দলছুট সঞ্জীব — স্মৃতি রোমন্থনে

 

মোহাম্মদ আনওয়ারুল কবীর 

 

মৃত্যুই মানব জীবনের ভবিতব্যনশ্বর জীবনের এ অলঙ্ঘনীয় নিয়তি মেনে নিতে তবুও কষ্টবিশেষ করে গতির মাঝে আচমকা যতিতে যদি কারো জীবন দীপ নিভে যায় তবে তার স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, বন্ধু, ভক্ত সবাই হয়ে পড়ে ভাষাহীন-স্তব্ধএমনই এক অবস্থার মুখোমুখী হয়েছিলাম গেলো বছরের ১১ নভেম্বর, দলছুট সঞ্জীবের মৃত্যু সংবাদেঅপ্রত্যাশিত,  এ মৃত্যু শোকের তীব্রতা পরিলক্ষিত হয় সেদিন দুপুরে, যখন ওর মরদেহ রাখা হয় টি.এস.সি চত্বরেশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাতে আসা শোকাহত ওর স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, বন্ধু আর অগণিত ভক্তকূলের অভিব্যক্তিতে পরিষ্ফুট হয় ইশ্বরের প্রতি নীরব অনুযোগবিশেষ করে, একজন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে দেশের শিল্পাঙ্গনে ও যখন প্রতিষ্ঠিত, ওর হৃদয় ষ্পর্শিত সুরে আবেগ মাখা গান আর গানের বাণী অমৃতকে ছুঁেয় যখন আমাদের হৃদয়কে করছে জয়, ঠিক সেই মূহূর্তে ওর এ চলে যাওয়ার বাস্তবতা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না কেউইউপরন্তু বর্তমান প্রেক্ষিতে, যখন মানুষের গড় আয়ু ক্রমশঃ হচ্ছে দীর্ঘায়িত সেক্ষেত্রে মধ্য যৌবনে ওর হঠা চলে যাওয়া ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাসও বটে

 

সংক্ষিপ্ত জীবনের প্রান্ত সীমায় এসে একজন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে খ্যাতির শীর্ষ শিখরে পৌছঁতে পেরেছিল সঞ্জীববিশেষতঃ নবপ্রজন্মের কাছে সঞ্জীব দা যে কতটা জনপ্রিয় ছিল তা বোঝা যেত ওর ব্যান্ড দলছুটের কোন অনুষ্ঠানে গেলেওর গাওয়া হিট গান  গাড়ী চলে না , তুমি আমার বাহান্ন তাস, আমি তোমারেই বলে দেব, ইত্যাদি এ প্রজন্মের ভালো লাগা গানের কয়েকটি

 

সঞ্জীবের পরিচিতি শুধুমাত্র গায়ক-সুরকার-গীতিকার হিসেবেই সীমায়িত নয়বরং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সঞ্জীবের বিচরণ ছিল সৃজনশীল বিভিন্ন কর্মকান্ডেএকাধারে সে ছিল লেখক-কবি, সাংবাদিক, সংগঠক এবং অভিনেতারাজনীতিতেও তার সংশ্লিষ্টতা ছিল ঘনিষ্টবর্তমানে প্রতিষ্ঠিত অনেক সাংবাদিক, যারা আজকের কাগজ কিংবা ভোরের কাগজ সঞ্জীবের সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন তাদের অনেকেরই সাংবাদিকতার হাতে খড়ি সঞ্জীব-দার কাছেএ প্রসঙ্গে বিবিসি-র বাংলা বিভাগের সাংবাদিক নবনীতা চৌধুরীর স্বীকারোক্তি — স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি যারা তাকে সাংবাদিকতায় উসাহিত করেছেন সঞ্জীব চৌধুরী তাদের মাঝে অন্যতমযদি কাহিনীর শুরুটা ভালো করো  তবেই তা ভালোভাবে শেষ করতে পারবে- ইন্ট্রো লেখাটাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ’– ভোরের কাগজে সংশ্লিষ্ট থাকার সময় সঞ্জীবের এই মহামূল্যবান উপদেশের মর্ম কথা নবনীতা চৌধুরী তার সাংবাদিকতা জীবনে প্রতিনিয়তই উপলব্ধি করেন

 

সঞ্জীবের সাথে আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওর সতীর্থ হিসেবেআমাদের অধীত বিষয় ভিন্ন (আমি পদার্থ বিজ্ঞানে আর ও গণিতে ভর্তি হয়ে সাংবাদিকতায় নোঙ্গর করে। ) হলেও আমাদের পরস্পর ঘনিষ্ট হতে সময় লাগেনিস্বল্পতম সময়ের অন্তরঙ্গতার আলোকে কখন যে তুই তোকারীসম্বোধনে চলে আসি, তা সম্ভবতঃ আমরা নিজেরাও জানতাম না

 

তখন ছিল এরশাদের দানবীয় স্বৈর শাসনরাজনৈতিক ডামাডোলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রায়ই হতো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধএই অনির্ধারিত বন্ধগুলোতে সময়ে/অসময়ে প্রায়ই চলতো আমাদের নিত্যদিনের আড্ডাকখনও উর্দুরোডে ওর বাসায়, কখনো বা বুয়েট ক্যাম্পাসে আমার সাবেক আবাসস্থলেআড্ডার বিষয়বস্তু ছিল বহুমাত্রিকশিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে উঠতি যৌবনের বাছুর প্রেমের গল্পও বাদ যেত নাসঞ্জীব তখনো আমাদের মতোনই সাধারণ একজন–খ্যাতি তখনো তাকে স্পর্শ করেনিতবুও আমাদের মাঝে ও ছিল আলাদাওর বোহেমিয়ান লাইফ স্টাইল, প্রথা বিরোধী প্রাগ্রসর চিন্তা ভাবনা, প্রকৃতিদত্ত কবি প্রতিভা, সদা হাস্যোজ্জ্বল সপ্রতিভ চালচলন ওকে করে তুলেছিল অনন্য, অননুকরণীয়

 

শ্রেণী বৈষম্য সমাজ হতে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের স্বপ্ন দেখতো সঞ্জীবতাই স্বভাবতই বাম রাজনীতি হয়ে পড়ে ওর বিধির লিখনসঙ্গত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ও হয়ে ওঠে ছাত্র ইউনিয়নের নিবেদিত প্রাণ সংগঠক ও সক্রিয় কর্মীবিশেষ করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সেই উত্তাল রাজনীতিতে ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সঞ্জীবের সংশ্লিষ্টতা হয়ে ওঠে অনিবার্যমানুষের প্রতি ভালোবাসাই ছিলো ওর রাজনীতির উস মুখওর লেখা কবিতা, গানেও প্রতিফলিত হয়েছে ওর এই জীবনমুখী চেতনাসম্ভবত: এই চেতনাই ওকে উদ্বুদ্ধ করেছিল মৃত্যুর পর ওর মরদেহ মানব কল্যাণে কাজে লাগাতেতাই সকল সংস্কারের উর্দ্ধে ওঠে ও ওর মরদেহ দান করে যেতে পেরেছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাাটমী বিভাগে- চিকিসকদের গবেষণার জন্যসত্যি, মৃত্যুতেও সঞ্জীব হয়ে রইলো চিরঞ্জীব!

 

স্বল্প পরিসরে সঞ্জীবের কীর্তিময় জীবনের অনেক বিষয়ই অকথিত রয়ে গেলপরিশেষে প্রিয়বন্ধু সঞ্জীবের মৃত্যুবার্ষিকীতে কবিগুরুর কয়েকটি পংক্তি ধার করে জানাই আমার প্রণতি-

 

তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহ

তাই তব জীবনের রথ

পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার

বারম্বার

তাই

চিহ্ন তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই