বাসুনকে, মা

 

লুনা শীরিন

 

পর্ব ৩৮

 

 

বাসুন,

 

তোকে নিয়ে  বয়ে যাওয়া এই জীবনের কোন একটি ঘটনাও আমি মিস করতে চাই নাসব, একদম সব কিছু তোকে বলে যেতে চাইপ্রতিমুহুর্তে মনে হয় তোর ভিতর দিয়েই তো আমার/আমাদের জীবন/ সমাজ/ সংসার/ রাষ্ট্র, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম,আলো ছড়ায়,নতুন করে বিকশিত হয়গত সপ্তাহে তোকে ৫ দিনের জন্য রেখে গিয়েছিলাম নায়গ্রা ফলস এ-আইস্যপ (ইন্টিগ্রেটেঢ সেটেলমেন্ট এডপটেশন প্রোগ্রাম) কনফারেন্স এসারা কানাডার বিভিন্ন প্রোভিন্স থেকে আসা প্রায় ৮০০ প্রতিনিধি, আমরা মাত্র ৪/৫ জন বাংলাদেশী ছিলাম কত অনুভুতি, হাজারো অভিজ্ঞতা,মানুষের সাথে ভাব বিনিময়প্রতিটা রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্থাকে রিপ্রেজেন্ট করছে এক একজন মানুষ, সেই মানুষের ভিতর দিয়েই অন্যরা দেখতে পারছে প্রতিষ্ঠানকে, সমাজকে সর্বোপরি একটি জাতিকে সবার  বর্ণ, সংস্কার, বেড়ে উঠা, রুচি, আচার আচরন, এমনকি ভাষাগত ভিন্নতাও লক্ষ্য করার মতো, কিন্তু বাবু, আমরা সবাই কাজ করছি সমাজের জন্য, একইরকম সেবা প্রদান করা হচ্ছে বিভিন্ন ভাষায় কেমন করে এই ছোট জীবনের পরিসরে এত কথা বলে যাবো? ইচ্ছে আছে একটা বড় গল্প লিখবো সেই ৫ দিনের সময়কে ঘিরে

 

আজ বরং অন্য কিছু বলি তোকে, গত কয়েকদিনের ভিতর নর্থ আমেরিকায় ঘটে যাওয়া  সবচেয়ে বড় ঘটনার  নায়কের নাম বারাক ওবামাকালো মানুষের সামাজিক জয়, মিডিয়া তো এখন পর্যন্ত ওবামার সাথে আঠাঁর মতো লেগে আছে, আর লেগে তো থাকাই উচিত তাই না বাসুন? তোর স্কুলের প্রিন্সপল একজন কালো, আমার  অফিস ম্যানেজার কালো, এই শহরে আমার প্রথম কলেজ শিক্ষক কালো, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের পদেও এখন কালো  ———

 

বাবু,  তোকে এই লেখাটা যখন লিখতে শুরু করি তখন একান্তই ব্যক্তিগত  কিছু লিখি আমি আমার নিজের সময়, উচ্চারিত/ অনুচ্চরিত কিছু ভালো/মন্দ লাগা বা আমার দিনযাপনের সামান্য কয়েকটা স্মৃতিলেখা শুরু করে শেষ করা পর্বের মধ্যেও অনেককিছু ঘটে যায়, যা লেখার ধারাবাহিকতা, চিন্তা/ভাবনাকে প্রভাবিত করে, প্রাত্যাহিক জীবনের বাইরে কি মানুষ যেতে পারে বল? হয়তো লেখাটা  শুরু করেছি এমন সময় ফোন  এলো, আবার কেউ দরজায় কড়া নাড়লো আবার হয়তো তোর সাথে কিছু খুনসুটি করলাম, ব্যাস যা লিখতে বসেছিলাম তার খেই হারিয়ে গেলো, যেমন তোকে লিখতে শুরু করেছিলাম নায়গ্রা ফলস এ আমার সময়গুলোর কথা, বারাক ওবামা, কালো মানুষের কথা, মাঝে বাড়িতে গেষ্ট এলো তোর নানীআপু, ঢাকা থেকে আমার জন্য দুটো বই পাঠিয়েছেনআসলে বই দুটো দিয়েছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ প্রফেসর খান সারোয়ার মুরশিদ, তাকে আমি পরিচয়সুত্রে নানা করে ডাকিবই দুটো নানী মানে নুরজাহান মুরশিদের উপর লেখাএকটি নানীকে নিয়ে প্রকাশিত স্বারক গ্রন্থ, অন্যটি নানীর নিজেরই লেখাআমি লেখা শুরু করার মাঝামাঝি সময়ে আমার হাতে এলো বইগুলো আমি হারিয়ে গেলাম আবার বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ভিতর তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের লেখা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম নানীকে তো আমি দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখেছি, সময় কাটিয়েছি, নানীর কাছ থেকে ৫০ থেকে ৭০ দশকের  বাংলাদেশের উত্থান/পতনের গল্পও শুনেছি, কিন্তু কোথায় গেলো সেই দেশ? সুলতানা কামালের কাছে যদি জানতে চাই, যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা আপনি বলেছেন আপনার লেখায় বা যে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের কথা আপনি সবসময় বলেন, যে পরিবেশে কবি সুফিয়া কামাল আপনাদেরকে বড় করেছেন আজকের বাংলাদেশের প্রজন্মের সামনে সেই বাংলাদেশকে কেন তুলে ধরতে পারলেন না? কেন স্বাধীনতার পর একটি প্রজন্মও  বাংলাদেশকে সঠিকভাবে চিনতে পারলো না? কে নেবে এই দায়ভার? এই যে বাবু, আমি টাইপ করছি, বলে যাচ্ছি আমার ফেলে আসা দেশ নিয়ে সবটুকু আবেগ কিন্তু তোকে তো শেখাতে পারিনি একটি বাংলা হরফও বা বোঝাতে পারিনি নিজের দেশকে তাহলে কোথায় গিয়ে শেষ হবে এই যুদ্ধ? অনেকে এখন বলেন গ্লোবাল কান্ট্রি, কই বারাক ওবামা তো ভোলেননি ইতিহাস বা তার অতীতকে, শিকাগো শহরের সেই ভাষনে তো তিনি পই পই করে উচ্চারণ করেছেন অতীতের কথা, ইতিহাসের কথা, পূর্বপ্রজন্মের কথা, তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম বা তোরা কেন নিজের শিকড়কে চিনে নিবি না?

 

তীব্র হতাশার এই দেয়ালে একদিন ধ্বস নামবে এইটুকু বিশ্বাস নিয়ে আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতে চাই সোনা ভালো থাক

 

তোর মা,

 

৯ই নভেম্বর ২০০৮