলেছিলেন : ‘We find in all the religions of the earth, ‘a God of armies’, ‘a jealous God’, ‘an avenging God’, ‘a destroying God’, ‘a God who is pleased with Carnage’… এ জ্ঞানবাদী আন্দোলনের অসীম সাহসী নেতা ও পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত ডেনিস দিদেরো (১৭১৩-১৭৮৪) পোপ তৃতীয় ক্লেমেন্ট রাষ্ট্রের প্রবল বাধা অতিক্রম করে ষোল খণ্ডে পৃথিবীর প্রথম বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপেডিয়ার সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। দিদেরো মনে করতেন, “ধর্মের প্রতি যেকোনো ধরনের সহানুভূতি প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের সঙ্গে আপোষেরই নামান্তর।” (দ্রষ্টব্য : ধর্মের ভবিষ্যৎ, পৃষ্ঠা ১৬১)। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির দিশারী-বস্তুবাদী দার্শনিক মনীষী কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) ইউরোপের ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) আইনের দর্শনের পর্যালোচনার ভূমিকাতে বলেন : “ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, ঠিক যেমন সেটা হল আত্মবিহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম। মানুষের মায়াময় সুখ হিসেবে ধর্মকে লোপ করাটা হল মানুষের প্রকৃত সুখের দাবি করা। বিদ্যমান হালচাল সম্বন্ধে মোহ পরিত্যাগ করার দাবিটা হল যে-হালচালে মোহ আবশ্যক, সেটাকে পরিত্যাগ করার দাবি। তাই ধর্মের সমালোচনা হল ধর্ম যার জ্যোতির্মণ্ডল সেই অশ্রু উপত্যকার (এই পার্থিব জীবনের) সমালোচনার সূত্রপাত।” (দ্রষ্টব্য : ধর্ম প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা ৩১-৩২)। ‘ঈশ্বর মৃত’ (God is dead) ঘোষণাকারী হিসেবে খ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রাহিদ্রিশ ভিল্হ্লেম নীট্শে (১৮৪৪-১৯০০) বলেন: “যারই ধমনীতে ধর্মতাত্ত্বিকের রক্ত আছে তিনি একেবারে প্রথম থেকেই সবকিছুর প্রতি ভ্রান্ত ও অসৎ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।… ধর্মতাত্ত্বিক যাকে সত্য বলে মনে করেন তা অবশ্যই মিথ্যা; এটিই সত্যতা নির্ণয়ের একটি মাপকাঠি।” এলবার্ট হিউবার্ট (১৮৫৯-১৯১৫) বলেন : “ধর্মতত্ত্ব হলো কিছু লোকের একটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা, যে বিষয়টি তাঁরা বোঝেন না। সত্য কথা বলা ধর্মতাত্ত্বিকদের উদ্দেশ্য নয়, ধর্মানুসারীদের খুশী করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।” (দ্রষ্টব্য : পার্থিব জগৎ, পৃষ্ঠা ১৭)। আলবেয়ার কাম্যু (১৯১৩-১৯৬০) তাঁর ‘The Rebel’ গ্রন্থে বলেন : ‘One must learn to live and to die and in order to be a man, to refuse to be a God’. (অর্থাৎ একজনকে বাঁচা এবং মরার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং মানুষের মতো বাঁচতে হলে ঈশ্বরকে অস্বীকার করতেই হবে।) ভারতীয় বস্তুবাদী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ণ (১৮৯৩-১৯৬৩) ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব’ সম্পর্কে বলেন :

“অজ্ঞানতার অপর নাম ঈশ্বর”। আমরা আমাদের অজ্ঞানতাকে স্বীকার করতে লজ্জা পাই এবং তার জন্য বেশ ভারী গোছের একটা নামের আড়ালে আত্মগোপন করি। সেই ভারী গোছের আড়ালটির নামই ঈশ্বর। ঈশ্বর বিশ্বাসের আরও একটি কারণ হল বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের অপারগতা ও অসহায়ত্ব। …অজ্ঞানতা আর অসহায়ত্ব ছাড়া আর কোনো কারণ যদি ঈশ্বর বিশ্বাসের পিছনে থেকে থাকে তা হল ধনী ও ধূর্ত লোকদের নিজ স্বার্থ রক্ষার প্রয়াস। সমাজে চলতে থাকা সহস্র অন্যায় অবিচারকে বৈধতা দেবার জন্য তারা ঈশ্বরের অজুহাতকে সামনে এনে রেখেছে। …ঈশ্বর বিশ্বাস এবং একটি সহজ সরল ছোটো শিশুর নিজস্ব বিশ্বাস, বস্তুত একই। পার্থক্য শুধু এইটুকুই ছোটো শিশুটির যুক্তি ভাঙার, উদাহরণ ইত্যাদির পরিমাণ খুবই সামান্য, আর বড়োদের ওগুলো খানিকটা বিকশিত।” (দ্রষ্টব্য : তোমার ক্ষয়, পৃষ্ঠা ৩৫)।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার, এ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বোকার স্বর্গ’। এই শিরোনাম দেখে ধর্মবিশ্বাসীদের উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ এর দ্বারা ধর্মবিশ্বাসীদের কোনোভাবেই বোকা বা নির্বোধ বলা হচ্ছে না। ‘বোকার স্বর্গ’ বলতে বোঝানো হচ্ছে শুধু ‘ধর্ম’ নামক ব্যবস্থাকেই; যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ঈশ্বর/আল্লাহ/ভগবান ইত্যাদি ধারণা, উপাসনার নিয়ম-নীতি, রীতি-নীতি, বৈশিষ্ট্য, প্রথা ইত্যাদি। সোনার পাথর বাটি বা অশ্বডিম্ব যেমন অসম্ভব, তেমনি ধর্ম নামক সিস্টেমটি সমাজের জন্য মঙ্গলময়, কল্যাণকর ইত্যাদি মিথ্যে ধারণার খোলস উম্মুচন করে দেওয়ার জন্যই ‘বোকার স্বর্গ’ নামটি বেছে নেওয়া হয়েছে। এই ‘বোকার স্বর্গ’ ধর্ম নামক ব্যবস্থার কারণেই মানুষ কীরকম নির্বিবেক, অপরিণামদর্শী, কাণ্ডজ্ঞানহীন, অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে যায় তার ভুড়িভুড়ি উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলছে সুদীর্ঘকাল ধরেই। দু-একটি উদাহরণ দেয়া যাক: খ্রিস্টানরা চতুর্থ শতাব্দীর দিকে প্রাচীন প্যাগান (Pagan) জার্মানদের ‘সভ্য’ করার নামে, ধর্ম প্রচারের নামে গণহত্যা চালিয়েছিল বিভৎস পন্থায়। ঐ সময় কোনো কোনো প্যাগান জার্মান গোষ্ঠী ওক গাছের পূজা করতো। যদি ওক গাছ সভ্য! হওয়া জার্মানদের পুরানো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, আবার তাদের পথভ্রষ্ট করে ফেলে, সেজন্য খ্রিস্টধর্মাবলম্বী রোমান সৈন্যরা জার্মানিতে প্যাগানদের হত্যা করার পাশাপাশি একটি ওক গাছও আস্ত রাখেনি, কেটে সাফ করে দিয়েছিল! ধর্ম নামক ব্যবস্থা বলবৎ থাকার কারণে কিংবা ধর্মে বিশ্বাস রাখার কারণেই তো শিক্ষিত-অশিক্ষিত হিন্দুরা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞান ‘সিন্ধুকে তালা মেরে দিয়ে’ সাপের পূজা করে (মনসা দেবী), নদীর পূজা করে (গঙ্গা), গরুর পূজা করে, গরুকে নিজের মায়ের সঙ্গে তুলনা করে, গরুর মলমূত্র দিয়ে ঘরবাড়িসহ নিজেদের পবিত্র করে, বাঁদরের (হনুমান) পূজা করে! মুসলিমরা অন্য ধর্মের উপাসনার রীতিনীতিকে কঠোর ভাষায় নিন্দা-সমালোচনা করলেও নিজেদের বোধবুদ্ধি, জ্ঞানকে ‘বগলদাবা’ করে কোরান শরিফের বাণী অনুসরণ করে পরম পুণ্যের কাজ ভেবে প্রতি বছর সৌদি আরবে হজের সময় কাবা ঘরকে কেন্দ্র করে সাতবার প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ) করে, বহু শতাব্দী প্রাচীন ‘হজরে-আসওয়াদ’ বা কালো পাথরে (ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন, এটি একটি উল্কাপিণ্ড) আধ্যাত্মিক উল্লাস লাভের জন্য হুমড়ি খেয়ে চুমো খায়; হাজিদের কাছে এ-তো শুধু পাথরে চুমু খাওয়া নয়, নবী মুহাম্মদের হস্ত মুবারকেই চুমু খাওয়া! যদিও খলিফা ওমরের একটি বক্তব্য অনেক মুসলমানের জানা আছে; ওমর (রাঃ) একদা কাবা ঘরের ঐ কালো পাথরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন : “আমি জানি তুমি একটা পাথর ছাড়া কিছুই নও, মানুষকে সাহায্য করা বা ক্ষতি করার তোমার কোনো ক্ষমতা নেই। যদি আমি আল্লাহর রসুলকে না দেখতাম তোমায় চুম্বন করতে, আমি তোমাকে কখনো চুম্বন করতাম না; বরং কাবাঘর হতে বহিষ্কৃত করে তোমাকে দূরে নিক্ষেপ করতাম।” (দ্রষ্টব্য : ফাউন্ডেশন অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ৪১ এবং আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র ১, পৃষ্ঠা ১০৬)।

ধর্মের ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, একশ্বেরবাদী ধর্মগুলো সংগঠিত এবং বিস্তৃত হওয়ার পূর্বে মানুষ বিভিন্নভাবে প্রাক-ধর্মীয় ‘টোটেম-প্রথা’ (Totemism) অনুসরণ করতো। টোটেম অর্থ সাধারণভাবে বিশেষ প্রজাতির প্রাণী; তবে বিশেষ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং জড়বস্তুকেও টোটেম হিসেবে পূজা করা হয়; যেমন হিন্দুরা নির্দিষ্ট ধরনের কালো রঙের পাথরকে ‘শিবলিঙ্গ’ বানিয়ে পূজা করে। ইসলামপূর্ব আরবেও কাবা ঘরের এই পাথরকে পবিত্র মনে করা হতো, পূজা করা হতো। বর্তমানে হাজিদের কাবা শরিফে তাওয়াফের সময় পাথরে চুম্বন করা টোটেম-প্রথারই রূপান্তর মাত্র। হজের সময় হাজিরা মাথার চুল কামিয়ে ফেলেন, সাদা কাপড় (ইহরাম) পরিধান করেন, মক্কার কাবা ঘর থেকে কয়েকশো গজ দূরে সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা অঞ্চলে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন, মিনাতে কংক্রিটের তিনটি স্তম্ভকে ‘শয়তান’ বানিয়ে সাতবার করে মোট একুশটি ঢিল ছোঁড়েন। সেই ঢিলে আহত হয়ে এতোদিনে শয়তান মারা গিয়েছে কিনা জানা যায়নি, তবে শয়তানকে মারতে গিয়ে নিজেদের প্রচণ্ড অন্ধবিশ্বাস আর আবেগের আতিশয্যে সৃষ্ট হুড়োহুড়ির কারণে পদপিষ্ট হয়ে নিরীহ হাজিরা প্রায়শঃই মারা যান! ২০০৫ সালে ‘শয়তান’কে মারতে গিয়ে অর্ধশতাধিক বাংলাদেশিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তিনশতাধিক হাজি মারা গেছেন! হিন্দুরা প্রতি বছর দুর্গা পূজা কালী পূজাতে মহাধূমধামের সাথে পাঠা বলি দিয়ে থাকেন। বৃটিশ রাজত্বেই এই অঞ্চলে হিন্দু রাজা-জমিদারেরা এই দুই পূজাতে আয়োজন করে নরবলি দিতেন! বর্তমানে নরবলি দেওয়ার প্রথা রহিত হয়ে গেলে পূজা উপলক্ষে পাঠা বলি দেওয়া বেশ প্রচলিত। ইহুদি-খ্রিস্টান-ইসলামের ধর্মগ্রন্থ থেকে জানা যায়, আব্রাহাম বা ইব্রাহিম একটি স্বপ্ন দেখেই অন্ধের মতো নিজের সন্তানকে কোরবানি দিতে নিয়ে যান, তবে শেষমেশ ঐশীবাণী পেয়ে সন্তানকে কোরবানি না দিয়ে একটি দুম্বাকে কোরবানি দেন! আব্রাহামের এই বাণী-কর্মকে বিশ্বাস করে সারা বিশ্বের মুসলমানরা প্রতি বছর কোরবানির ঈদে লক্ষ লক্ষ নিরীহ পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। এতে তাদের মন বিন্দুমাত্র চিত্তবিচলিত হয় না, মনে কোনো সংশয় জাগে না; এ অপচয়-বাহুল্য ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। বাংলাদেশের অন্যতম লোকায়ত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর এ নিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রশ্ন তুলেছিলেন :

“কোরবানি প্রথার ভিত্তিমূল সুদৃঢ় নয়। একটি স্বপ্নের উপর ভিত্তি করিয়া প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ পশুর জীবন নষ্ট হইতেছে। উপন্যাসকে ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করিলে যেরূপ ভুল করা হয়, স্বপ্নের রূপককে বাস্তব বলিয়া গ্রহণ করিলে সেইরূপ ভুল হইতে পারে না কি?… বর্তমান কোরবানি প্রথায় পশুর কোনো সম্মতি থাকে কি? একাধিক লোকে যখন একটি পশুকে চাপিয়া ধরিয়া জবেহ করেন, তখন সে দৃশ্যটি বীভৎস বা জঘন্য নয় কি? মনে করা যাক, মানুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এক অসুর জাতি পৃথিবীতে আবির্ভূত হইয়া, তাহারা পুণ্যার্থে মহেশ্বর নামক এক দেবতার নামে জোরপূর্বক মানুষ বলি দিতে আরম্ভ করিল। তখন অসুরের খাঁড়ার (ছুরির) নীচে থাকিয়া মানুষ কি কামনা করিবে? ‘মহেশ্বরবাদ ধ্বংস হউক, অসুর জাতি ধ্বংস হউক, অন্ধ বিশ্বাস দূর হউক’―ইহাই বলিবে না কি?… কোরবানি প্রথায় দেখা যায় যে, কোরবানিতে পশুর হয় ‘আত্মত্যাগ’ এবং কোরবানিদাতার হয় ‘সামান্য স্বার্থত্যাগ”। দাতা যে মূল্যে পশু খরিদ করেন, তাহাও সম্পূর্ণ ত্যাগ নহে। কেননা মাংসাকারে তাহার অধিকাংশই গৃহে প্রত্যাবর্তন করে, সামান্যই হয় দান।… বলির পশুর আত্মোৎসর্গ না মাংসোৎর্গ? মাংস তো আহার করি এবং আত্মা তো ঐশ্বরিক দান। উৎসর্গ করা হইল কি?”

কতো সাধারণ প্রশ্ন অথচ কী তার গভীরতা। নৃতত্ত্ববিদ Robertson Smith তাঁর Religion of The Semites গ্রন্থে দেখিয়েছেন, পশু কোরবানি প্রথার মূলে রয়েছে মানুষের টোটেম-প্রথার অনুসরণ। বিশেষ অনুষ্ঠানে বা উৎসবে টোটেম প্রাণীকে হত্যা করে তাকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করার রীতি বিভিন্ন ধর্মে বেশ প্রচলন রয়েছে। প্রাক ইসলামি আরব-সমাজেও পশু ও মানুষ কোরবানির ব্যাপক প্রচলন ছিল; কিন্তু, সমাজ বিকাশের সাথে-সাথে এবং সামাজিক প্রয়োজনে ‘মানুষ’ কোরবানির রীতি ধীরে ধীরে রহিত হয়ে গেছে কিন্তু আদিম সংস্কৃতির কিছু কিছু অবশেষ যেমন পশু কোরবানির প্রথা এখনো টিকে রয়েছে। Samuel M. Zwemer তাঁর The Influence of Animism on Islam: An account of Popular Superstitions গ্রন্থে অত্যন্ত চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন মুহাম্মদ একেশ্বরবাদের চর্চার অংশ হিসেবে ইসলাম ধর্ম তৈরি এবং প্রচার করলেও সম্পূর্ণরূপে সফল হতে পারেননি; তিনি সময় এবং পরিবেশ দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। ইসলাম ধর্মের প্রচুর উপাদান যেমন নামাজ পড়ার রীতি, সন্তান জন্মের পর আকিকা করা, শয়তান-ফেরেশতা-জীনের ধারণা, হজ, কোরবানি ইত্যাদি সর্বপ্রাণবাদী (Animist) রীতি ইসলাম পূর্ব আরবে বহুল প্রচলিত ছিল এবং এগুলো মুহাম্মদ দু’হাতে ইসলামে আত্তীকরণ ঘটিয়েছেন; আবার কিছু কিছু বাদও দিয়েছেন। ইসলামপূর্ব আরবে সার্বিয়েনরা ছিল নক্ষত্র পূজারী, হিমিয়ারবাসীরা সূর্যের উপাসনা করতো, আসাদ ও কিয়ানা গোত্রের লোকেরা ‘আল্লাত’ দেবী হিসেবে চন্দ্রের, ‘মানাত’ দেবী হিসেবে ভেনাসের (শুক্র গ্রহ) ও ‘উজ্জা’ দেবী হিসেবে সাইরিয়াসের (লুব্ধক নক্ষত্র) পূজা করতো। কোরানে আমরা দেখি, সুরা নজমে স্পষ্টভাষায় বলা হয়েছে, তিনি শিরা নক্ষত্রের মালিক That He is the Lord of Sirius (the Mighty Star) “আল্লাহ সাইরিয়াসের প্রভু।” (সুরা নজম ৫৩, আয়াত ৪৯)। অনেকগুলির সুরার নামকরণ হয়েছে প্যাগান দেব-দেবীর নামে, যেমন : সুরা ৮৬ ‘তারিকা’ নক্ষত্র দেবতার নাম, সুরা ১১০ ‘নসর’ প্রাচীন আরব্যগোষ্ঠী হিমিয়ারদের দেবতার নাম, সুরা ৯১ ‘শামস্’ মধ্যপ্রাচ্যে এক সময় ব্যাপকভাবে পূজিত সৌরদেবীর নাম।

আজকের যুগে কোরবানির জন্য কেউ কেউ অজুহাত খাড়া করেন, এই কোরবানির ফলে নাকি গরীবের মাংস চাহিদা মিটবে কিছুটা হলেও। সারা বছর খোঁজ নেই, আর বছরে একবার মাংস খেয়ে গরীবেরা তাদের শরীরের প্রোটিন-চাহিদা মিটিয়ে ফেলবে। আরো বলা হয়, মুসলিমদের রোজা কিংবা হিন্দুদের উপবাসের কথা। এ নিয়ে উভয় ধর্মাবলম্বীরা প্রায় সমার্থক ‘বৈজ্ঞানিক যুক্তি’ প্রদান করে থাকেন। মুসলিম বুজুর্গরা আমাদের জ্ঞান দেন, বছরে একমাস দিনের বেলায় উপবাসী থাকা (সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য-পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকা) স্বাস্থ্যপ্রদ এবং সে কারণে ইসলাম ধর্মের এই বিধান ‘বিজ্ঞানসম্মত’। এমনও প্রচার আছে যে, রোজা রাখলে নাকি পেটের আলসার (পেপটিক আলসার, যা মূলত খাদ্যগ্রহণের অনিয়ম থেকে হয়) সেরে যায়! এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক ‘গুজব’ সম্পর্কে ডা. মনিরুল ইসলাম তাঁর ‘বিজ্ঞানের মৌলবাদী ব্যবহার’ গ্রন্থে বলেছেন :

“রোজাকে মোটা দাগে স্বাস্থ্যপ্রদ বলা মোটেও সঠিক নয়। মানুষের যে জৈবিক ঘড়ি (Biological Clock) থাকে, রোজার সময় তার হেরফের হয় এবং শরীরে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, অবশ্য অধিকাংশ মানুষের শরীর এই অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। দিনের বেলায় মানুষ যখন জেগে থাকে এবং কাজ করে তখন শরীরে ক্ষয়মূলক অপচিতির (Catabolism) মাধ্যমে প্রচুর ক্যালরি (শক্তি) নির্গত হয়। এ সময় বিশেষত যারা কায়িক পরিশ্রম করেন তাদের পক্ষে খাদ্য গ্রহণ না করা মোটেও স্বাস্থ্যপ্রদ নয় বরং স্বাস্থ্যহানিকর। বলা হয়, রোজার সময় খাদ্যনালী বিশ্রাম লাভ করে এবং সবল হয়ে ওঠে। এটি কোনো পরীক্ষিত ব্যাপার নয়। দীর্ঘ উপবাস (৮ ঘণ্টার উপরে) অন্ত্রের আলসার বা ঘা বাড়িয়ে তোলে। কিছু কিছু পেটের রোগে সাময়িক উপবাস চিকিৎসার একটি অঙ্গ কিন্তু সে সব রোগগ্রস্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক মানুষের সাথে তুল্য নয়। এবং এদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাদ্যপুষ্টি ও ঔষধ শিরার মাধ্যমে প্রদান করা হয়ে থাকে” (‘বিজ্ঞানের মৌলবাদী ব্যবহার’ পৃষ্ঠা ৩০-৩১)।

চলবে-

২য় পর্ব-