নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশ

শুভকামনা বাংলাদেশ।।’আয়েশাদের পাশেই যেন অর্চনা’রা থাকতে পারে…’

হাসান মোরশেদ

এই সকালবেলা দেশে ফোন করে আমার পঞ্চাশোর্ধ মায়ের কন্ঠে দারুন উচ্ছ্বাস টের পাই । এই উচ্ছ্বাস আমাকে আশ্বস্ত করে । তিনভাইবোনের দুজন দেশের বাইরে, যে দেশে আছে সে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে । মায়ের কন্ঠের উচ্ছ্বাস তাই বড় দুর্লভ আজকাল ।

এই ভোরবেলা মা ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে গেছেন ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য । নির্বাচন ও ভোটকে ঘিরে তার দারুন উচ্ছ্বাস । ‘৭০ এর নির্বাচনের সময় মা ছিলেন নবম শ্রেনীর কিশোরী । সেই ৩৮ বছর আগে এক প্রান্তিক মফস্বলে স্কুলের মেয়েরাও রাস্তায় মিছিলে বেরুতো । ‘৭১ এর মার্চের শুরুতে স্কুলের সবমেয়েরা ডামি রাইফেল হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন ।
সেই অমীয় সময়ের অংশীদারিত্বই হয়তো আমার মা এবং তার প্রজন্মকে রাজনীতিবিমুখ হতে দেয়নি ।

অথচ আমি আমার ভেতরে অতোটা উচ্ছ্বাস হাতড়ে পাইনা । আমার মায়ের কাছে দেশের যে অনুভব, রাজনীতির যে স্পষ্টতা আমার মাঝে কি আসলেই অতোটা আছে?

মনে পড়ে, প্রথমবারের মতো দেশ ছাড়ার পর ফিরে গিয়ে আবার দেশ ছেড়ে আসা আমার জন্য সহজ সিদ্ধান্ত ছিলোনা । নানা দ্বৈরথে ভূগছিলাম । কিন্তু সবকিছু সহজ করে দিয়েছিল ২০০১ এর অক্টোবরের সংসদ নির্বাচন


নির্বাচনের পরের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে দক্ষিনের চরাঞ্চলে যে নারকীয় বর্বরতা চালিয়েছিল বিজয়ী দল এখনো স্মৃতিতে প্রচন্ড হ্যামারিং হয় । সংখ্যালঘু গ্রামগুলো হয়ে উঠেছিল একাত্তুরের বাংলাদেশ । একজন মা একদল উম্মত্ত পশুর কাছে করজোড়ে মিনতি করেছিলেন ‘ বাবারা তোমরা একএকজন করে এসো, আমার মেয়েটার বয়স কম ‘ জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের নামে জোটবদ্ধ হওয়া পশুর দল মা ও মেয়ে দুজনকেই একসাথে ভোগ করেছিল ।

সেই নিঃশ্বাস আটকে আসা সপ্তাহগুলোতে আমি ক্রমশঃ নিজের ভেতরে গুটিয়ে যাচ্ছিলাম, আমি সংখ্যালঘুদের চেয়ে ও সংখ্যায় লঘুতর হয়ে পড়ছিলাম । পত্রিকা পাতা জুড়ে এইসব বিভসতা দেয়াল হয়ে চেপে ধরছিল আমাকে । তখন কোন বন্ধু নেই আর, পরিত্রান নেই কোন ।
এইসব নিয়ে কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই তখন, প্রতিরোধ তো দূর অস্ত । সদ্য পরাজিতরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে নিজেদের কৃতকর্মের মাশুল দিতে, আর বিজয়ী বন্ধুদের চোখের রঙ গেছে বদলে, কোথায় কোন সংখ্যালঘুর দল গনধর্ষনের শিকার হলো, খুন হলো, নাকি দেশছাড়া হলো তাতে কি আর উৎসব থেমে যেতে পারে?

এইভাবে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে হঠা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়েছিল আমার । এইদেশ এবার ছাড়া যায় । আবেগের খুব তলানী হাতড়িয়ে ও সেই মুহুর্তে বিজয় উৎসবে উন্মাদ বাংলাদেশের জন্য আমি কোন ভালোবাসা খুঁজে পাইনি ।

আমি দেশ ছেড়ে এসেছিলাম । আমি দেশে ফিরে যেতে চাই কিনা আর অথবা আমার ফুরিয়ে যাওয়া ভালোবাসা কুড়িয়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো ফিরে পেয়েছি কিনা সে হিসাব থাক ।


এই নির্বাচনে গনতন্ত্র ফিরে আসবে কিনা সেই সব ভাবনা ও মুলতবী থাক।

আজ ভোরবেলা এই কামনা, নির্বাচন নিয়ে অন্ততঃ আমার পঞ্চাশোর্ধ মায়ের উচ্ছ্বাসটুকু টিকে থাক। যার খুশী জয়ী হোক , যে কেউ পরাজিত হোক আমার মায়ের মতো কোন মাকে যেনো তার কিশোরী মেয়ের সম্ভ্রম প্রার্থনা করতে না হয় একদল পশুদের কাছে ।ধর্মের পরিচয়, বিশ্বাসের চিহ্ণ যেনো কারো জন্য পাপ না হয়ে উঠে । যেনো এই বোধ জাগ্রত হয়, দেশ মানে কেবল মানচিত্র নয়- দেশ মানে মানুষ, মানুষের পাশে মানুষ ।

ভালো থাকুক বাংলাদেশ । শুভকামনা ।


মডারেটরের নোটঃ নির্বাচনোত্তর  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে মুক্তমনা এডভাইজরি বোর্ডের সদস্য ডঃ অজয় রায়ের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশ জুড়ে ‘সম্প্রীতি মঞ্চ মনিটরিং সেল‘  উন্মুক্ত করা হয়েছে।  বিস্তারিত বিবরণ আছে এখানে-

Sampriti Mancha Monitoring Cell Election 2008

52, Dhanmondi Residential Area, Road # 8/A, Dhaka

Telephones

Cell: 01741018999; 01937062786, 01712504312, 01556327757

Land: 8111323

সম্প্রীতি মঞ্চ মনিটরিং সেল‘  এর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখুন।


হাসান মোরশেদ, লেখক এবং প্রবন্ধকার। ইন্টারনেটের ব্লগে নিয়মিত লিখে থাকেন।