গণরায়-২০০৮
গণমানুষের সরকার ও যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশা
হোসাইন কবির


 

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঐতিহাসিক গণরায়ে বাঙালি উদ্ধুদ্ধ হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে। একাত্তরের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করেছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, লাল সবুজের পতাকা। বিজয়ের ৩৮ তম বর্ষে বিজয়ের মাসে সেই বাঙালির নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত রায় – আরেক মহান বিজয়ের সূচনাপর্ব। সূচনাপর্ব এ কারণেই যে, একে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাবার গুরুদায়িত্ব দেশের আপামর জনগণ অর্পণ করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক দলকে, ২৯ ডিসেম্বরের ভোট যুদ্ধের মাধ্যমে।


এদেশের আপামর জনগণ শ্রেণীভেদ ভুলে একাত্তরে যেমনি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক মহান লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ২০০৮ এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তেমনি এদেশের মানুষ ভোট যুদ্ধে রায় দিয়েছে Ñ একটি যথার্থ অর্থে সাম্প্রদায়িক শক্তিমুক্ত, শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন মুক্ত, অন্যায়-অবিচার-মিথ্যাচার মুক্ত, অপশাসন-দু:শাসন-সন্ত্রাস-দুর্নীতি মুক্ত এবং যুদ্ধাপরাধী মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য। এসব প্রত্যাশার পক্ষে দেশের নানা শ্রেণীর ও পেশার মানুষ ছিল দীর্ঘদিন থেকে সোচ্চার। এতে দেশের সাধারণ মানুষ উদ্ধুদ্ধ হয়েছেন এবং এর পক্ষে তাদের মূল্যবান রায়ও প্রদান করেছেন। তাঁরা তাঁদের এ প্রত্যাশার যৌক্তিক বাস্তবায়ন আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা অধিষ্ঠিত হবেন, তাদের মাধ্যমে দেখতে চাইবেন; এ চাওয়াটাই স্বাভাবিক।


উল্লেখ্য যে, ২০০৮-এর এ ভোট বিপ্লবের নায়কগণ, চিরচেনা পল্লীবাংলার আপামর জনগণ। অর্থাৎ তাঁরাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ট অংশ। তাই সচরাচর মুষ্ঠিমেয় কিছু মুখচেনা নেতা-কর্মী, চাটুকার আমলা, আত্মীয়-স্বজন-নিকটজনের ভীড়ে এ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবদান ধূসর বিবর্ণ হয়ে যায়। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার বিষয়কে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্বের বিবেচনায় নিতে হবে। তার জন্য করণীয় উদ্যোগ আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালকদের নিতে হবে। নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার লক্ষে রাজনৈতিক দলের নেতাগণ জনগণের মন জয় করতে তাঁদের অনেক আশার বাণী শোনান, স্বপ্ন দেখান; নির্বাচিত হবার পর নেতারা তা বেমালুম ভুলে যান। আর তার মাশুলও কিন্তু নেতাদের দিতে হয়, তার নজিরও রয়েছে অসংখ্য। সুতরাং যে কথা মুখে বলা হচ্ছে তার বাস্তবে রূপায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। হয়ত কোন পরিবর্তন রাতারাতি হওয়া সম্ভব নয় কিন্তু পরিবর্তনের লক্ষে পথা চলা শুরু করতে হবে; আর তা জনগণকে সাথে নিয়ে, জনগণকে জানিয়ে এবং জনগণের প্রদত্ত গণরায় ও প্রত্যাশার আলোকে হওয়া বাঞ্চনীয়।


এদেশের অধিকাংশ মানুষের চাহিদা একটু শান্তিতে থাকা, নির্বিঘেœ জীবন যাপন করা। তাদের চাহিদা কখনও আকাশ ছোঁয়া নয়। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পড়ে নিরাপদ জীবন যাপনই তারা রাষ্ট্রের নিকট প্রত্যাশা করে। যাদের চাওয়া আকাশ ছোঁয়া- তারা সংখ্যায় নগণ্য মুষ্ঠিমেয়। সাধারণ মানুষ থেকে তারা দূরে অবস্থান করেন, তারা অবস্থান করেন ক্ষমতা কেন্দ্রের চারপাশে। এই ক্ষমতা কেন্দ্রের চারপাশে যারা অবস্থান করেন তাদের স্বার্থপরতা লোভ লালসার নিকট দেশের অধিকাংশ মানুষ বারবারই হেরে যান। আর এতে যে গোটা জাতিই কার্যত হেরে যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশাল বিজয়ের মাধ্যমে বিশাল প্রত্যাশা ও দায়িত্বভারের বোঝা কাঁধে নিয়ে যারা সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন তাঁদের অবশ্যই এদেশের আপামর অধিকাংশ মানুষের চাওয়া পাওয়ার বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে, যদি তাঁরা তা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে দেশের অধিকাংশ মানুষও একদিন তাঁদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং প্রত্যাখ্যান করবে।


জাতীয় সংকটে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই জাতীয় পর্যায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, জাতিকে বিজয়ী করেন, জাতিকে সমূহ বিপর্যয় থেকে উদ্ধারে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা শাসক গোষ্ঠীর নিকট এ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছেন; আর গোটা জাতির অর্জন প্রায়শই হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে মুষ্ঠিমেয় কিছু সংখ্যক মানুষের নিতান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থে নিমিত্তে। ক্ষমতা আর অর্থ-বৈভব এদের চারপাশে যে দম্ভ অহমিকার দেয়াল নির্মাণ করে, যা অতিক্রম করে সাধারণ মানুষ এদের নিকট যেতে পারেন না।


অতীতে রাষ্ট্রের অনেক উদ্যোগ আয়োজনই সাধারণ জনগণের প্রত্যাশার পরিপূরক ছিলো না, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্রেণী-বৈষম্য দোষে দুষ্ট ছিলো। আমাদের শিক্ষা নীতি ও স্বাস্থ্য নীতি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দেশে বর্তমানে যে শিক্ষা নীতি ও স্বাস্থ্য নীতি অনুসৃত হচ্ছে তা বৈরিতাপূর্ণ ও বৈষম্যদুষ্ট। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ আয়োজন নেয়া হয়েছিলো, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন কখনই ঘটে নি। এ কারণে স্বাধীন রাষ্ট্র ও ক্ষমতা কর্তৃক প্রবঞ্চিত প্রতারিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নের কথা শুনে কিন্তু তা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতে পারে না। তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য, তাঁদের কল্যাণের জন্য, তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালক ও নীতি নির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।


একুশ শতকের চেলেঞ্জ মোকাবেলায় ক্ষুদা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে Ñ দেশের অধিকাংশ মানুষকে দারিদ্র্য অবস্থায় ফেলে রেখে কিংবা আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ায় পশ্চাতে ফেলে একটি রাষ্ট্র কখনই কোন অবস্থায়ই সম্মুখে এগুতে পারবে না, এগুনো সম্ভব নয়। আমাদের অতীত তাই স্বাক্ষ্য দেয়। তাই আমরা উন্নয়ন ও পরিবর্তনের যে আওয়াজ তুলছি তার মুখ্য কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের কল্যাণ চিন্তার বিষয়টি থাকতে হবে। তাদের এগিয়ে নেবার লক্ষে নীতি-সিন্ধান্ত-পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী স্বার্থকে চরিতার্থ করতেই যদি অতীতের মত বারবার আপামর অধিকাংশ জনগণকে প্রয়োজনের সময় দাবার গুটি মতো ব্যবহার করা হয় তা হলে আজকের নবম জাতীয় সংসদের এ বিজয়ও অর্থহীন হয়ে পড়বে। রাষ্ট্রকর্তৃক প্রবঞ্চিত প্রতারিত অধিকাংশ মানুষ রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর তাতে দেশকে গ্রাস করবে রাজনীতিহীনতা। যা কোনভাবে কাম্য হতে পারে না।


জনগণ এবার ভোটযুদ্ধে যে রাজনৈতিক পক্ষকে ‘না’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন, জনগণের সেই প্রত্যাখ্যানের বিষয়কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, এবারের ভোটযুদ্ধে এ দেশের মানুষ শুধুমাত্র একাত্তরের প্রত্যক্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ‘না’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন নি, বরং একই সাথে ‘না’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন এ সব অপরাধীদের প্রত্যক্ষ সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষণকারী দলের নেতাকর্মীদেরও। তার প্রমাণ ভোটযুদ্ধের ফলাফল। উল্লেখ্য যে, এবার যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গে এ দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষণকারীদেরও নব্য রাজাকার আলবদর কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের সাথেই সংশ্লিষ্ট বলেই চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। মানুষের এ প্রয়াস এবং প্রত্যাশার প্রতি তখনই যথার্থ মূল্যায়ন হবে যখন দেশে চিহ্নিত এ ঘাতকদের বিচার হবে এবং বিচারের রায় বাস্তবায়ন হবে। আগামী দিনের রাজনৈতিক সরকার সে উদ্যোগ নিবে বলে বিশ্বাস করি।


যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সোচ্চার ছিলেন। আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। তাঁর সাথে দেশ-বরণ্য বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ জনগণও সেইদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে রাষ্ট্র অবস্থান নিয়েছিল ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ দেশ-বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে। জাহানারা ইমাম রাষ্ট্র কর্তৃক দায়েরকৃত অন্যায় অভিযোগ মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এদেশের মানুষ সেদিন রাষ্ট্রের এ অন্যায্য ক্ষমতা প্রদর্শন প্রত্যক্ষ করেছিলেন, প্রতিবাদও করেছিলেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এদেশের মানুষ বরাবরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছেন। বিচার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে বিএনপি জামায়াতের দমন নিপিড়নের শিকারও হয়েছিলন। নির্বাচনে দেশের মানুষের এ বিশাল গণরায় ।


আমাদের ভুললে চলবে না আজকের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে বিএনপি জামায়াত নিয়ে গঠিত চারদলীয় জোটের অবস্থান রাজনৈতিকভাবে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অধিকতর যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক রাজাকার ও জামায়াত বেষ্টিত। অর্থাৎ বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির নিয়ন্ত্রণও এ ঘাতকদের হাতে। তারা কার্যত বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলের চালকের আসনে বসা। তাই আমাদের যে কোন ভুলের কারণে এ দলটির ভূমিকা আগামীদিনে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত বলে মনে করি। কারণ নিকট অতীতে একাত্তরের এই পরাজিত শক্তির হুঙ্কার ও ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য তারই স্বাক্ষর বহন করে।


লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ; ইমেইল – [email protected]